ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নরমান্ডি ॥ ১৯৪৪-এর কথা

প্রকাশিত: ০৯:০২, ৪ আগস্ট ২০১৯

নরমান্ডি ॥ ১৯৪৪-এর কথা

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ছিল মূলত নাজি স্বৈরতান্ত্রিক দর্শনের বিপরীতে গণতান্ত্রিকতার বিজয়ের সংগ্রাম। এই সংগ্রামে হিটলারের নাজি স্বৈরতান্ত্রিকতার মোড়কে বিজিত ইউরোপকে মিত্র শক্তি কর্তৃক মুক্তি দেয়ার অভিযান শুরু হয়েছিল ১৯৪৪ এ ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমের নরমান্ডি উপকূলে। ১৯৪৪ এর ৬ জুন বা ডি-ডেতে হিটলারকে ইউরোপ থেকে হটিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে মিত্র শক্তির লক্ষাধিক পদাতিক সৈন্য নেমেছিলেন নরমান্ডিতে, অভিযানে নিহত হয়েছিলেন মিত্র শক্তির ১০ হাজার সৈন্য আর হিটলার বা অক্ষ শক্তির ২১ হাজার। এই উপকূলে গিয়ে গণতান্ত্রিক মুক্তির জন্য নিবেদিত সংগ্রামে প্রাণত্যাগী যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানানো ও সম্মান দেখানোর জন্য বহুদিন ধরে আমি ও সিতারা আশা করে এসেছিলাম। আশা পূরণ হলো এই বছরের ২২ জুনে, যখন ফরাসী সিনেটের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সংশ্লিষ্ট বিশ্ব সংসদীয় নেটওয়ার্কের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আলোচনার এক ফাঁকে প্যারিসে বসবাসকারী দুই বাঙালী শাহীন ও আমীনকে নিয়ে নরমান্ডি উপকূলে গিয়ে ইংলিশ চ্যানেলের আছড়ে পড়া নিরবচ্ছিন্ন ঢেউয়ের পটে মানুষের অধিকারে সমুজ্জ্বল সেই নিলয়ে অস্তিত্বমান তরুণ তরুণীদের মিলে মিশে গিয়ে স্বাধীন সত্তার মর্ম উপলব্ধি করেছিলাম আমরা দু’জনে। প্যারিস থেকে গত ২২ জুন সকালে ফ্রান্সে বসতি গাড়া দুই বাঙালী শাহীন ও আমীনকে নিয়ে আমি ও সিতারা রওনা হয়েছিলাম নরমান্ডি উপকূলের দিকে। গাড়ি চালিয়েছিলেন প্যারিসে বসবাসকারী চৌকস তরুণ আমীন। আমরা প্যারিস থেকে বের হয়ে নরমান্ডি যাওয়ার প্রধান জনপথ এড়িয়ে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চল দেখার ইচ্ছে নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে চলছিলাম। ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চল পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠের পারে সাজানো গোছানো শহরের বাড়ির মতই কৃষকদের বাড়ি। আধুনিক জীবনের সকল প্রয়োজন, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন, পয়ঃব্যবস্থা, বিদ্যুত সংযোগ, পাকা সড়ক, সাজানো ফল ফুলের বাগান নিয়ে এক একটি বাড়ি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের প্রতিচ্ছবি নিয়ে দাঁড়ানো। চাষের যন্ত্রপাতি-ট্রাক্টর, হারভেস্টার, বীজ বপনীযান, ট্রাক ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি নয়নকাড়া এসব বাড়ির কোনায় কোনায় সুরক্ষিত ও সাজানো। নারী পুরুষ, যুবক যুবতী, ছাত্র ছাত্রী, সকলে সপ্রতিভ, শহরের মতো মনকাড়া গ্রীষ্মের বিরল বসনা পোশাকে আবৃত ও কর্মঠ এবং জীবন উপভোগের প্রত্যাশীর স্বপ্ন ভরা চোখ নিয়ে কাজ করছেন যে যার কর্মবৃত্তে। এখানে সেখানে যাচ্ছেন এবং গাঁয়ের পথের কোনায় রেস্তরাঁয় বসে কফি সিডার খাচ্ছেন। এখনকার এই সুন্দর সাবলীল ও মুক্ত জীবনের অর্জনের সংগ্রামে নরমান্ডি উপকূলে প্রাণ দিয়েছিলেন তখন সেসব হাজারও তরুণ। তাদের উৎসর্গকৃত জীবনের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে ফ্রান্সের এই এলাকার গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত এই মানুষদের দেখে তাই মনে হয়। তেমনি উপলব্ধি করা যায় মুক্তির আশীর্বাদ নিয়ে মানুষের অধিকারে জীবনকে সমৃদ্ধ মনে করে ইংলিশ চ্যানেলের মৃদুমন্দ পরশ জাগানো ঢেউ এ পা রেখে কিংবা হাত পা এমনকি শরীর ডুবিয়ে ঘুরে বেড়ানো বা সাঁতরানো অসংখ্য মানুষকে দেখে, তাদের সবান্ধব কল কাকলি শুনে। এসব মুক্ত পৃথিবীর মুক্তিমনা মানুষ, মানবতার যুদ্ধে জয়ী ১৯৪০ এর দশকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাকরণে প্রাণ দেয়া তরুণদের উত্তরসূরি। ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখেছি ১৯৪০ এর দশকে মানবতাকে জয়ী করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা শুয়ে আছেন নরমান্ডির ৩টি প্রধান সমাধিস্থলে। এর মধ্যে একটি হলো আমেরিকানদের। আরেকটি ব্রিটিশদের। আমেরিকানদের সমাধিস্থলের অবস্থান কলেভাইল সুর মারে। একই রকম সাদা ক্রশ নিখুঁতভাবে সারির পর সারি সবুজ ঘাসে মোড়া প্রান্তরে রক্ষিত- এই পৃথিবী থেকে স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ পরাজিত করার জন্য তাদের ত্যাগের স্মারক হয়ে বসানো আছে সেখানে। ১৬ থেকে ৩০ বছরের সেইসব আত্মাহুতি দেয়া প্রায় ৫ হাজার আমেরিকান তরুণ চিরদিন আমাদের শ্রদ্ধার সালাম পেতে থাকবেন এই সমাধি প্রাঙ্গণে। নিহত ব্রিটিশদের বায়ুকস সমাধিস্থলে শায়িত রয়েছেন তেমনি ৪৬৪৮ জন পদাতিক। এদের অন্তিম শয়ানস্থানের চিহ্নসমূহ সারি সারি ক্রশের শোকাবহ শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে দিগন্ত ছড়ানো চির বিদায়ের দ্যোতনা নিয়ে চিহ্নিত করেছে সেই সমাধিস্থল। এদের বাইরে নরমান্ডিতে জার্মানির দখল রক্ষাকরণে ব্যর্থ প্রাণ দেয়া জার্মানদেরও একটি নির্দিষ্ট সমাধিস্থল ও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জার্মানদের সমাধি লা ক্যামটেতে শায়িত আছেন ২১,২২২ জন পদাতিক সৈন্য। ঘাসে মোড়া ভূমির সঙ্গে প্রায় মেলানো গ্রানাইট পাথরে নির্দেশিত তাদের অন্তিম শয়ান। বলা হয়ে থাকে দেশের প্রতি ভালবাসা নয়, স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের অনুকূলে আনুগত্য আর পার্থিব মোহ তাদেরকে নরমান্ডির এই প্রান্তরে অকাতরে প্রাণ দিতে বাধ্য করেছিল। এদের বিপরীতে, শোনা যায় মিত্র শক্তির প্রায় ১০ হাজার সেনা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের নরমান্ডি অভিযানে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল নাকি আশঙ্কা করেছিলেন ২০ হাজার তরুণকে প্রাণ হারাতে হবে সেই অভিযানে। সেজন্য ৬ জুন তারিখে নরমান্ডির অভিযান পরিচালনায় তিনি ইতস্তত করেছিলেন বলে শোনা যায়। গত বছরে অস্কারপ্রাপ্ত ছবি ডানকার্কে বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখানো হয়েছে চার্চিলের এভাবে হাজারো তরুণ প্রাণকে বিসর্জনে ঠেলে দেয়ার প্রতিকূলে উৎকণ্ঠা। হাঁটতে হাঁটতে দেখে কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পরা মাথা নিয়ে ভাবছিলাম এরা এবং এদের মতো অকুতোভয় সৈনিকরা আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের তটপ্রান্তে এবং পূর্ব ইউরোপের অগম প্রান্তরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েই পৃথিবীকে উপহার দিয়ে গেছেন ১৯৪৫ সালে স্বৈরতান্ত্রিকতার ওপর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিজয় এবং ১৯৪৮ এর বিশ্ব মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণা- যার বলয়ে ও ভিত্তিতে পৃথিবীব্যাপী স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এখনও চলছে। ১৯৪৪ সালের সেই ৬ জুনে নরমান্ডি উপকূলে নেমেছিলেন মিত্র শক্তির প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার পদাতিক। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছিলেন আমেরিকান আর বাকি অর্ধেক ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ডার। প্রাথমিকভাবে নরমান্ডির তট থেকে জার্মানদের বিতাড়িত করার পর সেই বছরের ৪ জুলাইয়ের মধ্যে উপকূল রেখা পার হয়ে এসেছিলেন মিত্র শক্তির ১০ লাখ সৈন্য। শুনলাম, এদের বাহন ছিল ৬৯৩৯টি সাধারণ জাহাজ, ১২১০টি যুদ্ধ জাহাজ, ৪১২৬টি পরিবহন জাহাজ ও ৮৬৪টি বাণিজ্যিক জাহাজ। এসবের প্রতিরক্ষণে এবং নরমান্ডির তটে পদাতিক সেনাদের নামানোর অভিযানে আমেরিকান ও ব্রিটিশ নৌ নাবিকসহ এগিয়ে এসেছিলেন প্রায় ২ লাখ নৌসেনা। এই সকল সেনারা এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডা থেকে। পরে আজাদ ফরাসী ফৌজ, নাজি অধিকৃত পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস থেকে পালিয়ে আসা পুনর্গঠিত দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা যোগ দেন এই অভিযান বিস্তৃত ও সফল করার পথে। ডি-ডের অভিযানে নরমান্ডির কোড-নামায়িত ওমাহা ও ইউথা উপ-উপকূলে নামেন যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকরা, ব্রিটিশ সৈন্যরা নামেন তেমনভাবে নামায়িত গোল্ড ও সোর্ডের তট-ভূমিতে আর কানাডার সৈন্যরা তেমনি নামেন জুনো নামায়িত সাগর তটে। নরমান্ডির উপকূলের এই ৫টি অংশ বা এলাকা মিত্র শক্তির এসব কোড নাম ধারণ করে আগের পরিচিতির উপরে এসব নামগুলো উজ্জ্বল করে গেঁথে রেখেছে। এরা ও এদের অনুসরণ করে জাহাজ ভরে আনা পদাতিক সেনাদের বেশির ভাগ নরমান্ডির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের হাম্পসায়ার ও পোর্টসমাউথ বন্দর থেকে। মনে এলো ১৯৯৪ এর ৫ জুনে সাউথসিতে ডি-ডে জাদুঘরে ও তার পাশে ছড়ানো সাধারণ প্রাঙ্গণে এই সকল বীরদের স্মরণে এক প্রার্থনা সভায় ৩ লাখ জনগণের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সেই স্মরণে একাত্ম হয়েছিলেন সারা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সচেতন সকল জনগণ। নরমান্ডির তটে মিত্রশক্তির সেই জয় যাত্রার পটে আমাদের মনে ভেসে এসেছে এর ৪ বছর আগে ১৯৪০ সালে ২৬ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ৯ দিনে ফ্রান্সের ডানকার্ক তট থেকে জার্মানদের প্রচ- আক্রমণের মুখে মিত্র বাহিনীর সফল কৌশলগত পশ্চাদপসারণ এবং তারপরে তাদের ইউরোপের মুক্তির অভিযানের জন্য পুনঃসজ্জিত করণের কথা। সেই সময়ে ৩ দিক থেকে নাৎসী জার্মান বাহিনী মিত্রশক্তির ৩ লক্ষাধিক ব্রিটিশ, ফরাসী, বেলজিয়ান ও পোলিশ সেনাদের ঘিরে ফেলেছিল। মোট ৮৬১ জাহাজে করে ২৭ মে থেকে ৩ জুন এর মধ্যে ৪০ হাজার ফরাসী সৈন্যদের রেখে অন্য সব দেশের সৈন্যদের ডানকার্কের তট থেকে ব্রিটেনের ডোভারে নিয়ে আসা হয়েছিল। শুনেছি, এই বিশাল কর্মযজ্ঞে প্রযুক্ত ৮৬১টি জাহাজের মধ্যে ২৪৩টি পশ্চাদপসারণের পথে ডুবে গিয়েছিল। পেছনে ফেলে যাওয়া অকুতোভয় ৪০ হাজার ফরাসী সৈন্য জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ডানকার্ক সীমান্তে দেশপ্রেমের উজ্জ্বলতাকে তুলে ধরে প্রাণ দিয়েছিলেন। এসব ফরাসী সেনাদের বীরত্ব ও ত্যাগ ফরাসী জাতিকে যুগের পর যুগ সাহস আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছে। হিসাব করে দেখা গেছে যে এই পশ্চাদপসরণের যুদ্ধে ডানকার্কের প্রায় ৯০% বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ১৬ হাজার ফরাসী এবং ১ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য অপসারণের প্রক্রিয়ায় ডানকার্কের তটে কিংবা ডানকার্ক ও ব্রিটেনের ডোভারের মধ্যস্থিত সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছিলেন। নরমান্ডির তটে সাগরের ঢেউ ছোঁয়া এক রেস্তোরাঁয় বসে দুপুরের খাবার খেতে খেতে শুনছিলাম সেই ৬ জুন ডি- ডের অভিযানের বিরুদ্ধে জার্মানদের প্রতিরোধের কথাও। হিটলারের নির্দেশে জার্মান সৈন্যরা এ তটরেখা ধরে পরিখার পর পরিখা খুঁড়ে সেগুলোকে অগুনতি কামান দিয়ে সাজিয়ে সম্ভাব্য মিত্র শক্তির অভিযান রুখতে তৈরি ছিল। ডি-ডের চন্দ্রালোকিত রাতে মিত্রশক্তির বিমান ও নৌআক্রমণ এসব স্থাপনাকে বিপর্যস্ত করে তাদের পদাতিক সেনা নামাতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিল। আর সেদিন নাকি সৌভাগ্য জার্মানদের একরোখা আর সাহসী অধিনায়ক মার্শাল রোমেল তার স্ত্রীর জন্মদিনের পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য নরমান্ডির জার্মান পরিখা থেকে বের হয়ে বার্লিনে গিয়েছিলেন। মার্শাল রানদস্টেদ নাকি তার বিকল্পে সে সময় জার্মান সৈন্যদের মিত্রশক্তির অভিযান ঠেকাতে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তার বিপরীতে মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক ছিলেন ডোয়াইট ডি আইসেনহাওয়ার (যুক্তরাষ্ট্র) এবং তার সহযোগী ছিলেন পদাতিক বাহিনীতে বার্নার্ড মন্টগোমারী (ব্রিটিশ) এবং নৌবাহিনীতে এডমিরাল এলান জি-কার্ক (যুক্তরাষ্ট্র)। গুরুত্বপূর্র্ণ ইউথা ও ওমহা তটে অধিনায়কত্বের দায়িত্বে ছিলেন ওমর ব্রাডলী (যুক্তরাষ্ট্র)। শৌর্যে ও বীর্যে এঁরা ছিলেন কিংবদন্তীয় সমরনায়ক। কিন্তু আমাদের মনে হলো নরমান্ডির জয়ের মূল শক্তি ছিল সাধারণ তরুণ সৈনিক যারা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য স্বৈরতান্ত্রিকতার প্রতিভূকে পরাভূত করার দৃঢ়সংকল্প আর অকুতোভয়ের শক্তি নিয়ে এগিয়ে ছিলেন। আর তাদের সহযোগী ছিলেন নরমান্ডি থেকে প্যারিস পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার গণতন্ত্রকামী সুশীল সাধারণ নারী পুরুষ। আমরা শুনেছি মিত্র বাহিনীর অভিযান প্রতিরোধের চেষ্টায় জার্মানরা স্থানীয় জনগণের থেকে সেই সময়ে কোন সহায়তা পায়নি। গণমানুষের সমর্থন ছাড়া যে কোন মেয়াদী সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায় না তা ২য় মহাযুদ্ধকালীন নরমান্ডি, ফিলিপিন্স, স্টালিনগ্রাদের সেসব ভয়াবহ সংগ্রামের প্রমাণের সঙ্গে পরবর্তী যুগে যোগ করেছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামকে। রেঁস্তরার বাইরে সড়ক পারে ছড়ানো কফি টেবিল ধরে অগুনতি মুক্তির আলোয়ে প্রাজ্জল মানুষের মেলে আমাদের এই প্রতীতি আবারও এসেছে যে এদের গণতন্ত্র ও মুক্তির সংগ্রামে প্রাণ দেয়া তরুণদের উত্তরাধিকারী হিসেবে এই শতাব্দীর শুরুতে আছি আমরা- আজকের এই দিনের মুক্ত ও গণতন্ত্রের অধিকারে সঞ্জীবিত জনগণ। অবচেতন মনে গেঁথে এলো সেই দায়িত্ব যা পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র ও মুক্তি সংগ্রামে প্রাণ দেয়া বীর সেনারা দিয়ে গেছেন আমাদের ঐতিহ্যের উপকরণ রূপে। উপলব্ধি করলাম, আমরা স্বৈরতন্ত্রের তল্পীবাহক কিংবা দাসত্বের ক্রীতদাস নই, আমরা গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকারের সুফল-সমুজ্জ্বল জনগণ, আমরা পরাজিত হওয়ার জন্য জন্ম নেইনি, আমরা সর্বক্ষেত্রে দ্বিধা ও ভীতি পেছনে ফেলে দিগন্ত থেকে দিগন্তে আওয়াজ তুলে চলি- আমরা করব জয়। সূর্য ডোবার অনেক পরে নরমান্ডির তট থেকে আলোর নগরী প্যারিসে এসে তাই সেখানে পরদিন ফরাসী সিনেটের সঙ্গে আলোচনায় বিশ্ব সংসদীয় নেটওয়ার্কের তরফ থেকে পৃথিবীব্যাপী দারিদ্র্য, অসমতা ও অত্যাচার-অবিচার নিরসনে আমাদের আলোচনা সুগ্রন্থিত ও সফল করতেই হবে বলে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছি। ডানকার্ক থেকে সফল কৌশলগত পশ্চাদপসারণ ৩ বছর পরে নরমান্ডির জয়ের অগ্রযাত্রায় ব্রিটিশ, ফরাসী ও আমেরিকান সৈন্যদের আম্য শক্তি ও যান্ত্রিক সামর্থ্য যুগিয়েছিল বলা চলে। ডানকার্কের তটে মার্বেল খচিত স্মৃতি স্মারক : ডানকার্কের যুদ্ধে ১৯৪০ এর মে-জুনে ফরাসী ও মিত্র শক্তির প্রাণ বিসর্জনকারী বীর পাইলট, নৌসেনা ও ভূমি সেনাদের সম্মান জানিয়ে চির গৌরব নিয়ে অস্তিত্বমান। আমাদের হৃদয়ে অনুচ্চারিত প্রতীতি এনেছেন ডানকার্ক ও নরমান্ডিতে প্রাণ দেয়া গণতন্ত্রের সকল সেনানী। একই লক্ষ্যে ও প্রতীতিতে বিশ্বাসী হয়ে তারা আমাদের দিয়ে গেছেন সামনে চলার এক অবিস্মরণীয় ঐতিহ্য, অদম্য প্রেরণা। নরমান্ডির তট রেখা ধরে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ থেকে আসা তরুণ তরুণদের মেলে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছি আমরা অতিথিদের জন্য আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো পোশাক-আশাকের দোকানের সামনে। সাজানো প্যান্ট শার্টে নরমান্ডি নাম মুদ্রিত সাগর পাড়ের দৃশ্য, জাহাজের প্রতিকৃতির, সৈনিকদের দৃঢ় পদ ভরে চলার স্থিরচিত্র। নরমান্ডির গৌরব গাথা স্বৈরতান্ত্রিকতার প্রতিকূলে গণতন্ত্র ও মানবতার বিজয়ের প্রতিচ্ছবি নিয়ে আমাদের নাত-নাতনিদের জন্য সিতারা কিনলেন বেশ কয়েকটি শার্ট, ফ্রক ও গেঞ্জি। জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, এগুলো শারীরিক প্রয়োজন বা প্রতিরক্ষণের জন্য নয়- গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ও বিজয়ের গাথা উত্তরসূরিদের স্মরণ রাখার জন্য সহায়ক। দেখলাম ভিনদেশী অনেকেই আমাদের মতো কিনছেন নরমান্ডিতে তরুণদের ত্যাগ ও মানবতাবোধের এসব নিশানা। উত্তরসূরিদের তাদের পূর্বসূরিদের ত্যাগ, বিজয় ও মানবতাবোধ স্মরণকরণে সেই পথে দৃঢ় পদ ভরে এগিয়ে যাওয়ার এও এক দায়িত্ব পালন, সন্তোষের উপকরণ আহরণ। অনুধাবনের হাসি হাসলাম, সিতারা বুঝলেন, শাহীন-আমীন ঐ পথ ধরে ফরাসী তারুণ্যের ছবি আঁকার উপলব্ধি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। তাদের কথা অনুযায়ী প্যারিসের প্রায় সকল দেশ থেকে আসা তরুণ শিল্পীদের বেড়ে ওঠার নিলয় মোমার্ত পরদিন দেখার জন্য ঠিক গিয়েছিলাম। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের সংগ্রামের এই স্মৃতি- এই অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীর অনুভূতি, উপলব্ধি ও গর্ব নিয়ে ফিরে এসেছি আলোকোজ্জ্বল প্যারিসের- সীন নদীর প্রখ্যাত বামতীরের খেয়াল খুশিমতো থাকা, বলা ও ছবি আঁকার নিলয়ে। বহু কাল ও সংগ্রামের সাক্ষী সম্প্রতি আগুনে পোড়া নটরডেম গির্জাকে সামনে রেখে সড়ক পারের টেবিলে যখন কফিতে চুমুক দিয়েছি তখন ফুল বিক্রেতা এক বাঙালী যুবক এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। জিজ্ঞাসিত হয়ে নাম বললেন। বললেন কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে তুরস্ক-গ্রীস-কসভো-হাঙ্গেরী-জার্মানি হয়ে কেবল ভিসাবিহীন বাংলাদেশের ছাড়পত্র নিয়ে আইন বহির্ভূত অভিলাষের জোরে ঢুকেছেন ফ্রান্সে। আরও বললেন তার মতো অর্থনৈতিক মুক্তি সমৃদ্ধির অন্বেষণে এই প্যারিসেই আছে একশ’রও বেশি অভিবাসী প্রত্যাশী তরুণ। বিনাদামে ফুল দিতে চাইলেন, না নিয়ে জানতে চাইলাম অভিবাসনের কাগজপত্তর না থাকায় পুলিশ ধরে কিনা। স্মিত হেসে বললেন- মাঝে মাঝে ধরে, থানায় নিয়ে পরিচ্ছন্ন বিছানায় শুইয়ে ভাল খাবার দিয়ে এক রাত্তি রেখে সকালে ছেড়ে দেন। তারা হাত বাঁধে না, মারের বদলে স্মিত হেসে সাবধান করে দেন। মনে হলো, ডানকার্ক ও নরমান্ডিতে স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষাকরণের সুমহান ঐতিহ্যের দেশ ফ্রান্সে পুলিশের এই ধরনের মানবিক ব্যবহার অবচেতনভাবে সকল নাগরিকের মাঝে ছড়ানো মুক্তি ও অধিকারের মূল্যবোধই সম্ভবত অভিবাসনের এ দলিলবিহীন বাঙালী তরুণের প্রতি তাদের আচরণে ফুটে ওঠে, আটলান্টিকের ওপারে সমৃদ্ধির আরেক দেশকে পথ দেখাতে চায়, নিউইয়র্কের প্রবেশ মুখে ফরাসীদের উপহৃত সেই স্বাধীনতার স্তম্ভে অববায়িত সর্বজনীন মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বানকে সোচ্চারিত ও সমুন্নত রাখে। লেখক : সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা
×