ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক জোট নিয়ে সঙ্কটে বিএনপি

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৩ আগস্ট ২০১৯

রাজনৈতিক জোট নিয়ে সঙ্কটে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ রাজনৈতিক জোট নিয়ে সঙ্কটে বিএনপি। যে স্বপ্ন নিয়ে তারা বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে তা আজ কোন কাজেই আসছে না। উল্টো এ জোট করার কারণে সমমনা অনেক রাজনৈতিক দল বিএনপি থেকে দূরে সরে গেছে। আবার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও এখন আগের মতো বিএনপিকে সহযোগিতা করছে না। বরং এ জোটের কোন কোন শরিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করায় তা দলটির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মী ও দলটির শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে পারলে বিএনপির ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য ভাল হতো। কিন্তু দলের ভেতরই আবার কোন কোন নেতাকর্মী মনে করছেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডি সভাপতি আসম রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধিকাংশ নেতা এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাই তারা বিএনপির কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করবেন না। বরং নিজেদের স্বার্থে তারা বিএনপিকে কাজে লাগাবেন। এর ফলে বিএনপিও এ জোট করে কোনদিন লাভবান হবে না। আর এটি বুঝতে পেরেই বিএনপি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করছে। আবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও বিএনপিকে কাছে টানার চেষ্টা করছেন না। বরং ফ্রন্টের কোন কোন নেতা বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিএনপির জন্য সঙ্কট বলেই দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ এবং বেশির ভাগ জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী মনে করেন, একই আদর্শ এবং চেতনাকে ধারণ করে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল। তাই বিএনপির রাজনীতির মূল শক্তি ২০ দলীয় জোট। এ জোটকে আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় করা ছড়া সাফল্য আসবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াত থাকায় ২০ দলীয় জোটকে দেশ-বিদেশে অনেকেই পছন্দ করছে না। এর ফলে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সহযোগিতা থেকে বিএনপি বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া ইতোমধ্যেই ২০ দলীয় জোট থেকে কয়েকটি রাজনৈতিক দল চলে গেছে। ডামি নেতা দিয়ে ওইসব দলের অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। তবে এ জোটের সবচেয়ে পুরনো দল বিজেপি চলে যাওয়ার পর কোন ডামি নেতাকে দিয়ে এ দলটির অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। আর ২০ দলীয় জোটের আরেক প্রভাবশালী দল এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ এ জোটের আরও ক’টি দলকে নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করেছেন। যদিও জাতীয় মুক্তি মঞ্চ বিএনপি জোট ত্যাগ করেনি তবুও মাঝেমধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে বেফাস কথা বলে রাজনৈতিকভাবে চরম ক্ষতি করছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। জোট নিয়ে বিএনপির ভেতরেও নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ২০ দলীয় জোট। তিনি জেলে থাকায় বিএনপি কিংবা এ জোটের সিনিয়র নেতারা নেতৃত্বে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপির কিছু অতি উৎসাহী নেতার ইচ্ছায় রাজনীতিতে কার্যত নিষ্ক্রিয় বয়োবৃদ্ধ গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। আর এ ফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতি শরিক দলের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয় ড. কামাল হোসেনকে। এ বিষয়টি বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো সহজভাবে নিতে পারেনি। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। যা পরবর্তীতে আস্তে আস্তে আরও ঘনীভূত হয়। অভিজ্ঞ মহলের মতে ড. কামাল হোসেনকে নিয়েই বিএনপি জোটে এখন সমস্যার মূল কারণ। আর যে সমস্যা সমাধানে আপাতত কোন পথ দেখতে পাচ্ছে না বিএনপি। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিএনপি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ছাড়াই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী সমাবেশ কর্মসূচী পালন শুরু করেছে। তবে এ কর্মসূচী শুরুর আগে দুই জোটের শরিক দলগুলোর সহযোগিতা চাইলেও জামায়াতসহ কোন কোন শরিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয় তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের মঞ্চে বসানো হলে তারা স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের সমাবেশ কর্মসূচী সফল করার আহ্বান জানাবে। কিন্তু শরিক দলের নেতাদের মঞ্চে বসানোর বিষয়ে রাজি না হওয়ায় বিএনপির সমাবেশে জোটের ওইসব শরিক দলের নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে হাজির হচ্ছে না। এর ফলে এ পর্যন্ত ৩ বিভাগীয় সদরে বিএনপি যে সমাবেশ করেছে তাতে তেমন লোকসমাগম হয়নি। অথচ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগে এ ধরনের সমাবেশে জামায়াতসহ জোটের শরিক দলের নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে কর্মসূচী সফল করে দিতেন। তবে শরিক দলের সহযোগিতা ছাড়া সমাবেশ কর্মসূচী সফল না হলেও বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করছেন কারও সহযোগিতা ছাড়া নিজস্ব ক্ষমতাবলেই দলকে আন্তে আস্তে এগিয়ে নিতে হবে। তাদের মতে বিএনপিকে যারা ভালবাসে না তারা দলের মঙ্গল চাইবে না। তাই সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করেই বিএনপিকে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। আর তাহলেই সঙ্কট মোকাবেলা করে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোটকে উপেক্ষা করে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর মহাধুমধামে গণফেরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। এ জোট গঠনের পর গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপকালে ২০ দলীয় জোটের কোন শরিক দলের প্রতিনিধি নেয়নি বিএনপি। এ কারণে তখন থেকেই ২০ দলের শরিকরা বেঁকে বসে। আর নির্বাচনে ভরাডুবির পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্কের অবনতি ঘটে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমে গণফেরামের নির্বাচিত ২ জন ও পরে বিএনপির এমপিরা শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার এ নিয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে অনৈক্য তৈরি হয়। বেশ ক’টি শরিক দল প্রকাশ্যেই বলে দেয় বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ না করলে তারা ২০ দলীয় জোটে থাকবে না। বিপরীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বলা হয় বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকলে তারাও বিএনপির সঙ্গে কোন কর্মসূচী পালন করবে না। এ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পাথ। ২০ দলীয় জোটের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে তিনি এ জোট থেকে পদত্যাগ করেন। এর কিছুদিন পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে এ জোট থেকে পদত্যাগ করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করার পর ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ে। ২০ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। কিন্তু পরে ঐক্যফ্রন্টের দুইজন এবং বিএনপির সাংসদরা সংসদে যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই। এসব কারণে ২০ দলীয় জোটে থাকার আর প্রয়োজন মনে করিনি।
×