ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিশ্রমে অভাব জয়, সুখের মুখ দেখা জয়িতা নারী

প্রকাশিত: ১০:২৫, ৩ আগস্ট ২০১৯

পরিশ্রমে অভাব জয়, সুখের মুখ দেখা জয়িতা নারী

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মেয়ে মদিনা আক্তার। অভাব যার নিত্যসঙ্গী। বাবার বাড়ি থেকেই অভাবকে শাড়ির আঁচলে বেঁধে শ্বশুরবাড়িতে যাত্রা তার। ভেবেছিলেন, বাবার বাড়ি থেকে বিদায় হলেই বুঝি অভাবও বিদায় নেবে। কিন্তু না, অভাব পিছু ছাড়েনি তার। অভাবের রোষানলে পড়ে স্বামীকে জমি বিক্রি করে বিদেশ পাঠানোর উদ্দেশে ৫ লাখ টাকা জমা দেন দালালের কাছে। সেই টাকার মধ্যে তিন বছর ঘুরে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছিলেন তিনি। আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মঠ এই নারীকে কিছু একটা করার অদম্য ইচ্ছে তাড়িয়ে বেড়াত। কিন্তু অর্থ সঙ্কট তার এই অদম্য ইচ্ছাগুলো বার বার বাহুবন্দী করে রাখে। বাবার বাড়ি ও স্বামীর অল্প রোজগার থেকে কিছু টাকা জমিয়ে একটি উন্নত জাতের গাভী ক্রয় করেন। সেই থেকে শুরু। তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তিন বছরের অদম্য ইচ্ছা, কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসে অভাবকে যেন জাদুঘরে পাঠিয়েছেন তিনি। আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি পরিশ্রম করে এখন তার খামারে দেশী ও উন্নত জাতের ছোট বড় ১৮ ষাঁড় এবং গাভী গরু রয়েছে। উপরে উল্লেখিত ঘটনাটি জয়িতা নারী ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার বাঘেরগাঁও গ্রামের মদিনা আক্তার। ১১ বছর আগে দালালের খপ্পরে পড়ে স্বামীকে বিদেশ পাঠাতে না পারায় দুই লাখ টাকা গায়েব হওয়ার হতাশায় ভুগতে থাকেন মদিনা-জুয়েল দম্পতি। এরই মধ্যে তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে সন্তান। ছেলের ভবিষ্যত সুখের দিকে তাকিয়ে হতাশা পেছনে ফেলে মদিনা-জুয়েল দম্পতি শুরু করে কান্দিপাড়া বাজারে কাপড়ের ব্যবসা। একপর্যায়ে, তিন বছর আগে কাপড়ের ব্যবসা গুটিয়ে একটি গরু দিয়ে তারা শুরু করেন খামার। এখন তার খামারে ছোট বড় ১৮ গরু। একেকটির মূল্য ৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মদিনা বলেন, গরুর খামার দিয়েই ৩ বছরে আল্লাহ বেশ রেখেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এত পরিশ্রম করতে পারলে গ্রামে আমরা নারীরা কেন পরিশ্রম করতে পারব না। আশা করি, সামনের কোরবানির ঈদে ৫ লাখ টাকার গরু বিক্রি করব। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ আছি এখন। বর্তমানে ৪ গাভী গরু প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ লিটার দুধ দেয়। খাবারের জন্য রেখে ৫ লিটার দুধ ৫০ থেকে ৭০ টাকা দরে বাজারে বিক্রি করে দেই। এতে সংসারের খরচ চলে যায়। মদিনা আরও বলেন, ইচ্ছা করলেই কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারবে না। তবে আমার খামারে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও তাদের খামারে আনতে পারি নাই। আমি মহিলা বলেই তারা আমার খামারের দিকে ফিরেও তাকান না। যদিও কখনও আসে পারিশ্রমিক হিসেবে তাদের দিতে হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আমি গত ১১ বছরে পরিশ্রম করে তিন বছর ধরে সফলতার মুখ দেখছি। আজ আমার কাছে অনেক লোক আসে খামার দেখতে, পরামর্শ নিতে, গরু প্রজনন ট্রেনিংপ্রাপ্ত সুলভ ফরাজী নামে এক ব্যক্তি আমার খামারে সর্বক্ষণিক গরুগুলো দেখাশোনা করে। প্রয়োজনমতো চিকিৎসা দিয়ে এবং বাইরে থেকেও ডাক্তার এনে আমার খামারের উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি আমার একটা গাভী গরু মূল্য প্রায় ৬০-৬৫ হাজার টাকা হবে। অসুস্থ হয়ে পড়লে গফরগাঁও উপজেলা পশু হাসপাতালে বার বার ডাক্তারদের কাছে গিয়ে তাদের আনতে পারিনি। পরে পাশর্^বর্তী হোসেনপুর উপজেলার এক ডাক্তার এনে গরুর চিকিৎসা করাই। তবে গরুটি বাঁচাতে পারি নাই। গফরগাঁওয়ের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই আমার মূল্যবান এই সম্পদ মারা গেছে। লংগাইর ইউনিয়নের সুলভ ফরাজী বলেন, তিল তিল করে মদিনা আক্তার জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আজ কিছুটা স্বপ্নের পথ দেখছে। আমরা এলাকাবাসী অনেকেই মদিনা আক্তারের খামারে গিয়ে তাকে অনুকরণ করি এবং কয়েক ব্যক্তি এই মহিলার খামার দেখে তারাও খামার তৈরি করেছেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আনিছুর রহমান বলেন, পৌরসভাসহ ১৫ ইউনিয়নে স্বল্পসংখ্যক লোক দিয়ে সকলের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাবুব উর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, অসংখ্য প্রতিকূলতা পেরিয়ে শিবলী আক্তারের যে সফলতা অর্জন তা যুব সমাজের জন্য এবং যারা নিজেদের অসহায় ভেবে হতাশ হন তাদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। আমি তার এবং তারমতো সকল পরিশ্রমী মানুষকে জানাই সাধুবাদ।
×