ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে কিশোর গ্যাং কালচার ॥ খুন ধর্ষণ ছিনতাই বৃদ্ধির শঙ্কা

প্রকাশিত: ১০:১৫, ৩ আগস্ট ২০১৯

  ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে কিশোর গ্যাং কালচার ॥ খুন ধর্ষণ  ছিনতাই  বৃদ্ধির শঙ্কা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মাদকের প্রভাব, শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় না থাকাসহ নানা কারণে দেশে কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখনই কিশোর গ্যাং কালচারের রাশ টেনে ধরতে না পারলে সমাজে ধর্ষণ, খুন, ছিনতাই ও মাদকের বিস্তারসহ নানা ধরনের অপরাধ আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যেতে পারে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়েও ওঠতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও এমনটাই জানালেন। এদিকে কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজে সারাদেশে তৎপরতা জোরদার করার বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে পুলিশ সদর দফতর। নির্দেশনায় গ্যাংয়ের সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার কথা বলা হয়েছে। যারা কিশোর সংশোধনাগার থেকে বের হচ্ছে, তাদের উপর নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে বিশেষ সেই নির্দেশনায়। ইতোমধ্যেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত কিশোর গ্যাংয়ের ২৯ সদস্যকে ছয় মাসের করে কারাদন্ড দিয়ে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠায়। সাজাপ্রাপ্তরা সবাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বলে বিচারকের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এমন ঘটনা নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মোতাবেক, ২০১৫ সালে মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে এক মহিলাকে মোটরসাইকেল দিয়ে পিষে হত্যা এবং ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের কাছে সন্ধ্যায় ট্রাস্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবিরকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। দুইটি ঘটনায় আটজন করে ১৬ জন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং থাকার সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশের নথিপত্র মোতাবেক, ঢাকার প্রায় প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং আছে। তবে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠেছে উত্তরায়। নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজ নামের দুটি কিশোর গ্যাং খুবই সক্রিয় উত্তরায়। এ দুটি গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনায় আদনান নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনটি মারামারি এবং একটি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নাইন স্টার নামের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে খুন হয় আদনান। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, আদনান কবির হত্যায় জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থাকা কিশোর গ্যাং সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রতি কিশোর গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ৩১ জুলাই ঢাকার কাওরানবাজার, ফার্মগেট, রেললাইন বস্তি, শেরেবাংলা নগর থানাধীন কলেজ গেট, শিশুমেলা, শ্যামলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ২৯ সদস্যকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে ইয়াবা, গাঁজা, ব্লেড, চাকু, ছুরি জব্দ করা হয়। আটককৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য। সবাই মাদকাসক্ত। দীর্ঘদিন ধরে তারা রাজধানীর বিভিন্নস্থানে ছিনতাই করে আসছিল। পথচারীদের ব্যাগ, মোবাইল ফোন, মহিলাদের ভ্যানিটিব্যাগ চাকু বা ব্লেড দিয়ে কেঁটে ভেতরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ মালামাল ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। আবার তারা সরাসরি ভ্যানেটি ব্যাগও ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। ছিনতাই করা প্রতিটি মোবাইলফোনের বিনিময়ে তারা মোবাইল ফোনের দাম ভেদে তিন থেকে পাঁচটি করে ইয়াবা পায়। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সারোয়ার আলম আটককৃতদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে কিশোর গ্যাংয়ের ২৯ সদস্যের প্রত্যেককেই ৬ মাসের কারাদ- দেয়। পরে তাদের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিশোর গ্যাং সম্পর্কে সজাগ থাকতে এবং তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সারাদেশের প্রতিটি পুলিশ ইউনিটকে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনায় পুলিশ প্রধান কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতার ছাড়াও তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার কথা বলেন। গত বুধবারও পুলিশ সদর দফতরে ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় পুলিশ প্রধান বলেন, বর্তমানে দেশের কোথাও কোথাও গ্যাং কালচার বা ‘ইয়ুথ গ্রুপ’ গড়ে উঠার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের ভাষ্য মোতাবেক, নানা কারণে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। যার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক কারণ ছাড়াও শিক্ষাগত কিছু কারণও আছে। বিশেষ করে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোররা নানা কারণে শিক্ষা থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হয়। আবার স্কুল থেকেই ঝরে পড়ে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে এসব কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়। প্রথম প্রথম এসব কিশোররা হতাশা ভুলে থাকতে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাদক সেবনের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রায়ই গালমন্দ করেন। একদিকে লেখাপড়া বা স্কুলে যাওয়ার কোন তাড়া থাকে না। তারপর পরিবারের সদস্যদের কাছে গালমন্দ খেতে খেতে তাদের মধ্যে হতাশা পুরোপুরি ভর করে। তারা মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করতে থাকে। পরিবারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আস্তে আস্তে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর মাদক সেবনকালে স্বাভাবিক কারণেই সমবয়সী কিশোরদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক হয়। এরপর তারা নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলছে গ্যাং। এরা মাদকের টাকা যোগাড় করতে ছিনতাই, মাদক বিক্রিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। তারা পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন জায়গায় বসে ইভটিজিং করে। পাড়া-মহল্লায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে একসঙ্গে অনেক কিশোর বিকট শব্দে মোটরসাইকেলের বিকট হর্ন বাজিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই তাদের আশপাশে থাকা বা উচ্চবিত্ত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে চায়। এসব পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মতো নামী দামী স্কুলে পড়াতে চায়। গাড়ি হাঁকিয়ে স্কুলে পাঠাতে চায়। কিছুদিন সেই ধারা ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত তারা টিকতে পারে না। এ সময় তারা ছিটকে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সন্তানদের লেখাপড়াও অধিকাংশ সময় থমকে যায়। পড়াশুনায় ছন্দপতন ঘটায় ওইসব কিশোররাও আস্তে আস্তে পাড়ার বখাটে কিশোরদের সঙ্গে মিশতে থাকে। তারাও আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ে কিশোর গ্যাংয়ে। আর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। পরিবারের অঢেল টাকা থাকায় এবং বড় ব্যবসা-বাণিজ্য থাকায় আগাগোড়াই তাদের পড়াশুনায় মনযোগ কম থাকে। যদিও ব্যক্তিক্রমও আছে। এসব পরিবারের কিশোররা সাধারণত ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করে। ইংরেজী মাধ্যমে নিয়মিত ক্লাস করার রীতি না থাকায় তারা বাড়তি সময় পায়। সেই সময় তারা বন্ধু বা বান্ধবী বা সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। তারা পার্টি করে বেড়ায়। পার্টির আড়ালে চলে মাদকের আসর। এক সময় তারা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এসব পরিবারের অনেক সন্তানদের মধ্যেই ব্যবসা করতে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে, এক ধরনের ধারণা কাজ করে। এই ধারণাই তাদের পড়াশুনার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। আজকের পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় সবাই অর্থবিত্তের মালিক হতে চায়। ফলে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ পিতামাতারা টাকা রোজগারের দিকে বেশি মনযোগী হয়। তারা সন্তানদের তেমন সময় দিতে পারে না। এমন সুযোগে আস্তে আস্তে সন্তানরা সঠিক পথ থেকে ছিটকে পড়তে থাকে। সন্তানদের দিকে সবার আগে পরিবারকে খেয়াল করতে হবে। অন্যথায় কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠার প্রবণতা কমবে না। কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ বলছিলেন, কিশোর গ্যাং পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য রীতিমতো হুমকি সরূপ। কারণ এক সময় কোন কিশোর অপরাধীই বড় ধরনের অপরাধী হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। কোন কোন কিশোরের দুর্ধর্ষ জঙ্গী হয়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। যাদের পক্ষে বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানো কোন বিষয় নাও হতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ কিশোর গ্যাংয়ের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হন। একজন সাধারণ মানুষও অনেক সময় তাদের হাত থেকে রেহাই পান না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতারে খুবই সক্রিয়। এছাড়া সামাজিকভাবে কোথাও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা দেখা গেলে, সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। এতে করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের তৎপরতা কমে যাবে। যদিও অনেক সময় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপরাধমূলক কর্মকা-, এমনকি খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটিয়ে থাকে। সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ব্যাপারে অবহিত করতে হবে। প্রতিটি জায়গায় কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে সতর্ক থাকলে সমাজ থেকে কিশোর গ্যাং কালচার কমে যাবে। সার্বিক বিশ্লেষণে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে গ্যাং সদস্য হওয়ার পেছনে পরিবারের দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ কিশোরই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরে তারাই কিশোর গ্যাং গড়ে তুলে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
×