ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের অভিমত এ বছর বদলে গেছে রোগের ধরন

জটিল হয়ে উঠছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা

প্রকাশিত: ১০:১১, ৩ আগস্ট ২০১৯

 জটিল হয়ে উঠছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা

নিখিল মানখিন ॥ জটিল হয়ে উঠছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা! কিছু বুঝে উঠার আগেই লাইফ সাপোর্টে চলে যেতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। ডেঙ্গুর স্বাভাবিক উপসর্গ দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর ডেঙ্গুর ধরন বদলে গেছে। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরও রোগীর শরীরে থাকা ডেঙ্গু জীবাণুর ধরন বুঝতে সময় লাগছে চিকিৎসকদের। ততক্ষণে রোগীর শরীরে থাকা ডেঙ্গুর জীবাণু দ্রুত আরেক রূপ ধারণ করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আঘাত হানছে রোগীর ব্রেন, হার্ট ও লিভারে। ডেঙ্গুর জীবাণু আগের তুলনায় বেশ শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। জ¦র হওয়ার পর পরই শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছে রোগী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু ঘটছে অনেক রোগীর। এখন জ্বর হলে মানুষ যেমন প্রথমে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ভয় পায়, তেমনি ডাক্তাররাও তা শনাক্ত করে চিকিৎসা করেন। কিন্তু যার ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, তা ঠিক কোন টাইপের ডেঙ্গু, তা শনাক্ত করা হচ্ছে না। ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ ও অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। আক্রান্তের সংখ্যার দিক দিয়ে রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যাও দ্রুত বেড়েই চলেছে। সরকারী পরিসংখ্যানে ডেঙ্গু মৃত্যু সংখ্যা ১৪ জনের কথা বলা হলেও এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক হয়ে গেছে বলে দাবি করছে বেসরকারী সূত্রসমূহ। বিগত ১৮ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রতিবছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। তাই ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কমুক্ত হতে পারছে না দেশবাসী। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় এবং ডেঙ্গু টেস্ট করানোসহ চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকায় এই আতঙ্ক আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। দেশে ডেঙ্গুর ধরনে পরিবর্তন আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর গতি প্রকৃতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালানো দরকার। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধকল্পে জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করেছে সরকার। চিকিৎসা প্রদানের সময় গাইডলাইনটি অনুসরণ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই। বিভিন্ন ধরনের ডেঙ্গুর অবস্থা তুলে ধরে অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ভাইরাসজনিত জ্বর ডেঙ্গু, যা এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম -এই কয়েক ধরনের ডেঙ্গু হয়। ক্লাসিক্যাল বা সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর হয়, যা ১০৪ থেকে ১০৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। জ্বর দুই থেকে সাতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। সঙ্গে মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশি বা গিঁটে ব্যথা, শরীরে র‌্যাশ থাকতে পারে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু হলে তেমন সমস্যা নেই, এতে মৃত্যু সাধারণত ঘটে না। আর ডেঙ্গু হেমোরেজিকে জ্বর কমে যাওয়ার দু-তিন দিনের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল লাল র‌্যাশ বা রক্তবিন্দুর মতো দাগ দেখা যায়। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাড়ি বা নাক দিয়ে আপনা-আপনি রক্তক্ষরণ, রক্তবমি, কালো রঙের পায়খানা, ফুসফুসে বা পেটে পানি জমা ইত্যাদি। রক্ত পরীক্ষা করালে দেখা যায়, রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেটের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি, যাতে শরীর থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের উপসর্গগুলোর পাশাপাশি রোগীর রক্তচাপ হঠাৎ কমে যায়, নাড়ির গতি বৃদ্ধি পায়, হাত-পা শীতল হয়ে আসে, রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের জ্বর হলে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া উচিত। অনেক সময় চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত বা অণুচক্রিকাও দিতে হতে পারে। তবে সবার যে এমন হবে, তা কিন্তু নয়। জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আবদুল্লা বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। ভেক্টর বর্ন ডিজিজ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা এসেন্ডের কান্ট্রি হেড অধ্যাপক ডাঃ বেনজীর আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ডেঙ্গু বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সব ডেঙ্গুই প্রাণঘাতী হয় না। চার ধরনের ডেঙ্গু (ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪) মধ্যে ঠিক কোন ধরনের ডেঙ্গুর প্রকোপ বাংলাদেশে বেশি, তা খতিয়ে দেখা জরুরী। এখন জ্বর হলে মানুষ যেমন প্রথমে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ভয় পায়, তেমনি ডাক্তাররাও তা শনাক্ত করে চিকিৎসা করেন। কিন্তু যার ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, তা ঠিক কোন টাইপের ডেঙ্গু, তা শনাক্ত করা হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু পরীক্ষার পাশাপাশি টাইপিংও করতে হবে। না হলে রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেয়া যাবে না। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ খান আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশসহ বিশে^র অনেক দেশ আজ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এই রোগ প্রতিরোধে জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করেছে সরকার। নানামুখী সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ডেঙ্গুর বিষয়টি এখন মানুষ জানে। তবে এর যে গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন হচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতনতা নেই। অনেক চিকিৎসকেরও এ বিষয়ে ভাল ধারণা নেই। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে সচেতন ও সর্তক থাকলে এবং জ¦র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ক্ষেপণ না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে ডেঙ্গু থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পরামর্শক অধ্যাপক ডাঃ মাহামুদুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর কারণে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হলে তা খুবই বিপজ্জনক। অনেক চিকিৎসকের পক্ষে তা দ্রুত বুঝে ওঠা কঠিন। তাই এ বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। তিনি জানান, চীনে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত তিন হাজার মানুষের ওপর গবেষণার ফলে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ১১ শতাংশ ডেঙ্গু থেকে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হয়েছে। এটি আক্রান্তদের মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। যার প্রভাবে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও বেড়েছে। কখনও খরা, আবার কখনও বা অতিবৃষ্টির ফলে ডেঙ্গু মশার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা অনেক কম। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার আধিক্য রাজধানীতে ডেঙ্গুর এ ধরনের প্রকোপ এক ধরনের বাস্তবতা। প্রত্যেক নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। জ¦র হলে সাধারণ জ¦র মনে না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে হবে। সকল হাসপাতালকেই এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। জ¦র নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। সচেতন থাকলে আতঙ্কের কিছু নেই। আর ডেঙ্গু প্রতিরোধকল্পে সরকারীভাবে তৈরিকৃত জাতীয় গাইড মেনে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ দেন মহাপরিচালক।
×