ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে

ঈদে সারাদেশে ভয়াবহ মাত্রায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ১০:১০, ৩ আগস্ট ২০১৯

 ঈদে সারাদেশে ভয়াবহ মাত্রায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঈদ সামনে রেখে সারাদেশে ভয়াবহ মাত্রায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সবাই ঢাকা থেকেই নিজ এলাকায় গেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবার ঈদ সামনে রেখে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরে যাবেন। আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এর মাধ্যমে সারাদেশে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ কারণে তারা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে, সবাইকে নিশ্চিত হয়ে বাড়ি ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন। যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের নিজ এলাকায় সাবধানে থাকতে বলেছেন। বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যেন অন্য কোন মশা কামড় না দেয় সেদিকেই সতর্ক থাকতে হবে। অন্য মশা কামড় দিলে সেই মশা যদি আবার অন্যজনকে কামড় দেয় তাহলেও তিনি আক্রান্ত হয়ে পড়বেন। এদিকে ঢাকার পাশাপাশি রাজধানীর বাইরেও প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের শুক্রবারের হিসাব অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় এবার আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৮৭ জনে। এর মধ্যে রাজধানীর বাইরে নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে ৬৯১ জন। জানা গেছে, ঈদ সামনে রেখে অনেকেই এখন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। এর মধ্যে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের অনেকেই ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন মূলত ঢাকায় চিকিৎসা ও অর্থের সঙ্কুলান না হওয়ার কারণে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ খবরে জানানো হয়েছে সারাদেশে এখন পর্যন্ত সর্বমোট ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ২১ হাজার ৩৫৫ জন। এর মধ্যে নতুুন করে কারো মৃত্যু হয়নি বলে তারা জানিয়েছে। তবে মুন্সীগঞ্জ থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, শুক্রবার ভোর ৫টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আনোয়ার হোসেন (৪০) নামে এক মানবাধিকার কর্মী ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে মারা গেছেন। এ ছাড়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শারমিন নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন। এছাড়া হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম বলছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া ১৪ হাজার ৬৩৯ জন সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়েছেন। ৬ হাজার ৫৮২ জন এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে। ঢাকার বাইরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ১৯০ জনের। এর মধ্যে হাসপাতালে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১ হাজার ৯৬৯ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ২ হাজার ২২১ জন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোরবানি ঈদকে সামন্যে রেখে ডেঙ্গুর ভাইরাস সারাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী ১২ আগস্ট পালিত হবে দেশব্যাপী পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। ঈদ পালনে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ লাখের বেশি মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাবেন। এর মধ্যে যারা আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন তারা এই যাত্রায় শরিক হবে। তাদের মাধ্যমে এই ভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ডেঙ্গু আক্রান্ত বাহক অন্য জায়গায় ভ্রমণ করার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অন্যত্র ভ্রমণ করে সেখানে তাকে কোন মশা কামড়ালে সেই মশার ভেতরও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। সেই মশা পরে যাদের কামড়ায় তাদের শরীরের ডেঙ্গুরোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবাব ঈদে যারা ঘরে ফিরবেন তাদের অনেকেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। এ কারণেই এটির সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মেহেরজাদী সব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ঢাকা থেকে যারা যাবেন, তাদের মধ্যে একটা অংশ কোন না কোনভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। এদের মধ্যে কারো হয়তো জ্বর থাকতে পারে। আবার কারো হয়তো জ্বর নেই কিন্তু পরে জ্বর হতে পারে। এটা প্রতিরোধে, কারও যদি জ্বর থাকে তাহলে তিনি যেন ভ্রমণ না করেন। জ্বর থাকলে যেন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে এটা ডেঙ্গু কিনা। তিনি বলেন, আবার কারো হয়তো জ্বর হয়নি কিন্তু ইনফেকশন শরীরে ঢুকে গেছে। জ্বর না হওয়ায় তিনি বুঝতে পারেননি। তিনিও হয়তো চলে যাবেন। এইভাবে ভাইরাস দেশের অন্য অঞ্চলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থা ও ব্যক্তি ডেঙ্গু নির্মূলে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তারা যদি সারাদেশের এডিস মশার প্রজননগুলো সময়মত ধ্বংস করতো তা হলে এ মশার বংশ বিস্তার নষ্ট হয়ে যেত। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ডাঃ কাজী রকিবুল ইসলাম বলেন, আসন্ন ঈদে ঘরে ফেরা মানুষদের কথা মাথায় রেখে ঢাকার বাইরের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করণ ও সঠিক চিকিৎসা প্রদানের প্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়টি স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগকে অতি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য এ সকল স্থানে এডিস মশা নিধন কার্যক্রম অভিযান পরিচালনা করার এখনই সময়। ডাঃ এম এইচ লেলিন চৌধুরী বলেন, মেয়রদের দায়িত্বহীনতার কারণে সারাদেশে এ রোগের বিস্তার লাভ করেছে। সারাদেশ আজ আতঙ্কগ্রস্ত ডেঙ্গুর ভয়ে। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যাও গোপন করা হচ্ছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে মশার জীবাণু ও লার্ভা ধ্বংস করার কার্যকরী ওষুধ আমদানি করার দাবি জানান, সঙ্গে সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীসহ দেশের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মশার স্থান পরিষ্কার করারও আহ্বান জানান। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর : ফরিদপুর ॥ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুরে মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে মারা গেলেন তরুণী শারমীন (২২)। বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান তিনি। শারমীন মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট এলাকার মোঃ রুবেলের মেয়ে। ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কামদা প্রসাদ সাহা জানান, গত ২৮ জুলাই রবিবার শারমীন টেকেরহাটস্থ নিজ বাড়িতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান তিনি। এদিকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত ২০ জুলাই থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ১০৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জন ফরিদপুরে অবস্থানকালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন ২১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় এ হাসপাতালে আরও ১৯ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে একজন ফরিদপুর শহরে অস্থানকালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। শুক্রবার ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৮৩জন। রাঙ্গামাটি ॥ এ পর্যন্ত ৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ শহীদ তালুকদার বলেছেন, রাঙ্গামাটিতে ৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হলেও এর মধ্যে ৪ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় চলে গেছে। ডেঙ্গু শনাক্ত করার জন্য রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসরসহ একটি টিম গঠন করা হয়েছে। যারা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের বিনামূল্যে সব পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত না হওয়ার জন্য সচেতনমূলক ব্যানার, লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানান। লক্ষ্মীপুর ॥ দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে লক্ষ্মীপুরে। গত ৭ দিনে শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ৪০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২০ জন ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে ৫ জন মহিলার মধ্যে ৪ জনই স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছে বলে রোগী এবং রোগীর লোকেরা জানান। রাজশাহী ॥ রাজশাহীতে এবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক। তিনি এখন চিকিৎসাধীন। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ এএফএম আঞ্জুমান আরা বেগম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক দাফতরিক কাজের জন্য ঘন ঘন রাজশাহী-ঢাকা যাতায়াত করছিলেন। এরইমধ্যে হঠাৎ তিনি অসুস্থ বোধ করেন। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণও অনুভব করেন। এ অবস্থায় তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। গোপালগঞ্জ ॥ এ পর্যন্ত ২৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ২২ জন ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য-কমপ্লেক্সে ২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ৯ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন। মাগুরা ॥ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত এই নিয়ে ডেঙ্গুরোগে আক্রান্ত ৯ জন মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ পরীক্ষিত পাল জানান, আজ উজ্জ্বল হোসেন নামে একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। টাঙ্গাইল ॥ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নতুন করে আরও ৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে মোট ৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। মাদারীপুর ॥ ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৮ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়ে শুক্রবার বেলা ১২টা পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৪৮ জনে। এদের মধ্যে মাদারীপুর সদর হাসপাতাল, শিবচর, কালকিনি ও রাজৈর উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি আছে ১৫ জন। বরিশাল ॥ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত শেবাচিমে হাসপাতালে ১১৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বৃহস্পতিবার এ সংখ্যা ছিল ৭৯ জন। হাসপাতালের হিসেব অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৪৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু রোগীদের সুবিধার্থে হাসপাতালে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। এদিকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী মোঃ ইসরাইল হোসেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শেবাচিম হাসপতালে ভর্তি হয়েছেন। মানিকগঞ্জ ॥ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৬ জন। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত ৭ জন রোগী মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা ডাঃ লুৎফর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
×