ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বনের খালে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার ॥ হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ৩ আগস্ট ২০১৯

 বনের খালে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার ॥ হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর কারফারমা ও চর আগুনমুখার বনাঞ্চলের অভ্যন্তরের খাল এবং শাখা খালগুলোতে মাছ ধরার নামে চলছে যথেচ্ছাচার। কয়েক প্রভাবশালীর নেতৃত্বে খাল-শাখা খালে বাঁধ দেয়া থেকে শুরু করে কীটনাশক ছিটানোসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চলছে অবাধে মৎস্য শিকার। এর সঙ্গে বন বিভাগের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মচারী জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, মাছ ধরার সুযোগ দেয়ার নামে প্রভাবশালীরা নিরীহ মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এভাবে মাছ ধরার কারণে একদিকে যেমন বনাঞ্চলের এবং বিভিন্ন ধরনের মৎস্য প্রজাতির ক্ষতি হচ্ছে। তেমনি জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া, কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরার কারণে তা মানবদেহের জন্য বড় ধরনের শঙ্কার সৃষ্টি করেছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও বন বিভাগের দায়িত্বশীলরা এ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গলাচিপা উপজেলার সদর ইউনিয়ন ও রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের অংশবিশেষ নিয়ে আনুমানিক ৬০-৭০ বছর আগে উত্তাল আগুনমুখা ও রামনাবাদ নদী ঘিরে জেগে ওঠে পাশাপাশি দুটি বিশাল দ্বীপ। যা সরকারী কাগজপত্রে চর আগুনমুখা ও চর কারফারমা নামে পরিচিত। জেগে ওঠার পরবর্তী সময়ে দ্বীপ দুটিতে বনাঞ্চল গড়ে তোলা হয়। গলাচিপা বন বিভাগের তথ্যে বলা হয়েছে, দ্বীপ দুটিতে ২০ হাজার একরেরও বেশি বনাঞ্চল রয়েছে। ১৯৮৩ সাল থেকে বন বিভাগ এতে বনায়ন শুরু করে। ২০০৭ সালে বনাঞ্চলটিকে ‘সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। একই বিভাগের তথ্যে আরও বলা হয়েছে, দ্বীপ দুটির বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০ টিরও বেশি খাল রয়েছে। বাস্তবে খাল ও শাখা খালের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এ বনাঞ্চলের বাইরে দ্বীপ দুটিতে কয়েক শ’ পরিবারের বসবাস রয়েছে। যাদের অধিকাংশের পেশা নদী ও খালে মাছ ধরা। সারা বছর তাদের জীবন কাটে ঝুঁকি নিয়ে। আর এ মৎস্যজীবীদের আয় রোজগারকে কেন্দ্র করেই প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে দ্বীপ দুটিতে চলছে যথেচ্ছাচার। সরেজমিনে দেখা গেছে, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের অভ্যন্তরের খালগুলোর সঙ্গে সাগর ও নদীর সরাসরি সংযোগ রয়েছে। যার ফলে সাগর ও নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ক্ষুদ্র রেণু পোনা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে খালগুলোর দু’পাশের বনাঞ্চলের শেকড়ের মাঝে আশ্রয় নেয়। এখানেই এসমস্ত রেণু পোনা বড় হয়ে ওঠে। এ সুবাদে দ্বীপের বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে খালগুলোতে নানা কায়দায় চলছে মাছ শিকার। সরেজমিন অনুসন্ধানকালে লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত লোকজন বনের গহীনে গা ঢাকা দেয়। এক পর্যায়ে এক জেলে বন থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি নিজের নাম মিলন মোল্লা (৪৫) এবং গলাচিপার সদর ইউনিয়নের পক্ষিয়া গ্রামে বাড়ি বলে জানান। বনের খালে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরার অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে মিলন মোল্লা বলেন, প্রতি বছরই আড়তদাররা বন বিভাগ থেকে খালগুলো লিজ নিয়ে তাদের দিয়ে মাছ ধরায়। মাছ ধরার কাজে যারা অংশ নেয় তারাও একটা ভাগ পায়। এবছর এখন পর্যন্ত মাছ ধরার লিজ দেয়া হয়নি। তবে বন বিভাগের কয়েকজন লোক মাছ ধরার বিষয়টি জানেন এবং তাদেরকেও মাছের একটি ভাগের অংশ দিতে হয় বলে জানান তিনি। তবে এর সঙ্গে কারা জড়িত তাদের নাম বলতে অস্বীকৃতি জানান এই জেলে। বনাঞ্চলের খাল লিজ দেয়া, কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরা, খালে বাঁধ দেয়াসহ এ সমস্ত অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে বন বিভাগের লোকজন কোনক্রমে জড়িত নয়, দাবি করে বন বিভাগের গলাচিপা বীট অফিসার ছিদ্দিকুর রহমান জানান, বাঁধ দিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি জানার পর তারা সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে বনাঞ্চলের অভ্যন্তরের ১২টি খালের বাঁধ কেটে দিয়েছেন। বন বিভাগের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি আরও দাবি করেন, বাঁধ কেটে দেয়ার কারণে মৎস্যজীবীরা বন বিভাগের লোকজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে। এ বিষয়ে পটুয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, জোয়ার-ভাটার খাল দিয়ে পানি ওঠা-নামা করে। ম্যানগ্রোভ বনের মূল প্রাণ পানি। তাই বনের খালে কোনভাবেই বাঁধ দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে বন বিভাগ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে কয়েকটি খালের বাঁধ কেটে দিয়েছে। বন বিভাগের কেউ যদি এ কাজে জড়িত থাকে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×