ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঝিনুকে মুক্তা চাষে সফল দুই যুবক

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ৩ আগস্ট ২০১৯

ঝিনুকে মুক্তা চাষে সফল দুই যুবক

দেশের জলবায়ু মুক্তা চাষ উপযোগী। বাংলাদেশের শীতকাল দীর্ঘ নয় এবং সারা বছরই উষ্ণ আবহাওয়া বিদ্যমান থাকায় তা ঝিনুক বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের অনুকূল। আমাদের দেশে জলাভূমিতে মাছ চাষের সঙ্গে মুক্তা চাষ সম্ভব। মুক্তা চাষ ব্যয়বহুল কিংবা কঠিন নয়। মুক্তা শৌখিনতা ও আভিজাত্যের প্রতীক। মুক্তা অলংকারে শোভিত অতি মূল্যবান রত্ন। মুক্তার প্রধান ব্যবহার অলঙ্কার হলেও কিছু কিছু জটিল রোগের চিকিৎসায় এবং ওষুধ তৈরিতে মুক্তা ও মুক্তাচূর্ণ ব্যবহার হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, মুক্তা ধারণে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। এছাড়া মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের খোলস নানা ধরনের অলংকার ও শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরি এবং ক্যালসিয়ামের একটি প্রধান উৎস-যা হাঁস-মুরগি, মাছ ও চিংড়ির খাদ্যের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের মাংস মাছ ও চিংড়ির উপাদেয় খাদ্য হিসেবেও ব্যবহ্নত হয়। অনেক দেশে ঝিনুকের মাংস মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহ্নত হয়। বাংলাদেশের মিঠাপানির জলাশয় মুক্তা বহনকারী ঝিনুকে পরিপূর্ণ। জলবায়ুও মুক্তা চাষের উপযোগী। প্রায় ১০ মাস উষ্ণ আবহাওয়া থাকায় ঝিনুকের বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের পরিবেশও অনুকূল এখানে। চীন, জাপান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্যান্য দেশে প্রণোদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদন এবং চাষ করা হয়ে থাকে। চীন ও জাপান দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক গবেষণায় মুক্তা চাষে পেয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বাংলাদেশও প্রণোদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদনে সফল হয়েছে। মুক্তা চাষ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প। উত্তরবঙ্গের স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষ এখন স্বপ্ন নয়। আজ তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তাই এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাছের পাশাপাশি একই সঙ্গে চাষ করা হচ্ছে ‘মুক্তা’। উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় সেলিম আল মামুন বাবু ও জুলফিকার রহমান বাবলা নামের দুই যুবক স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের দ্বার উন্মোচন করে এরই মধ্যে সফলতা নিয়ে এসেছেন। পরীক্ষামূলক প্রকল্প হলেও এরই মধ্যে মুক্তা আহরণে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন তাঁরা। তাদের সফলা দেখে এলাকার অন্যান্য বেকার যুবকেরাও ঝুঁকছেন এ পেশায়। যে পুকুরে মাছ চাষ করেন, সেই পুকুরেই তারা মুক্তা চাষ করছেন। এই যুবকরা বললেন, মুক্তা এমন একটি রত্ন, যাকে পেতে হলে ঝিনুককে যত্ন করতে হয়। তাঁরা জানান, মুক্তা চাষের জন্য প্রয়োজন কিছু সরঞ্জাম। এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছেম ঝিনুক অপারেশনের কিটবক্স, দুই ধরনের নেট বক্স ও ইমেজ তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রপাতি। সাধারণত ১৮ থেকে ২০ মাস বয়সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ইমেজটি স্থাপন করা হয় ঝিনুকের পেটে। এরপর দুই থেকে আড়াই ফুট পানির নিচে ডুবিয়ে রাখা হয় ঝিনুকগুলোকে। এভাবে ২১ থেকে ২৮ দিন রাখার পর সেগুলোকে উন্মুক্ত করা হয় পুকুরে। এরপর আজ থেকে ১০ মাসের মধ্যে স্থাপিত ইমেজটি মুক্তায় পরিণত হয়। সবশেষে পুকুর থেকে ঝিনুক তুলে আহরণ করা হয় মুক্তা। ঝিনুক সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিটি মুক্তা আহরণ পর্যন্ত খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা। আর প্রতিটি প্রমাণ সাইজের ঝিনুকের বাজার দাম প্রায় পাঁচহাজার টাকা। ঝিনুক অপারেশনের বিষয়ে তারা জানায়, মুক্তা চাষের জন্য অস্ত্রোপচার অনেকটা সূচি কাটার মতো। ঘরে বসে যেমন কাপড় সেলাই করা যায়, তেমনি ঝিনুককে অস্ত্রোপচারও ঘরে বসেই করা যায়। খুব অল্প খরচে সরঞ্জাম কেনা যায়। ধৈর্য ধরলে ভাল মুক্তা মেলে, লাভ পাওয়া যায়। মুক্তা চাষের বিশেষ দিক হলো, ঝিনুককে বাড়তি খাবার দিতে হয় না। ঝিনুক নিজে থেকেই খাবার নিয়ে নেয়। উল্টো পুকুরের পানি মাছ চাষের জন্য উপযোগী করে তোলে ঝিনুক। ডোমার উপজেলার সোনারায় ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের জামিরবাড়ী চাকধাপাড়া গ্রামের তমিজ উদ্দিনের ছেলে সেলিম আল মামুন বাবু ও একই ইউনিয়নের হাজিপাড়া গ্রামের কাশেম উদ্দিনের ছেলে জুলফিকার রহমান বাবলা। বাবুর রয়েছে ৫৭ শতকের জলাশয়ে মাছ চাষের প্রকল্প। আর বাবলা রয়েছে ৯০ শতক জমিতে মাছ চাষের প্রকল্প। তাঁরা দীর্ষদিন ধরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদন করে আসছে। এই দু’জনে ২০১৮ সালে জুন মাসে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ নেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই)। প্রশিক্ষণ শেষে তারা মুক্তা চাষে নেমে পড়ে। এক বছরের মাথায় চলতি জুনে ঝিনুক থেকে মুক্তা আহরণ শুরু করে সফল দুই উদ্যোক্তা। তাঁরা প্রতি শতক জমিতে (জলাশয়ে) ৬০ থেকে ৭০টি ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। এখানে প্রতিটি দেশি ঝিনুকে একটি করে মুক্তা উৎপাদন করা হয়েছে। জুলফিকার রহমান বাবলা বলেন, স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের জন্য তিনদিনের প্রশিক্ষণ পেয়ে স্থানীয়ভাবে ঝিনুক ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে মুক্তা চাষে নেমে পড়ি। ৫০ হাজার ঝিনুক সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়েন বাবলা। সেখান থেকে ৬০০টি ঝিনুকে মুক্তা চাষে সফল হয়েছেন তিনি। জানা যায়, বাংলাদেশে স্বাদু পানিতে প্রথমবারের মতো মুক্তা চাষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহসেনা বেগমের নেতৃত্বে একদল গবেষক। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্বাদু পানির ঝিনুকে মুক্তা চাষ শীর্ষক প্রশিক্ষণ চালু করা হয়। ড. মোহসেনা বেগম তনু জানান, ঝিনুকের ম্যান্টলের নিচে একটি ইমেজ প্রবেশ করিয়ে দিলে সেই ইমেজের ওপর মুক্তার একটি প্রলেপ পড়ে যা দেখতে খুবই সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। মুক্তার প্রলেপযুক্ত এই ইমেজকে ইমেজ মুক্তা বলা হয়। মুক্তা চাষ গবেষণা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এরই মধ্যে তারা ইমেজ মুক্তা(চ্যাপ্টা আকৃতি) উৎপাদনে সফল হয়েছেন। ইমেজ মুক্তা উৎপাদন প্রযুক্তি তুলনামূলক সহজ এবং বাণিজ্যিকভাবে করা সম্ভব। কিন্তু দেশীয় ঝিনুকের আকার ছোট হওয়ায় বড় ও সুন্দর আকৃতির মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় মুক্তা চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য বিশ্বের মুক্তা উৎপাদনকারী দেশসমূহ থেকে উন্নত প্রজাতির ঝিনুক আনা প্রয়োজন বলে মনে মোহসেনা বেগম। বিএফআরআইয়ের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফেরদৌস সিদ্দিকী বলেন, ২০১২ সালের দিকে স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। যেহেতু আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে ঝিনুক পাওয়া যায় এবং তাপমাত্রা ১০ মাস উষ্ণ থাকে সেদিক থেকে মুক্তা চাষের জন্য তা খুবই উপযোগী। বিএফআরআই থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে আট থেকে ১০ জন সফলভাবে প্রথম পর্যায়ে মুক্তা উৎপাদন করছেন। সেটির বাজার সৃষ্টির জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, দেশের বাইরে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ইমেজ মুক্তার ডিমান্ড রয়েছে। আমাদের দেশেও অভিজাত শ্রেণী দাম দিয়ে মুক্তা কিনছে। জুয়েলারি দোকানে মুক্তা বিক্রি হচ্ছে। ফার্মারদের সঙ্গে বায়ারদের যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। সরকার এ বিষয়ে এগিয়ে এলে কৃষক উপকৃত হবে, দেশ এগিয়ে যাবে এবং নতুন একটি শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে মুক্তা চাষ পদ্ধতি মৎস্য অধিদফতরের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশে বর্তমানে তিন ধরনের মুক্তা চাষ হচ্ছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীসহ অনেক চাষী মুক্তা চাষ শুরু করেছেন। তবে উৎপাদনের পর মুক্তা বাজারজাতের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারজাত না করতে পারলে চাষীরা মুক্তা চাষে উৎসাহ হারাবেন। -তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×