ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জান্নাতুন নিসা

পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ৩ আগস্ট ২০১৯

 পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা

পৃথিবী তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা হারিয়ে উষ্ণ থেকে উষ্ণতম হয়ে উঠছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষও নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলীয়তা এবং ঋতু বৈচিত্র্যতা হারিয়ে উষ্ণায়নের পথে পা বাড়াচ্ছি সন্তর্পণে। অবাক হলেও সত্যি, আমরা বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গত দশ বছরে এগিয়েছি বহুগুণ; স্বাধীনতার সুবর্ণ-জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একথা অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বীয়-হস্তক্ষেপে দেশের প্রতিটি কাজ সুনিপুণ দক্ষতায় সম্পন্ন করছেন। সরকারের এত সুসম্পন্ন কাজের ভিড়ে আমাদের কিছু অসম্পূর্ণ কাজ গোটা দেশকে যে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে, তা কী আমরা বুঝতে পারছি! আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ আমরা দেশব্যাপী বহুতল ভবনের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছি। বিশাল এই ইমারতের প্রতিটি খাঁজে আমাদের নিঃশ্বাস আটকে পড়ছে। আমরা কী ভেবে দেখেছি, আমাদের দেশের বর্তমান আবহাওয়া কতটা বিরূপ হয়ে উঠেছে! এর ফল কী মোটেও ভাল হবে? নাকি হুমকিস্বরূপ এসে দাঁড়াবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে! আমাদের সাধারণ মানুষের ভাববার সময় নেই এ বিষয়ে। আর যারা সাধারণের ভিড়ে একটু অসাধারণ হয়ে উঠছেন তারা সবাই উপার্জন বাড়াতে ব্যস্ত; কারণ, সন্তানদের ভালমানের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে, সামাজিকতা রক্ষা করতে হবে, অট্টালিকায় বসে টাকার পাহাড় গড়তে হবে, রাজনৈতিক শামিয়ানায় মুন্সিয়ানার জোর দেখাতে হবে আর একসময় উন্নত দেশগুলোর নাগরিকত্ব পেতে হুমড়ি খেয়ে আদাজল খেয়ে লেগে পড়তে হবে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে-এদেশের আর কিছু হবে না! প্রবাসী হয়ে ওঠলে-ধুলো-ময়লা-গরমে বাংলাদেশ একেবারে অসহ্য! তবুও তো আমার দেশ, ভালোবাসি তাকে- এসব বুলি আওড়িয়ে দেশপ্রেম জাহির করার উন্নাসিকতায় ন্যস্ত। আমরা কী দেখছি না সুজলা-সুফলা-শষ্য-শ্যামলা ষড়ঋতুর দেশ এই বাংলাদেশ দিনকে দিন তার ঋতু বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছে। ষড়ঋতুর আমেজ আর এখন নেই। প্রাণচঞ্চলা প্রতিটি ঋতু তার নিজের রং-রূপ-গন্ধ হারিয়ে কেমন যেন অচেনা-অজানা হয়ে উঠছে। গ্রীষ্ম তার দাবদাহ ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টিস্নাত বর্ষার গায়ে, শরৎ তার শুভ্রতা হারিয়ে হেমন্তের বুকে লুটিয়ে পড়ছে আর তাই শীতের বুড়িও তার হিমেল হাওয়ার চাদরে জাপটে ধরছে ঋতুরাজ বসন্তকে। এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই আমরা ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবো। আমরা উষ্ণতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রকৃতির বহুমূখিতা হারিয়ে ফেলবো। ফলসরূপ বন্যা-খড়া-নদী ভাঙনের সঙ্গে গড়ে ওঠবে আমাদের নিদারুণ সখ্য! সেই সখ্যের হাতছানি হতে দূরে থাকার অভিপ্রায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে যে কোন নতুন প্রকল্প গ্রহণকালে প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টি ও তা সংরক্ষণসহ দেশের নাগরিকদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব কর্মস্থলে ও বাসস্থানে অধিক হারে বৃক্ষরোপণের আহ্বান জানিয়ে সন্তানদেরও এই পরিবেশবাদী কাজ শেখানোর প্রতি গুরুত্বারোপের কথা বলেন। আমরা ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’, ‘গ্রীন হাউস গ্যাস’ এই শব্দগুলো নিয়ে ছোটবেলা থেকেই অনেক কিছু পড়ে আসছি। যার মূলকথা- পরিবেশ দূষণ এবং গাছপালা কাটার ফলে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে ফলে সূর্য থেকে তাপ বিকিরিত হয়ে পৃথিবীতে আসার পর যতটা আবার পৃথিবীর বাইরে বিকিরিত হওয়া উচিত তা হচ্ছে না ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ এ বিষয়টি নতুন কিছু নয়! কারণ, প্রায় ১০০ বছরেরও আগে বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস বলেছিলেন, ‘মানুষ যে হারে খনিজ জ্বালানিকে ব্যবহার করছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে’। যেহেতু সেসময় পরিবেশ সচেতনতার কোনো ধারণা ছিল না তাই তখন তাঁর কথায় কেউ গুরুত্ব দেননি। না কোন সমাজসেবক, না কোন রাষ্ট্রনায়ক এমনকি তৎকালীন বিজ্ঞানীরাও! তারা তখন পার্থিব সম্পদগুলোকে মানবসভ্যতার উন্নয়নের কাজে লাগানোয় ব্যস্ত ছিলেন। বিশ শতকের তিন এবং চারের দশকে যখন সারা পৃথিবীতে শিল্পের জোয়ার বয়ে চলছে এবং পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব আরোপ করতে মহাযুদ্ধ হচ্ছে তখন প্রথমবারের মতো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করলেন সম্ভবত পৃথিবীর উষ্ণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’, ‘গ্রীন হাউস গ্যাস’ সবই বর্তমান পৃথিবীর বহুল চর্চিত বিষয়! কিন্তু যে বিষয়গুলো নানা বিতর্কের নিচে সযত্নে চাপা পড়ছে তা হলো- এ বিষয় নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির সূক্ষ্ম কূটকৌশল। যেহেতু প্রতিটি দেশের সরকার নিজেদের টিকিয়ে রাখতে দেশের শিল্প এবং বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর ওপর প্রচন্ড নির্ভরশীল তাই ধনী বাণিজ্যিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে দেশগুলো অবচেতনভাবেই পৃথিবীর বিপদ ডেকে আনছে। সাধারণ মানুষের অজ্ঞাতে চলছে ট্রাপিজের মন-মাতানো যত খেলা। অথচ শিল্প মানেই তো কেবল বৃক্ষ নিধন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি নয়! গ্রীন হাউস প্রভাব, ওজোন স্তরের ক্ষয়, বৃক্ষ নিধন প্রভৃতি কারণে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত প্রায় ৮০০০ বছর ধরে এই তাপমাত্রা প্রায় স্থির ছিল। কিন্তু গত প্রায় ১২০ বছরের হিসেবে এই তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত ১০০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫°C বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন-২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.৫°C-২.০°C পর্যন্ত এবং ২১০০ সালের মধ্যে ১.৮°C থেকে ৬.৩°C এর মতো বৃদ্ধি পেতে পারে। পৃথিবীজুড়ে উষ্ণতার এই ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিকেই বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং (Global Warming) নামে অভিহিত করেছেন। আরহেনিয়াসের আশঙ্কায় মাত্র কিছু বিজ্ঞানীর একমত হতে বেশ অনেকটা সময় লেগেছিল। আর বর্তমানে আমরা একমত হয়েও হাত গুটিয়ে যাচ্ছি সন্তর্পণে! হাত গুটিয়ে যাচ্ছি বলতে আমরা খুব সহজেই বিষয়টি দেশের এবং রাষ্ট্রের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচছি যেন। অথচ এই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে গিয়ে আমরা একটিবারের জন্যও ভাবছি না আমার কী কোন অংশগ্রহণ নেই দেশ গড়ার যাত্রায়। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষায় আমাদের কী কোন ভূমিকা নেই? নাকি আমরা ভূমিকাবিহীন সম্প্রসারিত ভাব হয়ে দিনাতিপাত করব; আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাব যাপিত জীবনের অর্থহীন সারাংশ! সরকার কিংবা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা তাদের নিয়মতান্ত্রিক কাজ বরবেন দেশের উন্নয়নে। বনায়নের পাশাপাশি আমাদের কিছু ছোট ছোট সচেতনতা হয়ত ভবিষ্যত পৃথিবীকে উষ্ণায়নের কবল থেকে বাঁচাতে একটু হলেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। উষ্ণায়নের বুকে ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতে বৃক্ষরোপণের বিকল্প কোন কিছুই নেই; সেইসঙ্গে আমাদের কিছু কিছু আচরণের পরিবর্তন ভবিষ্যত প্রজন্মকে দিতে পারবে একটি সুন্দর, নির্মল ও নৈসর্গিক পৃথিবী। আমরা প্রায়ই দিনে কিংবা রাতে গ্যাসের চুলা জালিয়ে রাখি। গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখার কারণে প্রথমত তাপ নির্গত হয় দ্বিতীয়ত গ্যাস পুড়ে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেন নির্গত করে তা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। ডিওডরেন্ট, পারফিউম, এরোসল কেনার সময় অবশ্যই CFC FREE দেখে কেনা উচিত। এয়ার কন্ডিশনার আমাদের ঠিক যতটুকু দরকার ততটুকুই ব্যবহার করা উচিত। কারণ এয়ার কন্ডিশনার একটি নির্দিষ্ট স্থানের তাপ শোষণ করে এবং বিদ্যুত শক্তিকে তাপ শক্তিতে রূপান্তর করে। বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, বেবিট্যাক্সি ইত্যাদি পেট্রোল বা ডিজেলচালিত যানবাহন পরিবেশে বিপুল পরিমাণ মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করে। গবেষণায় দেখা যায়- বায়ুমন্ডলে মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৫ গুন বেশি তাপ আটকে রাখে। এক্ষেত্রে এসব যানবাহনের চেয়ে দূষণমুক্ত বা পরিবেশ কম দূষিত করে এরকম যানবাহন ব্যবহার করা উচিত। টিউবলাইট, সাধারণ বাল্ব এরকম উচ্চতাপ সৃষ্টিকারী বাতি ব্যবহার না করে এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া আমাদের বিদ্যুত ব্যবহারে অবশ্যই সচেতন হতে হবে, কারণ বিদ্যুত উৎপাদনেও বিপুল পরিমাণ কয়লা/গ্যাস পোড়াতে হয়। যা পরিবেশে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস-অক্সাইড নির্গত করে। তাই ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকিউম ক্লিনার, গ্রিন্ডার, হিটার ইত্যাদির পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া যেসব যন্ত্রপাতি তাপ উৎপাদন করে যেমন ডেক্সটপ কম্পিউটার, ফ্রিজ, পারসোনাল কুলার ইত্যাদি ব্যবহারে সাবধান হতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রিডের বিদ্যুত ব্যবহারের চেয়ে সৌরশক্তি ব্যবহার করলে পরিবেশের উপকার হয়। আমাদের ছোট ছোট অসচেতনতার ব্যাপক মূল্য দিতে হচ্ছে পরিবেশকে। আমাদের অসচেতনতার কারণে বিগত ১০-১২ বছরে জলবায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৪২% আমাদের পরিবেশ রক্ষায় আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের সাধারণ মানুষের ছোট ছোট আচরণের পরিবর্তন যদি আমাদের পৃথিবীকে এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দূরে রাখে তাহলে কেন আমরা নিজেদের একটু পরিবর্তন করব না? আজ নয়তো কাল আমরা নিজেদের হয়তো পরিবর্তন করব; কিন্তু ততদিনে যেন খুববেশি দেরি হয়ে না যায়, সেই কারণে আমাদের সচেতনতার এখনই সময় বৈকি! লেখক : সাংবাদিক
×