ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জ্ঞানেশ মন্ডল

গল্প ॥ চোরাবালি মন

প্রকাশিত: ১২:২১, ২ আগস্ট ২০১৯

গল্প ॥ চোরাবালি মন

পাড়ান্তরে ছুটে চলে রাবেয়া। রোদ-বৃষ্টি মাথায় তার নিরন্তর এ ছুটে চলা। ছোটার পথে হাঁক পেড়ে যায়, ‘লাগবে ুুুু... সুহাসিনী দাঁতের মাজন... নিমটুথ পাউডার...।’ দেশীপণ্যের সমাহার। গাছগাছড়ার নির্যাস দিয়ে তৈরি। বিক্রয় বাট্টার ওপর শ্রমের লাভ লোকসান। বিক্রয় কম হলে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সে সময় অভাব হাতছানি দিয়ে ডাকে। রাবেয়ার সঙ্গে আরও পাঁচটি মেয়ে আছে। এ নগ্ন পদ-যাত্রার সহযাত্রী। রুবিনা, শিপ্রা, চন্দনা, ও শান্তা। যত বিক্রয় তত ব্যবসা। যে জন্য ছোটাই জীবন। প্রতিদিনকার মতো স্টোর থেকে মালতুলে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে যায়। চৌরাস্তার মোড় থেকে যে যার মত শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তবে বস্তি-মহল্লার দিকেই ওদের শ্যেনদৃষ্টি। পাড়ায় পাড়ায় চিরুনি তল্লাশির মতো ওরা-খদ্দের ধরে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম। চলার পথে তাই থমকে দাঁড়িয়ে যায় কখনও। পথের ক্লান্তি, শিথিল হয়ে আসে চলারগতি। সন্ধ্যা ঘনালে আঁধার নামে। অক্লান্ত পদভারে ওরা ছুটন্ত বাসের কিউ ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলে যে যার-মতো গন্তব্যে ফিরে যায়। এর মধ্যে রাবেয়ার গতিপ্রকৃতি একটু ভিন্ন ঘরনার। সহজেই খদ্দের আকৃষ্ট করার কৌশল রাখে রাবেয়া। রাত দশটার পর সাধারণত পাড়া-মহল্লার পুরুষ ছেলে বড় একটা ঘরে কেউ থাকে না। যে যার মতো বাইরে বেরিয়ে গেলে, সর্বত্র মেয়েদের রাজত্ব। রাবেয়া বাগচাতুর্য পটিয়সী বলেই খদ্দের বেশি হাতে আসে। বিক্রি বাট্টায় সব থেকে এগিয়ে থাকে রাবেয়া। দু’বছর আগেও এ লাইনে ভাল ব্যবসা ছিল। কদর ছিল প্রডাক্টের। প্রতি মাসে খাই-খরচ শেষে নগদ দু’পয়সা হাতে আসত। এখন দুর্বিষহ নগর জীবন; নগরবাসীর নাভিশ্বাস প্রায়। দিনরাত ছোটাছুটি করেও সংসারের অভাব কখনও যায় না। যতদিন যায় ততই দেশী পণ্যের বাজার মার খেয়ে চলে। কলগেট, হোয়াইটপ্লাস, বাবুল দেশী-বিদেশী ফার্মাগুলোর প্রডাক্টে বাজার সয়লাব। মাঠকর্মী ছেলেমেয়েগুলো আগের মতো সুবিধা করতে না পেরে, যে যারমতো অন্যত্র ভিড়ে যায়। যাদের লেখাপড়ার ম্যারিড ভাল, সরকারী-বেসরকারী চাকরি নিয়ে যে যেখানে পারে সরে পড়ে। শুধু রাবেয়া, শান্তা, রুবিনারা বছর ধরে পড়ে থাকে এই ঐতিহ্যহীন দেশী পণ্যের বাজার নিয়ে। কেউ কেউ আবার বেকারত্বের কষাঘাতে এই শূন্য আসনে নতুন চাকরি নিয়ে পাড়ান্তরে ছুটে বেড়ায়। তাও জোর ছ’কি ন’ মাস। তার পর যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপান্ন। সেই যেমন আসা তেমনি ফিরে যাওয়া। কিন্তু রাবেয়ার সে সবের কোন বালাই নেই। যদি না তার পালিতা মা, না ফেরার দেশে না যেতেন; তবে আর মাঝ পথে হোঁচট খেতে হতো না রাবেয়ার। এখন রাবেয়া জেনে গেছে, ঝোলা কাঁধে প্রতিদিন নগ্নপদ যাত্রাই তার নিয়তি। তার পায়ের নিচে যে মাটি এ বড় নরম মাটি। তার চারদিকে বড় অন্ধকার ধু-ধু প্রান্তর। সেই অন্ধকারে একাই হেঁটে চলছে রাবেয়া। দুর্মূল্যের বাজার বলে কথা; তাকে এখন সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে। এমন কি এখন জীবনের মানেও ওজন করতে শিখেছে রাবেয়া। মাত্রতো দু’জনের সংসার। তবু অভাব কাটে না, শত হতাশার মধ্যেও এতদিন যা একটু আলোর ঝলকানি ছিল, সেও নিভে যাওয়ার উপক্রম এখন। রবিনের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে রাবেয়ার ওষ্ঠাগত প্রাণ যায় আসে। সে তার কারখানা থেকে যে আগাম নিয়েছিল। ভরসা ছিল রবিন একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চাকরি নিয়ে সেসব পরিশোধ করবে। চলে এসেছিলও সে রকম। পড়াশেষে সবেমাত্র চাকরির জন্য অফিসপাড়ায় পা দিয়েছে। আর তখনি বিপত্তিটা বন্য ষাঁড়ের মতো ঘাড়ে এসে আঘাত করে। হ্যাঁ, আঘাত-ই তো বটে। এছাড়া তৎক্ষণাৎ আর কী ভাবা যায়। বিপদ বলে কথা। কখন কি করে আসে; কোথাকার এক লায়লা হাসান। সাত মহল্লার বউরানী। পাঁচ বছরের একটি শিশুকন্যা নিয়ে, ভৃত্য, দাস-দাসী সমেত তার নিঃসঙ্গ জীবন। স্বামী হাসান মাহমুদ কানাডার প্রবাসী। দেশ-বিদেশ হাউজিং ব্যবসা। ঢাকার বউরানী ম্যান সন্স, বউরানী টাওয়ার, কমপ্লেক্স। অখ- অবকাশ, কিন্তু সময় কাটে না বউরানীর। হঠাৎ সেদিন গোধূলির প্রান্তবেলায় একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলাতে কলেজ জীবনের এক সময়কার সহপাঠী বন্ধু রবিনের সঙ্গে পুনর্বার দেখা। ভিড়ের মধ্যে মুখোমুখি দু’জন থমকে দাঁড়ায়। প্রথম দর্শনেই রবিনকে লুফে নেয় বউরানী, বলল, বলত কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা? ‘তা প্রায় পাঁচ বছর..., অসমাপ্ত সংলাপটি টেনে নিয়ে স্বউৎসাহে বলল বউরানী, ‘পাঁচ বছর সাত মাস একুশ দিন।’ এরপর ওরা বইমেলার বাইরে একটা রেস্তরাঁয় গিয়ে বসে। সেই থেকে শুরু বউরানীর বেপরোয়া জীবনযাপন। যখন যেমন খুশি দু’জনের ছুটে চলা। আজ কক্সবাজার তো কাল সমুদ্রসৈকত। শঙ্খ চিলের ন্যায় ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো। বিকেলের নরম রোদের সোনালি আভা মেখে চাতক পাখির মতো নিবিড় হেঁটে চলা। আবার কখনও লংড্রাইব...। খাগড়াছড়ির পার্বত্য অঞ্চল, শিখর চূড়ায় উদয়াস্ত সূর্য দেখা। এসব রবিনের সান্নিধ্যে তাকে উৎজীবিত করে। এর কোন কিছুর ব্যত্যয় হলেই বউরানী দিশেহারা। একদিন বিকেলে তারা কেনা কাটা শেষে শান্তি মহল ফিরছে। সেদিনই ওরা প্রথম শান্তার নজরে আসে। সে থমকে দাঁড়ায়, আরে! এ যে রবিন, রাবেয়ার জীবনসঙ্গী! সঙ্গে ওই সুন্দরী মেয়েটি তো রাবেয়া নয়, তবে কে ওই?... না চিনতে পেরে অবাক হয়ে চেয়ে দেখে। এরপর শান্তার মতো আরও অনেকেই দেখেছে। রাবেয়ার চলার সঙ্গী, কর্মজীবী রুবিনা, সুফিয়া। ওরা দেখেছে গুলশানের অভিজাত এলাকায় ঘুরে বেড়াতে। প্রথমেই রাবেয়াকে বিষয়টা জানিয়েছিল শান্তা। কিন্তু রাবেয়া শান্তাকে কোন পাত্তাই দেয়নি, মুখ পাতলা মেয়ে বলে অপবাদ দিয়েছে, ‘তুই কি দেখতে কি দেখেছিস নিজেই ভাল জানিস।’ এত অবজ্ঞা করেছে বলেই সেদিন শান্তা মনে খুব কষ্ট নিয়ে চুপ করেছিল। দু’দিন বাদে রুবিনা, সুফিয়াকে ধরে এনে সে কথা প্রমান করে তবে ছেড়েছে। সেদিন সে ভুল দেখেনি। তারপর থেকে এখানে ওখানে অনেকেই ঘুরে বেড়াতে দেখেছে হালের নব্য জুটি। সেই তখন থেকে রাবেয়ার দীর্ঘদিনকার যাপিত জীবনের সুখস্বপ্নটা মুখ থুবড়ে পড়ে, হৃদয় যন্ত্রের কোথায় যেন টান লেগে বেসুরো বেজে ওঠে। আর অস্বস্তি কাটেনি রাবেয়ার। তার পেছন থেকে এক জাঁকালো অন্ধকার তাকে অহরনিশি তাড়া করে। কোন কাজে মন বসে না। চিরশান্ত স্বভাবের রাবেয়া হঠাৎ-ই একদিন ড্রপ সিনের অন্তরালে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। যাতে রবিন কোন দিনও কিছু জানতে না পায়। মৃত্যুকালে হাস্নাবানু রাবেয়াকে অনুরোধ করেছিল, সে যেন কোন দিনও রবিনকে ছেড়ে না যায়। রাবেয়া সে কথা রেখে ছিল। সিস্টার হাস্নাবানু কোন এক দুর্যোগ রাতে হাসপাতালের ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে একটুকুন শিশুকন্যা রাস্তার ফুটপাথে পড়ে কাঁদছে। সে বছর বড় অভাব, চারদিকে মানুষ খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে নিজেই শিশুকন্যাটি কোলে তুলে ঘরে ফেরেন, তখন থেকে নিজের স্নেহছায়ায় কন্যাতুল্যে রবিনের সঙ্গে বেড়ে ওঠে রাবেয়া। সে হাস্নাবানু উঠে যাওয়ায় সংসারের কঠিন দায়িত্ব এসে চাপে রাবেয়ার ওপর। আর উচ্চশিক্ষা পেরনো হয়ে ওঠে না রাবেয়ার। রবিন বরাবরের মতো লেখাপড়ায় ভাল করে আসছে, হাস্নাবানুও চেয়েছিলেন, ছেলে তার অনেক উচ্চ শিক্ষিত হবে। সেই সুরে- সুর মিলাতে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর পরে সংসারের কোন ব্যাপারেই রবিন কে জড়াতে চায়নি রাবেয়া। সে নিরবচ্ছিন্ন লেখাপড়া করে গেছে। আর রাবেয়া অন্দর বাহির সামলাতে একাই জীবনপাত করে। একবার নিজে থেকে ফিরেও দেখেনি রবিন, কি করছে রাবেয়া। ঘরে যে ক’টা জমানো টাকা ছিল, হাস্নাবানুর অবর্তমানে সেসব এক সময় শেষ হয়ে গেলে, তখনি বিপাকে পড়ে রাবেয়া বাইরে বেরুতে শুরু“করে। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে সন্ধ্যার হতাশায় ভর করে বাড়ি ফেরে প্রতিদিন, কোন কাজ হয় না। কি করে সংসার চলবে? সবশেষে নিরুপায় হয়ে কাছের সহজ কাজটিই হাতে তুলে নেয় রাবেয়া,‘সুহাসিনী দন্ত মাজন’ নিম টুথ পাউডার কোম্পানির। সে ভেবেছিল মাত্র তো দু’জনের সংসার সামান্য রোজগারেই হেসে খেলে চলে যাবে। প্রথম দিকে হয়েছিলও সে রকম। শুরুতে ভালই বিক্রি ছিল। দিন শেষে দু’পয়সা হাতে ঘরে ফিরতো এ রকম বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাজারের হাল পালটে যেতে শুরু করে। দেশী-বিদেশী ফার্মাগুলোর চাপও বেড়ে চলে ক্রমশ। রাজনৈতিক সাফল্যে সাধারনের হাতে দু’টো নতুন পয়সা আসতে শুরু করলে। তার সঙ্গে বেশি করে দেশী পণ্যেরও অবমূল্যায়ন হতে থাকে। রবিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচা বেড়ে যায়। নিজের ও সারা দিনের পথ খরচা সংসারের দৈনন্দিন ব্যয়ভার, সবমিলিয়ে প্রতিদিন একটা অসহনীয় যাপিতাবস্থা। সব শেষে অনেক ভেবেচিন্তে, কুণ্ঠিত হৃদয়ে মালিকের সামনে হাত বাড়াতে প্রস্তুত হয় রাবেয়া। মালিক ও যেন মুখিয়ে ছিল রাবেয়াকে ঋণজালে বন্দী করবে। রাবেয়ার মতো উদ্যোগী মাঠকর্মী তার আর দ্বিতীয়টি ছিল না। তখন থেকে রাবেয়ার বন্দী জীবন। পড়ে আছে তো আছেই বছর ধরে। তবু একবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকেনি। বেঁচে থাকার বদান্যতায় নিজেই নাইট ক্লাবে আরেকটি চাকরি নেয়। চাকরিক সন্ধ্যান দিয়েছিল দিলারা। সে নিজেও সুহাসিনী টুথ পাউডার কোম্পানির একজন মাঠকর্মী। দিলারা খুবই প্রাণবন্ত মেয়ে। একই চাকরি, অথচ সে কি করে এত নিশ্চিন্তে সংসার করে। ভেবে পায় না রাবেয়া। কোন এক প্রাদোষিক সন্ধ্যায় ওরা ইংলিশ রুটের বাস ধরে নেমে, ক্লান্ত পদভারে বাড়ি ফিরছিল। পেছনে পড়ে থাকা যানবাহনের শব্দ দূষণ তখনও তাড়া করছে মুহুর্মুহু। এর মধ্যে রাবেয়া হঠাৎই জানতে চায়, তার হাসিখুশি থাকার উৎসটা। সে নিজে সামান্য সংসার নিয়ে এত হিমশিম, অথচ দিলারা কত নিশ্চিন্ত। এ কি করে সম্ভব? দিলারা প্রথমে রাবেয়ার প্রশ্নে না হেসে পারেনি। সারা দিনের পরিশ্রান্ত তবু খুনসুটে হাসি হাসতে থাকলে রাবেয়ার পিত্ত জ্বলে যায়। খেয়েপরে সুখে আছে বলে আহলাদে যেন পা পড়ে না দিলারার। এত অহঙ্কার ভাল নয়। কিভাবে নিজেকে সে? চোখে পানি আসে রাবেয়ার। দিলারা এ সময় মনোলোকের বার্তা জেনে ধীরে ধীরে বলল, ‘দেখ রাবেয়া, আমরা দু’জন একই মানুষ।’ থেমে আবার বলল, ‘আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সুরও অভিন্ন। আমাকে ভুল বুঝো না। আমিও একদিন আসমাকে প্রশ্ন করে জানতে পারি, আসমা অফটাইমে একটা চাকরি করে। বলেছিল, ‘রাতের চাকরি তো কাউকে বলা যায় না।’ দিলারা এ সময় হঠাৎ কি ভেবে প্রসঙ্গ পাল্টে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে বললে, ‘এখন তুমি আরেকটা চাকরি করবে কেন? শুনেছি তো রবিন সংসারে দু’পয়সা ভালই দিচ্ছে।’ রাবেয়া সেদিকে না গিয়ে নিজের প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে বলল, ‘বড় দুশ্চিন্তায় আছি ভাই, মালিকের কাছে অনেক দেনা আমি। সুদ আসলে সে প্রায় অনেক হবে।’ ‘তাই বলে, এত পরিশ্রম সইতে পারবে তো?’ ‘চাকরিই তো পাচ্ছি না বলব কি করে!’ ‘তুমি চাকরি পাচ্ছ না, এও বিশ্বাস করতে হবে? যে কি-না রূপেগুণে শ্রীদেবী, ঐশ্বরিয়াকে হার মানায়।’ আবার বলল, ‘হোটেল বারের চাকরি তো, ওরা সব সময় ফিগারটা ভাল চায়। তুমি প্রথম চান্সেই হয়ে যাবে।’ ফিগারের প্রসঙ্গ ওঠায় রাবেয়া চুপ করে থাকলে, দিলারা প্রশ্ন করে, ‘তোমার রবিন মেনে নেবে কি-না, তাই তো?’ আবার বলল, ওর আশা ছেড়ে দাও, তুমি কিছু না বললেও জানতো সব, এক ধনাঢ্য প্রবাসীর বউয়ের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে তোমার রবিন। হাজার চেষ্টা করেও তার নাগাল পাবে না। একসঙ্গে রাজত্ব আর রাজকন্যা একি কম কথা বল?’ রাবেয়া এ সময় রুষ্টকণ্ঠে বললে, ‘দেখ দিলারা এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত।’ দিলারা বলল, ‘আমি তোমার ভালর জন্য’ই বলছি, তুমি স্বাবলম্বী হতে চাও ভাল কথা। স্বামীর পয়সা আছে বলেই না, তোমার রবিন মহারানীর প্রেমে পড়েছে। শুনেছি দেখতেও নাকি খুব সুন্দরী। একেবারে সোনায় সোহাগা। মানুষ টাকার গোলাম। প্রেম ভালবাসা এসব ছোঁদোকথা।’ ‘কিন্তু দিলারা, তোমার কথায় মনে হয়, তুমি একটা কিছু লুকাচ্ছ।’ ‘না-না, সে রকম কিছু নয়। অনেকদিন তো দেখছি ওদের, কখনও মেয়েদের অসম্মান করে না। তুমি গেলেই সব দেখতে পাবে।’ রাবেয়ার চাকরিটা হয়ে যায়। পরিশেষে ওরা রাজপথে নেমে এলে, দিলারা আসমার মতোই সাবধান করে যেন, ‘রাতের চাকরি বলে কথা, একদম কাউকে বলা যাবে না। সাধারণ ঘরের একটা মেয়ে খেয়ে পরে ভাল থাকবে এটা আমাদের সমাজ আজও ভাল চোখে দেখে না। না-না অপবাদ দেয় চরিত্রের।’ ব্যাপারটা হয়েছিলও সে রকম। দু’মাস যেতে না যেতে, মহল্লার রকবাজ ছেলেগুলোর নজর পড়ে রাবেয়ার ওপর। একবার ডিউটি শেষে বাসায় ফিরতে একটু বেশি রাত হয়েছিল। নজরুলের চায়ের দোকানে বসে রকবাজ বাদশা সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে তখনও চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। গভীর রাত বলে কথা। তখনও বাইপাস দিয়ে দু’একটা ভারি যানবাহন নিস্তব্ধতার বুক চিড়ে হুটহাট এদিক-সেদিক বেরিয়ে যাচ্ছে মাত্র। এ সময় স্কুটার অদূরে দাঁড়ালে ভাড়া মিটাতে যতটুকু বিলম্ব, তারই মধ্যে ছুটে এসে বাদশা রাবেয়ার হাত চেপে ধরে বললে, ‘কি গো সুন্দরী বাইরের আউট লোকেরাই রূপযৌবনের স্বাদ নেবে, আমরা কিছুই পাব না এ কী করে হয়....?, রাবেয়া নোংরা ইঙ্গিতটা হজম করতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দেয় বাদশার চোয়াল বরাবর। এর সঙ্গে একই সময় হৈচৈয়ের আওয়াজ শুনে নজরুলের চায়ের দোকানের খদ্দের অনেকেই ছুটে এলে ওরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। ব্যাপারটা অল্পের মধ্যে তখনকার মতো নিষ্পত্তি হলেও শিরপীড়া থেকে যায় বাদশার সঙ্গী-সাথীদের মাথায়, ওদের ওস্তাদকে অপমান! ওরা এরপর থেকে তক্কে তক্কে থাকে। প্রতি হিংসার জিঘাংসায় উন্মত্ত করে রাখে ওদের সব সময়। এর মধ্যে বাদশার ছেলেগুলো মহল্লায় কুৎসা ছড়িয়ে দিয়েছে। নামে মাত্র হোটেল ওয়েটারের চাকরি। অন্তরালে দেহ ব্যবসা করে রাবেয়া। কোন এক ছুটির দিনে বিকেল গড়িয়ে এলে, ছেলেগুলো লাঠিসোটা হাতে দৌড়ে আসে। অবশ্য যে রকমভাবে দৌড়ে এসেছিল, সে রকম ক্ষতি সাধন করার আগেই রাবেয়া টের পেয়ে সেই যে রুমে ঢুকেছিল সমস্ত রাত্রেও দরজা খোলেনি। প্রতি পাড়া-মহল্লায় বরাবরই কমবেশি কিছু ভাল মানুষের বসবাস থাকে। তাদেরই জনাকয়েক থানা থেকে পুলিশ বের করে ব্যাপারটা সামলেছিল। রবিনও এ সময় বাইরে থেকে খবর পেয়ে ছুটে আসে। সবাই মিলে গভীর রাত অবধি ছেলেগুলোকে এখানে-ওখানে খুঁজে পেতে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। এভাবেই রাত কেটে ভোর হয়। রবিন সেই থেকে অসন্তুষ্ট রাবেয়ার ওপর। দেনার দায়ে নাইট ক্লাবে চাকরি নিয়েছিস ভালকথা। কিন্তু আমাকে একবার জানাবার প্রয়োজন মনে করবি না? তো, খুবই লায়েক হয়েছিস? পারলি কি সামাল দিতে? সম্মান, আত্মমর্যদা বোধ, শেষমেশ সেই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর আয়োজন! রাবেয়ার এই ঔদ্ধত্য সহজে মেনে নিতে পারেনি রবিন। সারারাত এই নিয়ে অস্বস্তি, দুশ্চিন্তা। তার নিদ্রাহীন চোখের পাতা তখনও ক্লান্তির অবগাহে। হঠাৎ, মোবাইল রিচার্স করে দেখে কল, এসএমএস কোন কিছুরই বালাই নেই এ পর্যন্ত। যে কি না নিমেশে চোখে হারায়, আর সেই বউরানীর পুরো একটা বিকেল কেটে রাতও কাবার হয়ে যায় তবু হা-হুতোশ নেই। এমন তো হয় না কখনও? হতাশায় ভেঙে পড়ে রবিন। ফিরে দেখে রাবেয়ার রুমের দরজা বন্ধ। মনে হয় মহারানী আজ আর বিছানা ছেড়ে উঠবেন না। রবিন ব্যস্তমতো শান্তি মহলের উদ্দেশ্যে বাইরে পা বাড়ায়। এ যাবত সে কোন দিনও যা দেখেনি। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই এ্যালথেসিয়ানের কবলে পড়ে। যে কিনা দিনের বেলা ভেতর বাড়ির পুরনো মালখানার খুঁটায় বাঁধা থাকত। আজ হঠাৎ করে এতটা উন্নতি। আঁতকে উঠে ভয়ে সদর দরজায় চিটকে পড়ে রবিন। একই সঙ্গে টমিও শিকল ছিড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর কী! তখনি পুরনো ভৃত্য বৃদ্ধ রহমত মিয়া ছুটে এলে কুকুর শিষ্যত্ববরণে কুই কুই শব্দ করে। রহমত মিয়া এ সময় রবিন কে অদূরে দাঁড়িয়ে তাকতে দেখে বিব্রত হয়ে বলল, ‘ছোট সাহেব আপনে অসময়...? বউরানীর সঙ্গে এখন তো আর দেখা হইব না।’ ‘আমার যে খুব দরকার ছিল!’ ‘কইলাম তো হইব না। বউরানীর নিষেধ আছে।’ ‘তুমি আরেক বার চেষ্টা করে দেখ না।’ ‘হইবো না। গতকাল বিকেলে সাহেব দেশে ফিরে আইছে, আইজকা বউরানীরে লইয়া আবার ফিরা যাইব। তিনি এখন আর কারও সাথে দেখা করবো না।’ ‘আমার সাথেও...?’ ‘হ, বউরানীর হে রকমই নিষেধ আছে।’ এক বউরানীর সঙ্গে রবিনের ঘনিষ্ঠতা, হাসান সাহেবের স্বজনদের মধ্যে কেউ কখনও মেনে নিতে পারেনি। যে কারণে প্রতিদিনই কিছু না কিছু উড়ো খবর ভেসে যেত কানাডার টরেন্টোতে। এর মধ্যে একরাতে বউরানী রবিনের সঙ্গে গুলশানের এক অভিজাত ক্যান্টিনে ডিনার খেতে গিয়েছিল। ওদের ফেরার পথে মন্টুর সঙ্গে দেখা। এতরাতে ওরা বাইরে এখনও? বড়-বাড় বেড়েছে ওদের! মন্টু আক্রোশে নিজেকে আর সামলে নিতে পারেনি। সম্পর্কে সে ফুফাতো ভাই। এলাকার ডাক-সাইটে মাস্তান। কিন্তু বউরানীর কাছে এখনও সে মিনু বিড়াল। অনেক সময় সাংসারিক প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সে তাকে ব্যবহার করে। লোকশ্রুত, মন্টুর সঙ্গে কোন এক সময় বউরানীর দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো একটা শারীরিক সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে তার সবকিছুতে মন্টুর একটা অধিকার জন্মেছিল। এ যাবত সে বউরানীর অনেক টাকা পয়সা হাতিয়েছে। তারপর একদিন বউরানীর জীবনে রবিন এলে পাশার চাল উল্টে যায়। সে নিজের হাতে সেই সব অপশন বন্ধ করে দিলে, মন্টু শিকার ব্যর্থ বাঘের মতো হয়ে ওঠে। সে জানে মদ্য-মাতাল মন্টু, সর্বদা লোট হয়ে থাকতে পছন্দ করে। কোন রকম নেশায় টান পড়লে মাথা স্থির থাকে না তখন। তখনি রবিনকে জড়িয়ে তাকে অশ্লীল খিস্তি খেউর করে। আর সে সময় বউরানী যে খানে থাক ছুটে এসে হাতের কাছে লামচাম যা কিছুপাক মুঠো করে ধরে দেয়া মাত্র সুুবোধ বালকের ন্যায় শান্তর মতো বেরিয়ে যাবে মন্টু। কিন্তু হঠাৎ সে দিন-রাত্রি বেলা ফুটপাথে দু’জনকে একসঙ্গে দেখে মন্টু বিগড়ে গেলে তার ব্যক্তিত্বে ভীষণ লাগে। রাতের ফুটপাথ হলেও তখনও রাজপথ কোলাহল মুক্ত নয়। বাস-গাড়ি, পথচারী লোকজন সমান ছুটছে যে যার মতো। বউরানী বিব্রত হলেও মন্টুর কিছু যায় আসে না তাতে। সে এক নাগাড়ে সব উগড়ে দিলে, বউরানী তিষ্ঠতে না পেরে গাড়িতে ওঠার মুহূর্তকাল আগে মন্টুর উদ্দেশ্যে আক্ষেপ করে বললে, ‘জুতো সুন্দর হলোও পায়ের নিচেই শোভাবদ্ধন করে জানবি। তুই কোনদিনও আমার সামনে আর দাঁড়াবি না।’ মার্সেডিস ছুটে চলছে, মন্টু চিৎকার করে বলছে, ‘যা যা, আমিও দেখে নেব, কত ধানে কত চাল। পারিস তো ঠেকাস!’ এর দু’দিন বাদেই হাসান সাহেব কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশে ফিরে আসে। রহমত মিয়া ভেতরে চলে গেলে টমির চিৎকারও থেমে যায়। রবিন হঠাৎ কি ভেবে রাস্তা থেকে একটা ছুটন্ত ট্যাক্সি ধরে উঠে পড়ে। রাবেয়ার জন্য এই প্রথম একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করে রবিন। কি করছে এখন রাবেয়া? এতবড় একটা দুর্ঘটনার পর ওকে এভাবে একা ছেড়ে দিয়ে তার বাইরে আসা মোটেও ঠিক হয়নি। রবিন যত ভাবছে ততই তার নির্বুদ্ধিতার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। রাবেয়ার পায়ের কাছে সমবেদনায় মাথা নত হয়ে আসছে রবিনের। রাবেয়া তাকে, তার সংসারকে এত ভালবাসে, এর আগে রবিন কখনও ভেবে দেখেনি। এইমাত্র যেন তার হৃদয়চক্ষু উন্মীলিত হয়। এ যাবত রাবেয়া দুু’টো বারতি আয়ের জন্য সারাদিন পাড়ান্তরে চুটে বেরিয়েছে। একটি সাধারণ মেয়ে হয়েও তার ঋণ মুক্তির দায়ভার কাঁধে নিয়ে নাইট ক্লাবে আরেকটা চাকরি নিয়েছে। অন্ধ রবিন একবার ভেবেও দেকেনি সে সব। যে মেয়েটা রাত জেগে সারা জীবন তার জন্য অপেক্ষা করেছে। তবুও একবার মনে প্রশ্ন আসেনি, আজ কেন সে নিজে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে? তবে রাবেয়া কোথায় এখন? একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে রাতের পর রাত বাইরে কী করে কাটায়? বউরানীর ভালবাসা তাকে এমন অন্ধ করে দিয়েছে। আজ রঙিন স্বপ্নটা কাচের আয়নার মতো ভেঙে খানখান হয়ে গেলে, তবে তার বোধোদ্বয় হয়, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ,‘রাবেয়া আমি সত্যি তোমাকে না বুঝে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমাকে ক্ষমা কর।’ রবিনের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায় ড্রাইভার ঠুকে ঠুকে একটা দুটো করে প্যাসেঞ্জার ধরে, ওঠায়-নামায়। এর মধ্যে রবিন বার কয়েক তাড়া দিয়েছে, শেষ বারেরমতো বললে, ‘ভাই একটু টেনে চালাও। এত লোকাল হলে হয়? তাড়া খেয়ে ড্রাইভারের গায়ে যেন পিচুটি পড়ে। বললে, ‘বেশি দরকারে স্পেশাল যেতে হয়। এটা লাইনের এক্সপ্রেস নয়।’ এরপর কিছুটা সময় গুমমেরে বাস থাকে রবিন। আবার বুকের মধ্যে সেই উৎবিগ্নতা, কী করছে এখন রাবেয়া? নিশ্চয়ই তার কথা ভাবছে। ট্যাক্সি নজরুলের চায়ের দোকান অতিক্রম করলে রবিন নেমে পড়ে। জোর কদমে হেঁটে চলে রবিন। দিন শেষে গোধূলির প্রান্তবেলায় হলদেটে ছায়া পড়েছে সড়কজুড়ে। পাশের ঝিলের জলে, এক পলকা মাঠের ভেতর, এখনও কিছু অস্পষ্ট রোদের ঝলকানি। দিগন্তের পাড়েও। আর একটু পরই আঁধার নামবে, নিকষ কালো আঁধার। রবিন দরজার কাছে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ। এই অবেলায় এখনও শু’য়ে আছে রাবেয়া! অসুখ করবে যে। ব্যস্ত হাতে দরজার কড়া নাড়ে রবিন, ‘রাবেয়া দরজা খোল আমি আসছি...।, ভেতরে চাপা উত্তেজনা। রবিন দ্বিতীয় বার কড়ায় হাত না দিতেই দরজা খুলে যায়। রকবাজ বাদশা তাড়া খাওয়া শেয়ালের মতো পাশ দিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেলে। যেন কিছুই হয়নি এ রকম রবিন নির্লিপ্ত ভেতরে ঢুকে শান্ত দৃষ্টি মেলে রুমটা জরিপ করে। তার সেই দৃষ্টি ঘুরে ফিরে রাবেয়ার মুখাবয়বে স্থির হয়। তার মলিন মুখাবয়বে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মাথার চুল, বেশ বিন্যাস, আলুথালু, অগুছালো। রাবেয়া নির্বাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কাছেই পালঙ্ক। তার ওপর এখনও নতুন করে পরিচর্যার হাত পড়েনি হয়ত। সময়ের অপর্যাপ্ততা। বেডসিট, বালিশ এ সব দেখে রবিন, শেষবারের মতো রাবেয়ার দিকে ফিরে তাকায়। দেখে রাবেয়া কাঁদছে। তার বিগলিত অশ্রুধারা, অবশেষে সবগ্লানি ধুয়ে-মুছে দিলে রবিন বলল, ‘রাবেয়া তুমি তৈরি হয়ে নাও, নতুন বাসা দেখেছি, আমরা আজই উঠে যাব।’ প্রিয় পাঠক, এরপর ওরা সারা রাত বাসা খুঁজে বেরিয়েছে, না, রাজ পথেই ঘুরে রাত কাটিয়েছে, না জীবনে কোন দিনও আর নতুন বাসা বাঁধতে পারেনি। আশা আশাই থেকেছে। সেসব কিছুই আমার অজানা। এজন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।
×