ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

বাংলাদেশে নারী নিপীড়নের চিত্র

প্রকাশিত: ১২:১৮, ২ আগস্ট ২০১৯

বাংলাদেশে নারী নিপীড়নের চিত্র

আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি যেখানে প্রতিনিয়ত কোন না কোন দুর্ঘটনা/অপরাধ/সমাজ গর্হিত কাজকর্ম ঘটেই চলছে এবং আমরা সেটিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অথচ একটা সময় পত্রিকার পাতায় একটি খুন কিংবা ধর্ষণের খবর ছাপা হলে ভয়ে আমাদের গা শিউরে উঠত। আর সেই আমরাই এখন ধর্ষণ, খুন, সন্ত্রাস, লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধের খবর শুনেও স্বাভাবিকভাবে জীবনাচরণ করছি। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কেউই জোরালো প্রতিবাদ করছি না কিংবা প্রতিরোধ করার সাহস পাচ্ছি না। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আমি ও আমার পরিবার নিরাপদে থাকলেই হলো, অন্যরা বিপদাগ্রস্ত হলে সামান্য প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের আহ্বান জানানোর প্রয়োজন বোধ করি না। প্রকারান্তরে, আমরা যে নিজেরা যে কোন সময়ে অপরাধের শিকার হয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারি সে বিষয়ে সামান্য চিন্তার উদ্রেক হয়নি কিংবা ঘটছে না। বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত, অমানবিক, মানুষ হিসেবে লজ্জার ও ধৃষ্টতার; কেননা প্রত্যেককে স্ব স্ব জায়গা থেকে যে কোন সমাজবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সর্বদা জাগরুক থাকতে হবে। কারও বিপদে এগিয়ে আসার নিমিত্তে উন্নত মানসিকতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন সুষ্ঠু ও নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে। যদি পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করা যায় তাহলে খুব সহসাই অনাকাক্সিক্ষত ঝুঁকি ও অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার ভয় থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে, অন্যথায় এ বাংলাদেশ সকলের জন্য অনিরাপদ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৮ সালে ২৭১ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত ১ বছরে বাংলাদেশে ১ হাজার ৬ জন শিশুকে ধর্ষণ, অপহরণ এবং নিপীড়নের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়। শিশুর পরিসংখান এ জন্যই নিয়ে আসা হয়েছে যে, ধর্ষকদের ঘৃণ্য, পৈশাচিক ও পশুবৃত্তি আচরণ থেকে বৃদ্ধ ও শিশু কেউই নিরাপদ নয়। সর্বশেষ ধর্ষণের শিকার হয়ে রাজধানীর ওয়ারীর সিলভারডেল স্কুলের নার্সারি শ্রেণীর ছাত্রী সামিয়া আফরিন সায়মার নৃশংস মৃত্যু হয়। একটি পরিসংখানে জানা যায়, ২০১৬ সালে ৪৪৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয় এবং ২০১৭ সালে ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৬ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয় এবং ২০১৭ সালে তা বেড়ে ৪৯ জন হয়। পরিসংখানিক চিত্র দেখে বলা যায়, উদ্বেগজনকহারে বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা, ধর্ষণের প্রকৃতি ও মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ার পাশাপাশি বৈচিত্র্যতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে কেন ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট ঘটনা অহরহ ঘটছে তার কার্যকারণ অনুসন্ধান করতে ক্রিমিনোলজির একটি তত্ত্বকে সামনে নিয়ে আলোচনা করা যায়। অপরাধবিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড উরভভবৎবহঃরধষ অংংড়পরধঃরড়হ তত্ত্বে ব্যক্তির অপরাধপ্রবণতার জন্য বেশকিছু প্রস্তাবনা উল্লেখ করেছেন তার দু/একটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রকটতাকে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত: অপরাধমূলক আচরণ হচ্ছে সামাজিক শিক্ষার ফল। সামাজিক শিক্ষাই ব্যক্তিকে সহনশীল, মানবিক তথা প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলে; ভিন্নদিকে সামাজিক অপ/কু/বিজাতীয় শিক্ষা ব্যক্তিকে ভয়ানক অপরাধী হিসেবে তৈরি করে থাকে। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, অপরাধীরা কিন্তু এ সমাজেরই অংশ এবং ধর্ষকরা সমাজ থেকেই অপরাধী হয়ে উঠার তালিম গ্রহণ করে থাকে। আমরা যদি প্রকৃত, গঠনগত প্রক্রিয়ায় সামাজিকীকরণের উপাদানগুলো বাস্তবায়ন করে প্রতিটি শিশুকে তৈরি করতে পারি তাহলে সমাজ অপরাধ/অপরাধী মুক্ত হয়ে উঠবে সহজেই। অজ¯্র কারণ রয়েছে যার প্রেক্ষিতে ছেলেমেয়েরা বিপথগামী হয়ে উঠছে এবং অপশিক্ষা গ্রহণের ফলে সমাজে সৃষ্ট অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। দ্বিতীয়ত: সমাজবদ্ধ অন্যান্য মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ মিথস্ক্রিয়ায় কোন ব্যক্তি অপরাধমূলক আচরণ শিখে এবং অপরাধী হয়ে উঠে। আমরা যদি একজন ধর্ষকের কেস স্টাডি করি তাহলে দেখা যাবে সে যাদের সঙ্গে নিয়মিত মিশছে, যাদেরকে অনুকরণ/অনুসরণ করছে, সবকিছু শেয়ার করছে এককথায় পিয়ার গ্রুপের চরিত্রায়ন করি তাহলে বের হয়ে আসবে পিয়ার গ্রুপের নানাবিধ কলঙ্গের চিত্র। কেননা, একজন র‌্যাপিস্টের (ধর্ষক) পিয়ার গ্রুপ কখনোই স্বাভাবিক জীবনাচরণ করতে পারে না, তারাও কোন না কোন অপকর্মে লিপ্ত থাকে; যে অপরাধকর্মের সঙ্গে আবিষ্ট হয়ে ক্রমান্বয়ে যে কেউ মারাত্মক অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। তৃতীয়ত: আইনের বক্তব্য ব্যাখ্যা সুস্পস্টভাবে জেনে বুঝে একজন ব্যক্তি অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠে। বাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতার যে রীতি ও বিচারিক কাজকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার যে চিত্র দেখা যায় তাতে একজন ধর্ষক মদদদাতাদের প্ররোচনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ ঘটার সাহস দেখায়। কারণ, ইতিপূর্বে বাংলাদেশে যে সকল ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সালতামামা এক নজরে দেখলেই অনুধাবন করা যায় প্রচলিত আইন ও বিচারিক কার্যক্রম একজন ধর্ষককে অপরাধী হিসেবে অপরাধ করার জন্য কিভাবে প্রলুব্ধ করে থাকে। উপরোক্ত তিনটি কারণকে যদি সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তাহলে ধর্ষককে সমাজ থেকে চিরতরে বিতাড়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণপত্র কি কি নেওয়া উচিত স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের মাথা ও মগজে উপস্থিত হবে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার জন্য সামাজিক মূল্যবোধ, রীতি নীতি, প্রথা, আচারাদি, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির নিয়মিত অনুশীলনকে সমাজবান্ধব করতে হবে। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের পিয়ার গ্রুপ কারা, কাদের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা করছে সে সম্বন্ধে অভিভাবকদের সচেতনতা ও খোঁজখবর রাখার মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা থেকে প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দূরে রাখা সম্ভব হবে। আইনের ফাঁক গলে কোন অপরাধী যেন সমাজে মুক্ত মানুষ হিসেবে চলাচলা করার দুঃসাহস দেখানোর অভিপ্রায় না পায় সে জন্য আইনপ্রণেতা ও বিচারিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত প্রত্যেককে নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতার অনুশীলন করতে হবে। ধর্ষণের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে দ্রুত ও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে যার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানের সঙ্কট নিরসন করা যাবে এবং ভবিষ্যতে এ সংক্রান্তে কর্ম সম্পাদনের পূর্বে ক্রিমিনাল শাস্তির ভয়ে অপরাধ করার দুঃসাহস দেখাবে না। ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে যেখানে দ্রুত ও নিখুঁত উপায়ে মামলাগুলোর বিচারকার্য সম্পন্ন করা যায়। খুব দুঃখের সহিত লিখতে হচ্ছে, ইতিপূর্বে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিচারকাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন হলে যে মাত্রাতিরিক্ত হারে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তা হয়তো দেখতে হতো না। এর দায় কোনভাবেই রাষ্ট্র এড়াতে পারে না, তাই রাষ্ট্রকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গঠনগত ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে শূন্য সহিষ্ণু নীতি অনুসরণ করেছে, ধর্ষণের বিরুদ্ধেও সে নীতি অনুসরণ করা উচিত। ধর্ষক এবং ধর্ষকের মদদদাতাদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কাজ সমাপ্ত করে জনমনে শাস্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনা জরুরী। এই খানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে মাঝে মধ্যে ক্রসফায়ারে ধর্ষকদের হত্যা করার পরেও বিরতিহীনভাবে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা কেন ঘটছে? ধর্ষকদের মনে কি কখনও ভয়ের সঞ্চার হয় না কিংবা অপরাধবোধ সৃষ্টি হয় না, হলে অবশ্যই অপরাধ থেকে নিজেদের নিবৃত্ত করে রাখত। এককথায় উত্তর দিলে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হচ্ছে: ধর্ষকের মদদদাতাদের মুখোশ উন্মোচন করে যতদিন না শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে ততদিন পর্যন্ত ধর্ষণের সংখ্যা ও মাত্রা কোনভাবেই কমানো সম্ভব হবে না।
×