ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়ে তুমি কোথায় নিরাপদ?

প্রকাশিত: ১২:১৭, ২ আগস্ট ২০১৯

মেয়ে তুমি কোথায় নিরাপদ?

গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ভেতরে পরীক্ষার হল থেকে ডেকে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েকজন। তার অপরাধ মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছিল নিহত নুসরাতের পরিবার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই ঘটনার জের ধরেই জীবন দিতে হলো নুসরাতকে। দীর্ঘ পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে না ফেরার দেশে চলে যান সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। নুসরাত হত্যকান্ডের মধ্য দিয়ে একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ঘটনা প্রকাশ পেল। নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যু আমাদের হৃদয়ে দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মাহমুদপুর এলাকায় ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। এবার ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে আটক করেছে র‌্যাব। গত ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার ফতুল্লার মাহমুদপুর পাকার মাথা এলাকায় ‘বায়তুল হুদা মাদ্রাসা’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে মাওলানা মোঃ আল আমিন নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে আটক করা হয়। আটক মোঃ আল আমিন ‘বায়তুল হুদা মাদ্রাসা’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিলেন। আটকের সময় তার মোবাইল ও অফিসের কম্পিউটার থেকে অসংখ্য পর্নো ভিডিও জব্দ করা হয়েছে। এদিকে গত জুলাই মাসেই ঝিনাইদহে একটি মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকের বিরুদ্ধে। প্রাথমিক তদন্তে এর প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ। তবে, ঘটনার পর থেকেই পলাতক ওই শিক্ষক। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে হাজী আলতাফ হোসেন হরিন্দিয়া মাদ্রাসায়, তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রীকে মাঝেমধ্যেই যৌন নির্যাতন করতো শিক্ষক আবু তাহের। একসময়, শিক্ষকের নির্যাতনের ভয়ে মাদ্রাসায় যেতে অস্বীকৃতি জানায় শিশুটি। বাবা-মা কারণ জানতে চাইলে বিস্ফোরক তথ্য দেয় সে। শিশুটির পরিবার জানায়, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি। এভাবে একের পর এক বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকাশ হতে থাকে। মাদ্রাসায় যৌন হয়রানির বিষয়টি রাষ্ট্র ও সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। মাদ্রাসার ভেতরে মেয়েদের এভাবে সম্ভ্রম হারানোর বিষয়টি মানুষের বিশ^াসের মূলে আঘাত হেনেছে। মাদ্রাসার মতো পবিত্র জায়গায় যেখানে নৈতিকতা শেখানো হয়, শিষ্টাচার শেখানো হয় আর যারা এই শিক্ষার কারিগর তারাই যেখানে অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে যাচ্ছে এতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মেয়ে তুমি তাহলে কোথায় নিরাপদ? জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. আইনুন নাহার বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমাদের ঘর থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, পাবলিক প্লেস, যানবাহন এমনকি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অহরহ মেয়েরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মাদ্রাসায় অনেক আগে থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যেহেতু এটা একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং এর সঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত তাই এটাকে একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে মানুষ। তাই মাদ্রাসায় এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটলেই মানুষ মনে করে এই বুঝি সব গেল। কিন্তু মাদ্রাসায় যারা যৌন নির্যাতন করছে তারাতো আমাদের সমাজেরই কেউ না কেউ। মাদ্রাসায় এ ধরনের অপরাধ সবসময়ই ছিল। মাদ্রাসা বলেই সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও কেউ এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইত না। এমনকি অভিভাবকদেরও বিশ্বাস করানো কঠিন হতো। কখনও কখনও এ ঘটনার জন্য মেয়েটিকেই দোষারোপ করে থাকে সমাজ এমনকি অভিভাবকরাও। তাই নির্যাতনের শিকার মেয়েটি নিরবে নির্যাতন সহ্য করে যায় মুখ বুঝে। বর্তমানে এ ধরনের সংবাদ ভাইরাল হচ্ছে বলেই মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন হতে শুরু করেছে, এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। আন্দোলন করছে। তবে কি রাষ্ট্র, কি সমাজ কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব জায়গায়ই নারী নিপীড়নের পিছনে পুরুষের ক্ষমতার অপব্যাবহারের বিষয়টি কাজ করে। নারীকে দুর্বল মনে করে সেটা তার উপর অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করে থাকে। তবে সবসময় নারীরাই যে নির্যাতিত হচ্ছে তা বলব না। পুরুষদের দ্বারা অনেক ছেলে শিশুরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সামাজিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতার কারণে শুধু মাদ্রাসা নয় সব জায়গায়ই ক্ষমতার প্রভাবে এ ধরনের ঘটনাগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। সঠিক বিচার হচ্ছে না। এটা যে একটা মারাত্মক অপরাধ সেটা সেভাবে প্রকাশ হচ্ছে না। কিছুদিন আগে শিশুদের ধর্ষণের ক্ষেত্র মৃত্যুদ-ের বিধান করে আইন পাস হয়েছে। শুধু আইন পাস নয় এর প্রয়োগোর বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠনসহ সব জায়গায়ই ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকলে এটাকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। নারী প্রগতি সংঘের উপপরিচালক শাহনাজ সুমী বলেন, আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোতে সরকারী অনেক সুযোগ সুবিধা বাড়লেও কোন মনিটরিং নেই। সরকারীভাবে কোন মনিটরিং না থাকায় মাদ্রাসায় যৌন হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকার পরেও তা মানা হচ্ছে না। এমনকি নেই কোন নীতিমালাও। ফলে মাদ্রাসার শিক্ষকরা যা খুশি করে বেড়াচ্ছে। মাদ্রায় ছাত্রীরা প্রতিনিয়তই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এমনকি ছেলে শিশুরাও এ ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে। তারাও নিরাপদ নয়। মাদরাসায় যৌন হয়রানি বন্ধ করতে হলে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং যারা এ ধরনের ঘটনায় জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
×