ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুরের বাঁধনে বাধা মানব মস্তিষ্ক

প্রকাশিত: ১২:১৫, ২ আগস্ট ২০১৯

সুরের বাঁধনে বাধা মানব মস্তিষ্ক

আমরা কেন মানুষ, কেন অন্য কোন জীব নই ? এই প্রশ্নের চিরন্তন অন্বেষায় বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে সঙ্গীত শোনার সময় আমরা যে ছন্দময় সুরেলা ধ্বনি শুনে থাকি তার প্রতি আমাদের মস্তিষ্ক অধিকতর স্পর্শকাতর এবং সেটা আমাদের বিবর্তনগত আত্মীয় ম্যাকাক বানরের চেয়ে বেশি। নেচার নিউরো সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয় যে, সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সঙ্গীতের গুরুত্ব বুঝতে এই তথ্যটি যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। গবেষকদের অন্যতম সদস্য বেভিল কর্নওয়ে বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি যে ম্যাকাক বানরের মস্তিষ্কের তুলনায় মানব মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ছন্দময় সুরেলা ধ্বনির প্রতি আকর্ষণ বেশি। তা থেকে এই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে যে কথা ও ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত এই ধ্বনিগুলো হয়ত মানব মস্তিষ্কের মূল কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছে। বেভিল কনওয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ)-এর ইন্ট্রাসুর‌্যাল রিসার্চ প্রোগ্রামের পিএইচডি ডিগ্রীধারী একজন ইনভেস্টিগেটর, নিবন্ধের প্রথম লেখক স্যাম নরম্যান হেইগনিয়ার পিএইডি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জুকারম্যান ইনস্টিটিউট ফর মাইন্ড, ব্রেইন এ্যান্ড বিহেভিয়িার পোস্ট ডক্টরাল ফেলো, এই দু’জনের মধ্যে বন্ধুসুলভ বাজি ধরার মধ্য দিয়ে এই গবেষণার সূত্রপাত। সে সময় তারা দু’জনেই ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটিতে কাজ করছিলেন। ড. কনওয়ের দল দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণের মানুষ ও বানরের মস্তিষ্কের মধ্যে কি ধরনের পার্থক্য আছে তার সন্ধান করছিলেন। তা করতে গিয়ে তারা দেখতে পান যে উভয়ের মধ্যে এ ব্যাপারে পার্থক্য অতি সামান্য। তাদের ব্রেন ম্যাপিং সমীক্ষা থেকে বোঝা যায় যে মানুষ ও বানর বিশ্বজগতকে অতিমাত্রায় একরকমভাবে দেখে। কিন্তু এরপর ড. কনওয়ে শ্রবণের বিষয়ে ড. নরম্যান হেইগনিয়ারে পরিচালিত কিছু সমীক্ষার কথা শোনেন। ড. নরম্যান হেইগনিয়ার সে সময় এমআইটিতে সহযোগী অধ্যাপক ড. জোস এইচ ম্যাকডারমো, পিএইচডির ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ড. নরম্যান হেইগনিয়ার বলেন, ‘আমি তখন বেভিলকে বলেছিলাম যে ছন্দময় ধ্বনিতে বেছে বেছে সাড়া দেয় মানব মস্তিষ্কের এমন একটি অঞ্চল নির্ভরযোগ্যভাবে চিহ্নিত করার একটা উপায় আমাদের রয়েছে।’ এ সময়ই তারা বানরের সঙ্গে মানুষের তুলনা করার ধারণাটি পেয়ে যান। নিজের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ড. কনওয়ে বাজি ধরে বলেন যে, দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য তারা দেখতে পান না। বক্তব্যটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য গবেষকরা সুস্বাস্থ্যসম্পন্ন স্বেচ্ছাসেবক ও বানরদের সুরেলা এবং উচ্চগ্রাম ও নিম্নগ্রামের ওঠা-নামা সংবলিত বেশ কিছু শব্দ বা ধ্বনি বাজিয়ে শোনানো হয়। শব্দের প্রতিক্রিয়ায় তাদের মস্তিষ্কে কি ধরনের ক্রিয়াকলাপ চলছে দেখার জন্য ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রিজোনেস ইমেজিং বা এফএমআরআই ব্যবহার করা হয়। ছন্দ বা লয়হীন শব্দের জবাবে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপও গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন। প্রথম দৃষ্টিতে স্ক্যানগুলো দেখতে একই রকম লাগে এবং তাতে আগের পরীক্ষার সত্যতা প্রতিপন্ন হয়। সুর বা ধ্বনির ওঠানামা থাক আর নাই থাক মানুষ ও বানরের মস্তিষ্কের অডিটরি কর্টেক্সের মানচিত্রে ক্রিয়াকলাপের একই রকমের হটস্পট ছিল। অবশ্য গবেষকরা আরও নিবিড়ভাবে ড্যাটাগুলো পরীক্ষা করে এমন তথ্য প্রমাণ পান যা থেকে বোঝা যায় যে মানব মস্তিষ্ক সুর বা ধ্বনির ওঠানামার ব্যাপারে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। তারা সুরের ওঠানামা এবং সমান ধরনের শোরগোল শব্দের মধ্যে মানুষ ও বানরের মস্তিষ্কের তুলনামূলক ক্রিয়াকলাপের দিকে তাকিয়ে তারা দেখতে পান যে বানরের কটেক্সের তুলনায় মানুষের শ্রবণগত কর্টেক্স অনেক বেশি সংবেদনশীল। ড. কনওয়ে বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি যে যে কোন নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জের শব্দ বা ধ্বনির প্রতি মানুষ ও বানরের মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা অতিমাত্রায় একই রকমের। কিন্তু যখন সেই ধ্বনির সঙ্গে সুরের ওঠানামাগত কাঠামো যোগ করা হলো তখন মানব মস্তিষ্কের একই অঞ্চলগুলোর কোন কোনটি অধিকতর সংবেদনশীল হয়ে উঠল। এসব পরীক্ষার ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে সঙ্গীত ও অন্যান্য ধ্বনির প্রতি ম্যাকাক বানরের অভিজ্ঞতা বা প্রতিক্রিয়া হয়ত ভিন্ন ধরনের। পক্ষান্তরে দৃশ্যমান জগত সম্পর্কে ম্যাকাক বানরের অভিজ্ঞতা সম্ভবত আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার অতিমাত্রায় অনুরূপ। এ থেকে অবাক হতে হয় কোন্ কোন্ ধরনের শব্দের অভিজ্ঞতা আমাদের বিবর্তনগত পূর্বপুরুষরা লাভ করেছিল। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেও এসব ফলাফল সমর্থিত হয়েছে। সুরধ্বনির মাত্রা সামান্য বাড়িয়ে দেখা গেছে যে দুটো বানরের মস্তিষ্কে তাল বা লয়গত স্পর্শকাতরতার ওপর তার সামান্য প্রভাব পড়েছে। পরিশেষে গবেষকরা ম্যাকাক বানরের ডাকের রেকর্ড বাজিয়ে দেখেছেন যে বানরদের জন্য অধিকতর প্রাকৃতিক ঐকতান সম্বলিত শব্দ ব্যবহার করে একই ধরনের ফল পাওয়া গেছে। ব্রেন স্ক্যানে দেখা গেছে ডাক বা আওয়াজ এবং সেই ডাকের সুরহীন কোলাহলময় সংস্করণের সময়কার পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপ তুলনা করলে বানরের শ্রবণগত কর্টেক্সের তুলনায় মানুষের শ্রবণগত কর্টেক্স অনেক বেশি সংবেদনশীল বলে লক্ষ্য করা যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে আমাদের মস্তিষ্ক ধ্বনির মাত্রা বা ওঠানামাকে যেভাবে প্রক্রিয়াজাত করে থাকে কথা, ভাষা ও সঙ্গীত হয়ত সেই পদ্ধতিকে মৌলিকভাবে বদলে দিয়েছে। সূত্র : সায়েন্স ডেইলি
×