ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

থেমে নেই জাল নোট তৈরি ॥ সারাদেশে সক্রিয় সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২ আগস্ট ২০১৯

থেমে নেই জাল নোট তৈরি ॥ সারাদেশে সক্রিয় সিন্ডিকেট

রহিম শেখ ॥ কি নেই! সব আয়োজনই আছে। কাগজ, প্রিন্টারে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কালি, নিরাপত্তা সিল সংবলিত স্ক্রিন বোর্ড, গাম, ফয়েল পেপার, কম্পিউটারসহ বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি। নিচে পড়ে আছে টাকা ও ভারতীয় রুপীর কড়কড়ে নোটের বান্ডিল। রাজধানীর রামপুরা এলাকার পলাশবাগ মোড়ের আবাসিক ভবনের একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তোলা হয়েছিল এমনই জাল মুদ্রা তৈরির কারখানা। সম্প্রতি এ বাসায় দুই দফায় অভিযান চালিয়ে বিপুল জাল মুদ্রা উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে বাজারে টাকা ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল চক্রটির। এ তো গেল একটি কারখানার গল্প। নগরীতে এমন অন্তত ২৫-৩০ বাসায় কারখানা বানিয়ে জাল মুদ্রা তৈরি করছে বিভিন্ন প্রতারক চক্র। এসব চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ। এই গ্রুপের বাইরে আছে ৫০ জাল টাকার ডিলার। প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচ/ছয়জন বাজারজাতকারী রয়েছে। কারখানায় শুধু দেশীয় টাকা নয়, ভারতীয় রুপীসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরি করছে এই সিন্ডিকেট। ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশ-বিদেশে। এসব জাল মুদ্রা কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। যাতে পরপর তিনবার কোন ব্যক্তির কাছে পাঁচ শ’ পিসের বেশি যে কোন মূল্যমানের জাল নোট পাওয়া গেলে তাকে সর্বোচ্চ ‘যাবজ্জীবন’ কারাদ- বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। তবে প্রথমবার একই সংখ্যক জাল মুদ্রা পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। দ্বিতীয়বার একই ব্যক্তির কাছ থেকে তা পাওয়া গেলে তাকে সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদ- বা আর্থিক জরিমানা প্রথমবারের তুলনায় দ্বিগুণ অথবা উভয় দ- দেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে জাল নোট সংক্রান্ত মামলা হয় ১৩৩টি। এর আগে ২০১৭ সালে ২৮৭, ২০১৬ সালে ৩৪৪, ২০১৫ সালে ৪১০ এবং ২০১৪ সালে ৩৬৮টি মামলা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনী দুর্বলতার কারণে দেশে জাল নোটের বিস্তার ঘটছে। গত তিন বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার জাল নোট শনাক্ত করা হয়েছে। আদালত সূত্র জানায়, বিচ্ছিন্নভাবে যেসব জাল নোট উদ্ধার করা হয় এবং ওই সব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয় তারা নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসেন না। ফলে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর যেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলোয় সাজা হচ্ছে না। খোঁঁ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় জাল নোট তৈরিতে কাজ করছে অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ। মূলত বছরের দুটি ঈদ উৎসব ও পূজাকে কেন্দ্র করে বেড়ে যায় জাল নোট চক্রের ব্যস্ততা। জালিয়াত চক্রের দক্ষ কারিগরদের তৈরি ‘নিখুঁত’ জাল টাকাতেও নিরাপত্তা সুতা বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণভাবে দেখে সেগুলোকে জাল বলে ধরার কোন সুযোগই নেই বলে মনে করেন একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তারা বলছেন, বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িত। সূত্র জানায়, প্রতিটি উৎসবের আগ মুহূর্তে জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর ভেজাল টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। ১ লাখ টাকার বান্ডেল ১২ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তৈরিকৃত জাল টাকা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। জাল টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে তারা এ কাজ করে থাকে। প্রথমে অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি, দ্বিতীয় পর্যায়ে এই টাকাগুলো যে অর্ডার দেয় তার কাছে পৌঁছে দেয়া, তৃতীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সূত্র জানায়, আসন্ন কোরবানির ঈদ ও পূজাকে সামনে রেখে তারা বাজারে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। জাল টাকার চক্রগুলো বাজারে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি এটিএম বুথেও আসল টাকার সঙ্গে জাল টাকা মিশিয়ে ব্যবসা করছে বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য বলছে, জাল টাকা তৈরির কারিগরদের (মাস্টার) মধ্যে সগির, কামাল, হুমায়ূন, জাকির, কাওসার, মাহবুব মোল্ল্যা, আলাউদ্দীন, বাবু, লিয়াকত হোসেন অরফে জাকির, রহিম বাদশার মতো অন্তত ২০ জন কারিগর রয়েছে। এর মধ্যে লিয়াকত হোসেন ওরফে জাকিরসহ তার দুই সঙ্গী শান্তা আক্তার ও মমতাজ বেগমকে গত বুধবার রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। এ ছাড়া রাজধানীসহ সারাদেশে অন্তত ৫০ জাল টাকার ডিলার রয়েছে। প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচ/ছয়জন বাজারজাতকারী রয়েছে। গত মাসেই উদ্ধার বিপুল পরিমাণ জাল রুপী ও টাকা ॥ গত ৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরা এলাকার পলাশবাগ মোড়ের আবাসিক ভবনের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জাল মুদ্রার সন্ধান পান গোয়েন্দারা। ওই কারখানা থেকে ৩৭ লাখ ভারতীয় রুপী ও ১০ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার হয়। গ্রেফতার করা হয় ১০ জনকে। গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য বলছে, আটককৃতদের মধ্যে অন্যতম ছিল চক্রটির মূলহোতা রফিকুল ইসলাম খসরু। যিনি ১২ বছর ধরে জাল মুদ্রা তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। খসরু দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ ও সরবরাহ করত। এছাড়া প্রস্তুতকৃত জাল রুপী দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলা বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোরের আগ্রহী ব্যবসায়ীদের কাছে চাহিদা মোতাবেক পৌঁছে দেয়ার কাজটিও করত খসরু। নিখুঁতভাবে দেখলে আসল ভারতীয় রুপীর সঙ্গে গ্রেফতারকৃতদের তৈরি করা জাল রুপীর বেশ পার্থক্য ছিল। তবে হঠাৎ করেই তা কারও নজরে আসার কথা নয়। বিশেষ করে গরু বা পোশাক কেনার সময় তাড়াহুড়া করে এসব জাল রুপী গছিয়ে দেয়া হতো। চক্রটি সূক্ষ্ম ও নির্ভূলভাবে জাল রুপী বানানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। এ কাজে কারিগর হিসেবে কাজ করত আব্দুর রহিম ও জনি ডি কস্তা। রহিম ১০ বছর ধরে জাল মুদ্রা তৈরির সঙ্গে জড়িত। আর জনি ৫ মাস ধরে জাল মুদ্রা তৈরির কাজে নামে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির উপ-কমিশনার মশিউর রহমান জানান, কোরবানির ঈদে পোশাক ও গরু আমদানির কাজে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জাল ভারতীয় রুপী ভারতে পাচারের পরিকল্পনা ছিল। পাচার করতে না পারলে তাদের জাল রুপী দিয়ে পোশাক ও গরুর কেনার পরিকল্পনা ছিল। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে একটি জাল নোটের কারখানা থেকে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গত ২ জুলাই বিশেষ অভিযান চালিয়ে মতিঝিল থেকে র‌্যাব-৩-এর একটি দল জাল মুদ্রা কারবারি চক্রের স্পেশাল সিন্ডিকেটের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার মাতুয়াইল এলাকা থেকে ২৬ লাখ জাল রুপীর নোট ও রুপী তৈরির সরঞ্জামসহ তিনজনকে আটক করেছে ডিবির উত্তর বিভাগ। আটককৃতরা হলেন- লিয়াকত হোসেন ওরফে জাকির, শান্তা আক্তার ও মমতাজ বেগম। এ সময় তাদের কাছ থেকে জাল রুপী তৈরির কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, কালার প্রিন্টার, লেমিনেশন মেশিন, জাল রুপী তৈরির বিপুল পরিমাণ কাগজ, বিভিন্ন কালারের কার্টিজ, সিকিউরিটি সিলসহ স্ক্রিন বোর্ড, গাম ও ফয়েল পেপার উদ্ধার করা হয়েছে। ওইদিন ডিবি পূর্ব বিভাগের একটি টিম ফকিরাপুল এলাকা থেকে ৫০ লাখ জাল টাকাসহ মোঃ লাল মিয়া ও শহিদুল ইসলাম নামে দু’জনকে আটক করেছে। একই দিন ডিবি পশ্চিম বিভাগের অপর একটি টিম সবুজবাগ এলাকা থেকে আবিদা সুলতানা ও আল আমিন নামে আরও দু’জনকে আটক করেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন, কোরবানির ঈদে ভারত থেকে গরু আনার হিড়িক পড়ে যায়। আর এ সুযোগে ভারতীয় অংশে লেনদেনের টার্গেট করেছিল জাল রুপী তৈরির চক্রটি। সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আগ্রহী ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী জাল রুপী সরবরাহ করে আসছিল। আরেকটি জাল রুপী চক্র ভারতীয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। তাদের কাছে জাল রুপীগুলো বিভিন্ন দামে পাচার করত এ চক্রটি। রাজধানীর পশুহাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ বসানোর নির্দেশ ॥ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন স্থানের কোরবানির পশুর হাটে ২৪টি জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ বসানো হবে। একইসঙ্গে সারাদেশের সরকার অনুমোদিত কোরবানির পশুর হাটেও জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ বসানো হবে। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে কোরবানির পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ বসানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা ক্রেতা-বিক্রেতাদের নোট যাচাইকরণ সেবা দেবেন। জাল নোট শনাক্তকারী মেশিনের সহায়তায় অভিজ্ঞ ক্যাশ কর্মকর্তাদের দ্বারা হাট শুরুর দিন থেকে ঈদের আগ রাত পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে পশু ব্যবসায়ীদের বিনা খরচে নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা দিতে হবে। ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস রয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার অনুমোদিত পশুর হাটগুলোতে স্থানীয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে গৃহীত অনুরূপ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার জন্যও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। একইসঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সম্বলিত ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত পোস্টারটি প্রদর্শন করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ভিডিও চিত্র ব্যাংকের শাখাগুলোতে ঈদের আগে পাঁচ কর্ম দিবসব্যাপী গ্রাহকদের জন্য স্থাপিত টিভি মনিটরগুলোতে (যদি না থাকে সেক্ষেত্রে টিভি মনিটর স্থাপনপূর্বক) পুরো ব্যাংকিং সময় পর্যন্ত প্রদর্শন করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোঃ রাজী হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও সব পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাল নোট সরবরাহকারী এবং উৎপাদনকারীদের ঠেকাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত ॥ এদিকে এসব জাল নোট কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। নতুন আইনটি পাস হলে এটি হবে দেশে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে প্রথম আইন। আইনটি বাস্তবায়নে ‘জাতীয় এবং জেলা’ পর্যায়ে কমিটি থাকবে। কমিটির সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে আইনের আওতায় গঠন করা হবে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সেল’। জাল নোট সংক্রান্ত খবর দেয়া হলে পুরস্কার দেয়া হবে সংবাদদাতাকে- এ বিধানও থাকছে নতুন আইনে। জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইনের খসড়ায় অপরাধীদের জন্য পর পর তিন দফা শাস্তি আরোপের বিধান রাখা হয়েছে। প্রথমবার অপরাধ করে শাস্তি ভোগ করে দ্বিতীয়বার একই অপরাধে শাস্তি হবে প্রথমবারের তুলনায় দ্বিগুণ। ফের একই ব্যক্তি এ অপরাধ তৃতীয়বার করলে দ-ের পরিমাণ দ্বিগুণ ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন হবে। খসড়ায় দ-বিধিতে আরও বলা হয়, জাল নোটের সংখ্যা পাঁচ শ’ পিসের (যে কোন মূল্যমানের) কম হলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদ- বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। একই ব্যক্তির কাছ থেকে একই পরিমাণ নোট (পাঁচ শ’ পিসের কম) দ্বিতীয়বার পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা অথবা উভয় দ- হবে। একই ব্যক্তির কাছে তৃতীয়বার (পাঁচ শ’ পিসের কম) পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদ- বা ৫০ লাখ টাকা আর্থিক দ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবে। তবে যে কোন মূল্যমানের জাল নোট এক শ’ পিসের কম পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদ- বা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। যদি একই ব্যক্তির কাছে দ্বিতীয়বার একই পরিমাণ নোট (এক শ’ পিসের কম) পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদ- বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। তৃতীয়বার একই ব্যক্তি একই পরিমাণ (এক শ’ পিসের কম) জাল নোট নিয়ে ধরা পড়লে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ- বা ২০ লাখ টাকা দ- অথবা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এবার জাল নোট কারবারিদের কঠোরভাবে দমন করতে নতুন আইন করা হচ্ছে। এটি হলে সহজেই জামিন পাওয়া বন্ধ এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে বলে মনে করেন তিনি। সিরাজুল ইসলাম বলেন, অন্য আইনে জাল নোটের মামলার বিচারে অনেক সময় লাগছে। যে কারণে অপরাধীদের শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, জাল নোটের কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং সংঘটিত এ সংক্রান্ত বিচারের জন্য পৃথক কোন আইন দেশে কার্যকর নেই। ফলে দ-বিধি ১৮৬০-এর ৪৮৯(ক)-(ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ২৫(ক) ধারা অনুযায়ী জাল নোট সংক্রান্ত অপরাধের বিচার চলছে। কিন্তু এসব আইনে বিচার করতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিচারকালে শুনানির নির্ধারিত দিনে প্রায় সময় সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ হওয়া এবং মাত্র কয়েক পিস জাল মুদ্রা পাওয়া কঠোর শাস্তির ভোগ করছে। এসব দিক ভেবে সরকার দেশে পৃথক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পৃথক এ আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটির সভায় ৬ সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি আইনের খসড়া প্রণয়ন ও চূড়ান্ত করে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোঃ সুলতান মাসুদ আহমেদ বলেন, আইনের খসড়াটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিগ্যাল রিটেইনার এবং সুপ্রীমকোর্টের আইনজ্ঞ দিয়ে ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভেটিং সম্পন্ন করা হয়েছে। গত বছরের ২৬ অক্টোবর এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করা হয়। খসড়াটি আইনে রূপান্তর করতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ রইল। নতুন আইনে জাল মুদ্রা প্রস্তুত, ক্রয়-বিক্রয়, খাঁটি বলে ব্যবহার ও লেনদেন, প্রতারণার উদ্দেশ্যে নিজের দখলে রাখা, দেশ থেকে বিদেশ বা বিদেশ থেকে সরবরাহ, পরিবহন ও পাচার, অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিতরণ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এছাড়া জাল মুদ্রা তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি বা উৎপাদন বা দ্রব্যাদি প্রস্তুত, সরবরাহ, আমদানি, মেরামত, বাহন ও ক্রয়-বিক্রয়ও অপরাধ। মুদ্রা তৈরি সংক্রান্ত পদ্ধতি, তথ্য আদান-প্রদান, ফাইল ক্লিপ, হার্ডডিস্ক এ সংক্রান্ত কোন গুজব ছড়ানো এ আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
×