ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপন্ন পৃথিবী

প্রকাশিত: ০৯:০২, ২ আগস্ট ২০১৯

বিপন্ন পৃথিবী

সোমবার পালিত হয়েছে ‘আর্থ ওভারশুট ডে’ বা পৃথিবীর সম্পদ ভোগের অনুমোদিত মাত্রা অতিক্রম দিবস।’ এর সরলার্থ হলো, বিশ্বের সম্পদ ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মানুষ প্রায় পৌনে দুইগুণ হারে ভোগ করছে মাটি, পানি, গাছপালা, খনিজ ও পানিসম্পদ, বিশুদ্ধ বাতাসসহ প্রায় সব প্রাকৃতিক সম্পদ। সেই হিসাবে ২০১৯ সালে যে পরিমাণ সম্পদ ব্যবহারের কথা তা ২৯ জুলাই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভোগ করে ফেলেছে বিশ্ববাসী। আর ৩০ জুলাই থেকে যা ভোগ করা হচ্ছে ও হবে, তা এক অর্থে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সঞ্চিত সম্পদ হরণ তথা ‘ঋণে’র শামিল। পৃথিবীর সম্পদ ভোগের ধারণাটি প্রথম প্রবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ডভিত্তিক পরবেশবাদী আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক। ১৯৮৬ সাল থেকে সংগঠনটি প্রতিবছর ওভারশুট গণনা করে আসছে। এটি হিসাব করা হয় বিশ্ববাসী প্রতিবছর কী পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগ করছে এবং এর বিপরীতে প্রকৃতি কী পরিমাণ সম্পদ পুনরুৎপাদন করছে তার ভিত্তিতে। সেই হিসাবে ভোগকৃত সম্পদ পুনরুৎপাদিত সম্পদকে ছাড়িয়ে গেলে ধরা হয় ওভারশুট। অনুমোদিত হারের চেয়ে বেশি হারে সম্পদ ভোগ, বন উজাড়, ভূমিক্ষয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়া, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা-ঝড়-ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, ভূমিকম্প, সর্বোপরি আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী এবং ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমশ। বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা এ বিষয়ে আরও আগে থেকেই সতর্ক এবং সাবধানবাণী উচ্চারণ শুরু করেছেন। প্রয়াত বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মানুষকে সতর্ক করে বলে গেছেন অন্য কোন গ্রহ বা ব্রহ্মা-ে মানুষের বিকল্প বসতি খোঁজার জন্য। বাংলাদেশ অবশ্য এ বিষয়ে সজাগ ও সচেতন। প্রধানমন্ত্রী গত বছর ওয়ান প্লানেট সামিটে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় অভিন্ন প্রচেষ্টা নির্ধারণের লক্ষ্য এগিয়ে নিতে সরকারী-বেসরকারী অর্থায়নের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সম্মেলন। ২০১৫ সালে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের ঐকমত্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির দুই বছরের মাথায় বৈশ্বিক তহবিলের বর্তমান অবস্থা এবং তা বাড়িয়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নত দেশগুলোর দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের তাগিদ দিয়ে শেষ হয় এই সম্মেলন। তবে দুঃখজনক হলো, এ বিষয়ে খুবই কম আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেছে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যেই সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছেন। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশও কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে অবলম্বন করছে ধীরগতি। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জোরপূর্বক মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এতে যোগ করেছে বাড়তি ঝুঁকি। গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণে ভূম-লের বায়ুস্তরে ওজন হোলের আয়তন বৃদ্ধি, উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরুর ঘন ভারি তুষার স্তূপ গলে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি মহাসাগরীয় ¯্রােত এল নিনো, লা নিনার প্রতিকূল প্রভাব। এর বাইরেও রয়েছে নির্বিচারে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, বিভিন্ন নদ-নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ, কয়লা এবং জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, এমনকি বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহ, বোমাবাজি, ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাদি। অতঃপর ধরিত্রীকে রক্ষার অনিবার্য প্রয়োজনে সর্বস্তরে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও বহুজাতিক ধরিত্রী সম্মেলন। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের অগ্রগতি সন্তোষজনক এবং একটি সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য ইতিবাচক। সার্বিকভাবে চুক্তিটিতে জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নের বিষয়টি অস্পষ্ট থাকলেও এবং কিছু বিষয় দুর্বলভাবে উপস্থাপিত হলেও বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনমত ও সচেতনতা সৃষ্টিতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধানদের বোধোদয়সহ দায়িত্বশীল ভূমিকা এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রত্যাশিত।
×