ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

১ আগস্ট, ১৯৭১;###;শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

প্রকাশিত: ১১:৩১, ১ আগস্ট ২০১৯

‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট দিনটি ছিল রবিবার। মুক্তিবাহিনী শালদা নদীতে পাকসেনা বোঝাই ৮টি নৌকা এ্যামবুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ৪টি নৌকা পানিতে ডুবে গেলে পাকবাহিনীর ৬০-৭০ জন সৈন্য হতাহত হয়। অপরদিকে হানাদারদের গুলিতে ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও একজন আহত হয়। ১১নং সেক্টরে ‘ডে ফোর্স’ পাকবাহিনীর বাহাদুরাবাদ ঘাট অবস্থানের ওপর রকেট লাঞ্চার ও গ্রেনেডের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হলে মুক্তিবাহিনীর বাহাদুরাবাদ ঘাট দখল করে। নৌ কমান্ডো সাব লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহ তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ন্যাভাল কমান্ডোদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বন্দরে অবস্থানকারী পাকিস্তানী ও বিদেশী জাহাজসমূহ ধ্বংস ও নদীপথ সম্পূর্ণভাবে অচল করার পরিকল্পনা করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর, মংলা বন্দর, চাঁদপুর অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর, নারায়ণগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর, দাউদকান্দি অভ্যন্তরীণ নদী বন্দর ও অন্য বন্দরসমূহ অচল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল। ১৭৮ জন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ৪ ভাগ করে প্রেরণ করা হয়েছিল। এদিন রৌমারীর আলতাফ বাহিনী কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী রেইড দিয়ে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে বালাবাড়ী পর্যন্ত দখল করে নেয়। সংঘটিত আন্ধারীঝাড় অপারেশনে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ্যামবুশ করে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ১১ জন সৈন্যকে হত্যা করে। এদিন মুক্তিযুদ্ধাদের ভয়ে পালানোর সময় কুমিল্লার জাফরগঞ্জের কাছে ৯০ জন নিহত হয়। হরিমঙ্গলে এ্যামবুশ করার সময় পাকসেনাদের ৩০ জন নিহত হয়। কায়াম্পুরে আরেকটি ঘটনায় ৯ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। শ্রীমন্তপুরে ৩ জন ও কোটেশ^রে ২ পাকসেনা নিহত হয়। লাটুমুরা, চন্ডিয়ার, বাড়িয়া ও গুরাইটে ২৯ জন হতাহত হয়। কায়াম্পুর জ্যাকপটে আক্রমণ করে ১০ সেনা হত্যা করা হয়। ৪ জন আহত হয়। জিক্রাতে মর্টার আক্রমণে শত্রুদের ১৪ জন হতাহত হয়। ৬টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেক্টরে মুক্তিফৌজ চৌরাশিয়াতে শত্রুদের পেট্রোলে আক্রমণ করে তাদের বেশ কয়েক জন ও ১ জন রাজাকার হত্যা করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালীকে নয়, সারা বিশ্বের সৃজনশীল মানুষকে টেনেছিল। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে দুপুর থেকেই ভিড় জমাচ্ছিলেন হাজারো প্রবাসী বাঙালী। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন তারা। সেই দিন ট্রাফলগার স্কয়ারের সামনের দেয়ালে টাঙানো হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রসহ লাল-সবুজের পতাকা। যার দুই পাশেই ছিল বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি বড় ছবি। সামনে আরেকটি ব্যানারে লেখাÑ ‘স্টপ জেনোসাইড, রিকগনাইজ বাংলাদেশ।’ ওই সমাবেশে প্রায় ৩০ হাজার বাঙালী সমবেত হয়েছিলেন। প্রথমে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপির স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পাঠ করে শোনানো হয়েছিল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেছেন। সমাবেশে লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ (সাবেক পররাষ্ট্র সচিব) কোন রকমের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, মহিউদ্দিন আহমদই প্রথম বাঙালী যিনি ইউরোপে পাকিস্তান দূতাবাসের কূটনীতিক হিসেবে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই দিনে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। আর সেই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া শেষ গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ হৃদয়ে শিহরণ তৈরি করে। এই দিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ও অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে আয়োজিত এ কনসার্টে সমবেত হয়েছিলেন ৪০ হাজার দর্শক। বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিংগো স্টার, বিলি পেস্টন, লিওন রাসেলের মতো সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে এ কনসার্ট এক দিনেই সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের কথা। পপ সঙ্গীতের জনপ্রিয় ইংল্যান্ডের এই শিল্পী প-িত রবিশংকরের অনুরোধে বেনিফিট সঙ্গীত অনুষ্ঠান ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানেই জর্জ হ্যারিসন পরিবেশন করেছিলেন বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা তাঁর ঐতিহাসিক গান ‘রিলিজ দ্য পিপল অব বাংলাদেশ।’ এদিন ঢাকা শহর মুসলিম লীগের এক সভায় মুসলিম লীগ সেক্রেটারি এএনএম ইউসুফ মুসলিম লীগের প্রতিটি কর্মী ও সদস্যকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে দুষ্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) দের দমন করার নির্দেশ দেন। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী সু চার মাস ধরে বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা ও পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়ে আসছে তার নজির ইতিহাসে বিরল। ইয়াহিয়া বাহিনীর অত্যাচারের যেমন তুলনা নাই, তেমনি বাংলাদেশের গণজাগরণ ও অতুলনীয়। এদিন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকামালা বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, ক্ষমতার লোভে উন্মত্ত ইয়াহিয়ার সৈন্যদের অমানুষিক অত্যাচার ও দাপট যতই বাড়ছে এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা যতই জোরদার হচ্ছে ততই বিশ্ববাসী আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের সপক্ষে ততই গড়ে উঠছে বিশ্বজনমত। মার্কিন জনগণ ও সেখানকার পত্রপত্রিকা বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন জঙ্গী শাহীকে অস্ত্র সাহায্যের নীতিতে অবিচল রয়েছেন। ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারি জন আরউইন সিনেটের এক সাব-কমিটির বৈঠকে বলেছেন যে, বাংলাদেশে দারুণ দুর্ভিক্ষের খবর তাঁরা পেয়েছেন। সাপ্তাহিক স্বাধীন বাংলা পত্রিকার ১ম বর্ষ : ৪র্থ সংখ্যা প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা কি বাংলাদেশকে ভিয়েতনামে রূপান্তরিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন? নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ‘জননিরাপত্তামূলক’ কর্মসূচীর নামে ঢাকায় পুলিশ বিশেষজ্ঞ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জননিরাপত্তার নামে এই বিশেষজ্ঞ দল মুক্তিযুদ্ধ দমন, ইহাহিয়ার বাহিনীকে মদদ দেয়ার কাজ করবে। লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া খান আগামীকাল অথবা পরবর্তী মঙ্গলবার পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করতে পারেন। তিনি এমন এক সময়ে ঢাকায় অবতরণ করবেন যখন বাংলাদেশী গেরিলা তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছে। রাতে ফার্মগেটে সেনাবাহিনী ও গেরিলাদের মাঝে একটি সংঘর্ষ হয়। ভারি মেশিনগান দিয়ে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি চলে। বোমার তীব্র শব্দে পুরো শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ছয়জন গেরিলার মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্ট পাওয়া যায়। সেনাবাহিনী এর চেয়েও বড় ধ্বংসলীলা চালায় ঢাকা শহরের অদূরে অবস্থিত লুডারিয়া, নালচাটা, লারিপাড়া নামের তিনটি খ্রীস্টান অধ্যুষিত গ্রামে। গ্রামগুলো টঙ্গী থেকে আড়িখোলা পর্যন্ত চলে যাওয়া রেল লাইনের পাশের উঁচু বাঁধের ওপর অবস্থিত ছিল। সেন্ট লুইস পোস্ট ডেসপাচ এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর করা প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, পোল্যান্ডে নাৎসিদের সময়ের পর থেকে হিসাব করলে এটা সব থেকে অবিশ্বাস্য। ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউনির প্রতিবেদন অনুসারে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সরকারী সেনাবাহিনী মূলত শহর এবং রাস্তাগুলোতে সীমাবদ্ধ। গ্রামাঞ্চলে গেরিলা বিদ্রোহীরা সীমান্তের ওপার থেকে সাহায্য পাচ্ছে। বেঞ্জামিন ওয়েলসের বিশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের অধীনে ১৫৬ জন বেসামরিক ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞদের একটি আন্তর্জাতিক দল পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান ও জাতিসংঘ। জাতিসংঘের কর্মীদের মধ্যে ৭৩ জন পর্যবেক্ষক থাকবে চারজন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার অফিসে সংযুক্ত হবে এবং বাকি ৬৯ জন অন্য স্থানে। ‘স্ফুলিঙ্গ কিউবেক’-এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পদ্মা, বাংলার বুকে প্রবহমান খরস্রোতা এক নদী, নিপীড়ন এবং বিপ্লবের ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য বহন করছে, যা বাঙালী কৃষকের জন্য আদৌ নতুন কিছু নয়। হেলথ ম্যাককুয়ারি এমপি, পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। কানাডার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম অস্ত্র চালানের বিরোধিতা করে কারণ তারা জানত পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সম্পৃক্ততা সামরিক-শিল্পকে আরও পুষ্ট করবে এবং এর ফলস্বরূপ জনসাধারণকে অধিক করের বোঝা বহন করতে হবে। আমেরিকানরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যয়ভার সম্পর্কে ভালভাবে অবগত ছিল; আমেরিকান সমর-শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তাদের প্রচুর কর প্রদান করতে হয়েছে। তারা কি বাংলায় আরেকটি ভিয়েতনাম দেখতে চাইবে? এর উত্তর না। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ খরচের আরও অনেক জায়গা রয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×