ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডেঙ্গু রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা

প্রকাশিত: ১১:০২, ৩১ জুলাই ২০১৯

ডেঙ্গু রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ডেঙ্গু জ্বর ভয়াবহ ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে রাজধানীর ইবনে সিনা, ল্যাব এইডসহ কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতাল। এমন অভিযোগে মঙ্গলবার আদালতে মামলা করেছে এক আইনজীবী। এদিকে ডেঙ্গু রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের পর কোন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর উত্তরায় তিনটি হাসপাতালকে ৪২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া ১৬ ভুক্তভোগী বিভিন্ন হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে দুই বেসরকারী হাসপাতালকে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে ইবনে সিনা হাসপাতালের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তের ভার ডিএমপির ধানম-ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মহানগর হাকিম দিদার হোসেন তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার আদেশ দেন। এদিন সকালে ঢাকা বারের আইনজীবী রমজান আলী সরকার মামলাটি করেন। আসামিরা হচ্ছেন, ইবনে সিনা হাসপাতালের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা গ্রুপের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক এ্যান্ড ইমেজিং সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কনসালটেন্ট (হেমাটোলজিস্ট) প্রফেসর কর্নেল (অবঃ) মনিরুজ্জামান। বাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন তানভীর আহমেদ সজীব। বাদীর মামলাটি আমলে দিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। মামলায় অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ২৫ জুলাই কোর্টের কাজ শেষে চেম্বারে অবস্থানকালীন শরীরে জ্বর অনুভব করেন বাদী। পরে সহকর্মী এ্যাডভোকেট জাফর আহমেদ সুমনকে নিয়ে জ্বর পরীক্ষা করতে ধানম-ি ইবনে সিনা হাসপাতালে যান। আউটডোরে পরামর্শ করা হলে তারা ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা বিবেচনা করে ডেঙ্গু এনএসআই এজ এবং সিবিসি পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। নির্ধারিত ফি দিয়ে রক্তের নমুনা প্রদান করা হলে তারা পরের দিন রিপোর্ট সংগ্রহ করতে বলেন। এজাহারের বাদী আইনজীবী রমজান আলী সরকার জানান, পরের দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে দেখতে পাই রক্তের প্লাটিলেট লেভেল সাত লাখ ৮৪ হাজার সিএমএম। রিপোর্ট দেখে আমি আতঙ্কিত ও বিমর্ষ হয়ে পড়লে সহকর্মী জাফর আমাকে সান্ত¡না দেন। অন্য আরেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই পরীক্ষা করার প্রস্তাব দেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রক্তের প্লাটিলেট লেভেল পরীক্ষার ফি জমা দিয়ে রক্তের নমুনা দেই। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিপোর্ট দিলে দেখা যায় রক্তের প্লাটিলেট লেভেল দুই লাখ। যা সুস্থ এবং স্বাভাবিক মানুষের শরীরে বিদ্যমান। তিনি জানান, একজন সুস্থ মানুষের রক্তের প্লাটিলেট লেভেল দেড় থেকে সাড়ে চার লাখ। কিন্তু তাদের রিপোর্টে রক্তের প্লাটিলেট লেভেল সাত লাখ ৮৪ হাজার দেখায়। যা কোন সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে হতে পারে না। ওই হাসপাতাল আমার সরলতা এবং অসুস্থতাকে পুঁজি করে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আইনজীবী রমজান আলী সরদার জানান, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক এ্যান্ড ইমেজিং সেন্টার ও প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ভুল রিপোর্ট প্রদান করে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৬৯/২৭০/৪০৬ ধারায় অপরাধ করেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার আবেদন করছি। দুই বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা ॥ হাসপাতালে ডেঙ্গু টেস্টে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগে রাজধানীর ল্যাবএইড ও ইবনে সিনা হাসপাতালকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। ভুক্তভোগীদের অভিযোগে মঙ্গবার শুনানি শেষে প্রতিষ্ঠান দু’টিকে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন টেস্টের ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল রোগীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। বিভিন্ন হাসপাতালের বিরুদ্ধে গ্রাহক এ ধরনের ১৬টি অভিযোগ দিয়েছেন। উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ জানান, অভিযোগের শুনানি শেষে ল্যাবএইড হাসপাতালকে ৫০ হাজার টাকা ও ইবনে সিনা হাসপাতালকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে গতকাল সোমবার ৫০০ টাকায় ডেঙ্গু টেস্ট ১২শ’ টাকা রাখার অপরাধে পপুলার হাসপাতালকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিদফতর। তিন হাসপাতালের বিরুদ্ধে ৪২ লাখ টাকা জরিমানা ॥ ডেঙ্গু রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের পর কোন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রিপোর্ট দেয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে রাজধানীর উত্তরায় তিনটি হাসপাতালকে ৪২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানান, সোমবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত উত্তরায় বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে এ জরিমানা করা হয়। অনিয়মের অভিযোগে রাজধানীর উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে ১৭ লাখ এবং লুবানা জেনারেল হাসপাতালকে ২০ লাখ ও আরএমসি হাসপাতালকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সারোয়ার আলম জানান, ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানা হচ্ছে কিনা? তাই সেখানকার হাসপাতালগুলো পরিদর্শনে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে কেঁচো খুঁড়তে এসে সাপ বের হবার মতো ঘটনা দেখলাম। তিনি জানান, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের কাছ থেকে সংগৃহীত নমুনা কোন ধরনের পরীক্ষা না করেই তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য রিপোর্ট। আবার কোন পরীক্ষার জন্য ৭২ কিংবা ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগলেও নমুনা সংগ্রহের ১২ ঘণ্টা পরেই তৈরি করা রিপোর্ট রোগীদের সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মেয়াদোর্ত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার, অনুমোদনহীন ওষুধ রাখাসহ বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়া যায় অভিযানে। এসব কারণে হাসপাতালটিকে ১৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, অন্যদিকে লুবানা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ওষুধের দাম রাখা হচ্ছে ১০-২৫ গুণ। যে ওষুধের দাম মাত্র ৪ টাকা তা রাখা হচ্ছে ১০০ টাকা। মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষায় যে সব অপশন বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষার নিয়ম রয়েছে। তা না করে মনগড়া রিপোর্ট তৈরির প্রমাণ মিলেছে। এসব কারণে লুবানা জেনারেল হাসপাতালকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া একই অভিযোগে আরএমসি হাসপাতালকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, ৩৪.৫ টাকার পেথেডিন ৩৫০ টাকায় বিক্রি, চার টাকার ওষুধ ১০০ টাকায় বিক্রি, ল্যাব এবং অপারেশন থিয়েটারে যথাক্রমে পাওয়া যায় মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট এবং সার্জিক্যালসামগ্রী। এইচ আইভি, ম্যালেরিয়াসহ বাধ্যতামূলক পাঁচটি টেস্ট না করেই করছে লাইসেন্স ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন। এজন্য এই তিন হাসপাতালকে ৪২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
×