ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হোয়াইটওয়াশ এড়াতে পারবে বাংলাদেশ?

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ৩১ জুলাই ২০১৯

হোয়াইটওয়াশ এড়াতে পারবে বাংলাদেশ?

মিথুন আশরাফ ॥ নিয়মিত ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা নেই। বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান নেই। নেই ব্যাটসম্যান লিটন কুমার দাস। পেস অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও নেই। এ চার ক্রিকেটার না থাকাতে বাংলাদেশ এমনই দুর্বিষহ অবস্থায় পড়ল যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একের পর এক ম্যাচ হারতে থাকল। আজ কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে যদি হার হয় তাহলে লঙ্কানদের কাছে হোয়াইটওয়াশ হবে বাংলাদেশ। সবার এখন একটাই প্রশ্ন, হোয়াইটওয়াশ এড়াতে পারবে বাংলাদেশ? দলের দুই সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ও সাকিবকে ছাড়াও বাংলাদেশ দল ওয়ানডে জিতেছে। তাও আবার এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। হারলেই বিদায়। জিতলে ফাইনালে ওঠা হবে। সেমিফাইনাল হয়ে ওঠা ম্যাচটিতে তামিম, সাকিবকে ছাড়াই জিতেছে বাংলাদেশ। অথচ এখন তামিম থাকতেও জয় মিলছে না। কেন? বাংলাদেশ দলে যে ক্রিকেটারদের উজ্জীবিত করে রাখার মতো, মাশরাফির মতো অধিনায়ক প্রয়োজন তা বোঝা হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপের ম্যাচটিতে মাশরাফি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তামিম ও সাকিব দুইজনই ছিলেন না। বাংলাদেশ আগে ব্যাটিং করে মুশফিকুর রহীমের ৯৯ ও মোহাম্মদ মিঠুনের ৬০ রানে ২৩৯ রান করে। খুব যে বেশি রান স্কোরবোর্ডে জমা হয়েছে তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের ইনিংস শেষেতো মনে হয়েছিল, পাকিস্তানই জিতে যাবে। বিদায় নেবে বাংলাদেশ। কিন্তু মাশরাফির বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব আর বোলারদের উজ্জীবিত করা বক্তব্যে ম্যাচ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশই জিতে যায়। মুস্তাফিজুর রহমানের (৪/৪৩) অসাধারণ বোলিংয়ের সঙ্গে মেহেদী হাসান মিরাজের (২/২৮) দুর্দান্ত ঘূর্ণিতে কাত হয় পাকিস্তান। সঙ্গে মাশরাফি, রুবেল হোসেন, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও সৌম্য সরকার বল হাতে পাকিস্তান ব্যাটসম্যানদের ওপর এমনই চাপ তৈরি করেন, সঠিক সময়ে মাশরাফি এমনভাবে বোলার ব্যবহার করেন তাতে ২০২ রানের বেশি করতে পারেনি পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপে খুব আহামরি কিছু করে দেখাতে পারেনি। এমনকি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশই জিতবে এমনই মনে করা হয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ খেলতে গিয়েই সব এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রথম ওয়ানডেতে ৯১ রানে হারের পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭ উইকেটে হেরে এরই মধ্যে সিরিজ হার হয়ে গেছে বাংলাদেশের। এখন হোয়াইটওয়াশের তোপে পড়ে গেছে। এমনটি হচ্ছে আসলে বোলিং-ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে এবার ব্যাটিং ব্যর্থতাও যোগ হওয়ায়। বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। বড় বড় স্কোর গড়ে, লড়াকু মনোভাব দেখিয়ে প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে খেলতে নামতেই তা উধাও হয়ে যায়। বোলিং-ফিল্ডিং নিয়েতো আগে থেকেই ছিল রাজ্যের হতাশা। এবার ব্যাটিং নিয়েও দুঃশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। বিশ্বকাপে ওপেনিং জুটিতে তামিম ও সৌম্য ব্যর্থ হওয়ার পরেও জেতা গেছে, বড় স্কোর গড়া গেছে। কারণ সাকিব তিন নম্বরে হাল ধরেছেন। এরপর মুশফিকও কয়েকটি ম্যাচে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। কিন্তু এখানে এক মুশফিক ছাড়া আর কোন ব্যাটসম্যানকেই চোখে পড়ছে না। সবার এতটাই খারাপ অবস্থা যে শ্রীলঙ্কা এমনই সুযোগ পাচ্ছে, বড় ব্যবধানে জয়গুলো তুলে নিচ্ছে। অধিনায়কত্ব পেয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা তামিমের। কিন্তু তিনি টানা ব্যর্থতাতেই পড়ে আছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচে মোটে ১৯ (০ ও ১৯) রান করেছেন। সৌম্য তো এত বেশি সুযোগ পেয়েও কোন কাজেই লাগাতে পারছেন না। তার ব্যাটিং ব্যর্থতা যেন সবার ভেতর ইদানীং বিঁধছে। বিশ্বকাপে টানা ব্যর্থতার পর লঙ্কানদের বিপক্ষে দুই ম্যাচে ১৫ ও ১১ রান করে কী আর একাদশে বারবার টিকে থাকা সম্ভব? সাকিবের অভাব বুঝতে দেবেন না মোহাম্মদ মিঠুন এমনই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো হতাশার যেন মূর্তি হয়ে ধরা দিচ্ছেন। এই স্থানটি কত গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব মিঠুন নিজেও বুঝেছেন কিনা কে জানে। তা না হলে দুই ম্যাচে মোট ২২ রান (১০ ও ১২) কি আর এই স্থানে থাকার যোগ্যতায় ভাসায় মিঠুনকে। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদেরও যেন কি হয়েছে। সেই গত বছর এশিয়া কাপ থেকেই আসলে নিজেকে খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু কোন কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। দলের বিপর্যয়ের ক্রিকেটার ধরা হয় মাহমুদুল্লাহকে। অথচ দুই ম্যাচে ৩ ও ৬ রান বাংলাদেশ দলের বিপর্যয় আরও এনেছেন। সাব্বির রহমানকে নিয়ে আসলে খুব ভরসা করেন, এমন লোক কমই হয়তো মিলবে। তিনি অহেতুক কখন আউট হবেন কেউ যে জানে না। প্রথম ওয়ানডেতে দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে ৬০ রানের ইনিংস খেলেছেন। দুর্দান্ত ইনিংস। কিন্তু যখন উইকেট আঁকড়ে থাকা জরুরী তখনই অহেতুক আউট হয়ে যান। এ নিয়ে অধিনায়ক তামিমও হতাশা প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় ওয়ানডেতো ১১ রান করে রান আউটই হয়ে যান। সাত নম্বরে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে রাখা হয়েছে। তার ওপর অনেক ভরসা করা হয়েছে। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে অসাধারণ ব্যাটিং করে দলকে জেতানো এ ব্যাটসম্যান এরপর অফফর্মে যেন চলে গেলেন। সেই নৈপুণ্য আর দেখার মিলছে না। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ওয়ানডেতে ১২ আর ১৩ বিপর্যয়ের মুহূর্তে জ্বালা বাড়ায়। মেহেদী হাসান মিরাজ দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মুশফিকের সঙ্গে হাল ধরেছেন। ৪৩ রানের ইনিংস খেলেছেন। কিন্তু প্রথম ওয়ানডেতে আবার ব্যর্থ হয়েছেন (২ রান)। ব্যাটসম্যানরাও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন না। আর তাতেই এই বেহাল দশা হচ্ছে। সৌম্য, মিঠুন, সাব্বিরদের সরিয়ে একাদশে অন্য কাউকে যে নেয়া হবে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ক্রিকেটারই যে নেই। এনামুল হক বিজয় গেছেন। তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা সুযোগ সৌম্যের পরিবর্তে পেতে পারেন। কিন্তু মিঠুনকে বসাতে হলে তো লাগবে সাকিবকে। তিনি তো সিরিজে খেলছেন না। আর সাব্বিরকে বসাতে হলে তো লিটনকে থাকা লাগবে। তাই আপাতত সিরিজটি এভাবেই শেষ হচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছে। সাকিব না খেলায় স্পিনেও তো নখদন্তহীন হয়ে পড়েছেন স্পিনাররা। আজ হয়তো এমনও হতে পারে একাদশে অনেক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। কিন্তু সেই পরিবর্তন এনেও কী জেতা সম্ভব? যদি ব্যাটসম্যানরা সঠিক কাজটি করতে না পারেন। তৃতীয় ওয়ানডেতেও তাহলে বিপদ থাকছে। যদি ব্যাটসম্যানরা ভুল শুধরে নিজেদের মেলে ধরেন তাহলে আলাদা বিষয়। তখন জয় ধরাও দিতে পারে। সিরিজে শেষ পর্যন্ত স্বস্তির জয়টি মিলতেও পারে। না হলে তো শ্রীলঙ্কার কাছে আবারও হোয়াইটওয়াশের বিস্মৃতি নিয়েই মাঠ ছাড়তে হবে। ব্যাটসম্যানদের আগে বোলার ও ফিল্ডারদের নিয়ে ছিল মহাচিন্তা। বোলাররা শুরুতে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের বিপদে ফেলতে পারেন না। কোন রকমে তা করতে পারলেও ফিল্ডাররা ক্যাচ মিস করে সব গুলিয়ে দেন। শেষে যখন ব্যাটসম্যানরা রান তোলার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তখন উইকেট শিকার করা সম্ভব হয়। কিন্তু ততক্ষণে স্কোর মজবুত হয়ে যায়। মুস্তাফিজ, মিরাজ, শফিউলরা উইকেট পাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু রান অনেক বেশি দিয়ে ফেলছেন। যে চিন্তা থেকে বেরই হওয়া যাচ্ছে না। আর ফিল্ডিং তো জঘন্যই হয়ে আছে। এই দুই বিভাগে ব্যর্থতা ঢেকে দেয়া যেত, যদি ব্যাটিংটা সুন্দর হতো। বিশ্বকাপের মতো হতো। কিন্তু এক সাকিব না থাকাতেই যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। মুশফিক একা হাল ধরছেন। কিন্তু তিনি আর কত করবেন? বিশ্বকাপের পরপরই এ সিরিজ হচ্ছে। বিশ্বকাপের ২০ দিন পরই সিরিজ খেলতে নেমেছে বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলায় যুক্তরাজ্যে ৬৭ দিনের মতো থেকেছেন ক্রিকেটাররা। একের পর এক ভেন্যুতে যেতে হয়েছে। টানা খেলতে হয়েছে। ক্রিকেটাররা তাতে কিছুটা ক্লান্ত ছিলেনই। কিন্তু দেশে ফেরার পরতো বেশ কয়েকদিন বিশ্রাম পেয়েছেন। তাছাড়া পেশাদার ক্রিকেটারদের ক্লান্তি জয় করেই খেলতে হয়। ক্লান্তি নিয়ে অনেক কথা উঠছে। তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন যদি সিরিজ না হয়ে বিপিএল হতো তাহলে কী এমন ক্লান্তির কথা উঠতো বা ক্লান্তির ছাপ ধরা পড়তো? অনেক বেশি খেলায় ক্রিকেটাররা ক্লান্ত থাকবেন তা স্বাভাবিক। তাহলে মুশফিকেরও ক্লান্ত থাকার কথা। কিন্তু তিনি ঠিকই দুই ম্যাচে ৬৭ ও অপরাজিত ৯৮ রান করেছেন। আবার প্রথম ওয়ানডেতে উইকেটরক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন। আর একাদশে যারা সুযোগ পাচ্ছেন তাদের মধ্যে মিঠুন, সাব্বির তো বিশ্বকাপে সব ম্যাচে খেলেনওনি। তাইজুল, শফিউলরা তো বিশ্বকাপের দলেই ছিলেন না। তামিম, সৌম্য তো খুব বেশিক্ষণ বিশ্বকাপে উইকেটেও টিকে থাকেননি। বোঝাই যাচ্ছে মাশরাফির নেতৃত্ব আর সাকিবের অভাব বাংলাদেশ দলকে ভালই ভোগাচ্ছে। সঙ্গে লিটন ও সাইফউদ্দিন না থাকায় একাদশে প্রভাবও পড়ছে। দলের ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে গেছে। মানসিকতাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় কী হোয়াইটওয়াশ এড়ানো সম্ভব? সব বাধা জয় করে এখন হোয়াইটওয়াশ এড়ানো গেলেই হয়।
×