ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত নয় তো!

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ৩১ জুলাই ২০১৯

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত নয় তো!

প্রিয়া সাহা নামে এক বাংলাদেশী এনজিও ‘নেত্রী’ গত ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং বসবাসের পরিস্থিতি নেই বলে যে অভিযোগ করেছে তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে চক্রান্তেরই নামান্তর! বিষয়টি সাদা চোখে দেখার কোন সুযোগই নেই। আজ যখন শেখ হাসিনার সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জীবনবাজি রেখে মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে দেশের সকল সম্প্রদায়ের জন্য এক স্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করেছেন এবং বিশ্বের সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন ঠিক তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ‘বাঁচানোর’ জন্য আকুল আবেদন জানাতে দেখা গেল। সংখ্যালঘুদের যে সম্মেলনটি ওয়াশিংটনে আয়োজন করা হয় তাতে তিনি বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত না হলেও কি করে সেখানে গেলেন এবং ট্রাম্প সাহেবের সঙ্গে মোলাকাতের এই দুরূহ সুযোগটি পেলেন তা এক গভীর রহস্য সৃষ্টি করেছে দেশে। ঐ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত জানান, পরিষদের ১১ জন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে প্রিয়া সাহা একজন এবং পরিষদ এই সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তার নাম সুপারিশ করেনি। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, প্রিয়া সাহা কার বা কাদের সুপারিশে সেখানে গেলেন এবং কোন্ সংগঠনেরইবা তিনি সেখানে প্রতিনিধিত্ব করলেন? বলা হচ্ছে যে, ট্রাম্পের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাছাইকৃত ভুক্তভোগি কিছু লোকের সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং প্রিয়া সাহা বাংলাদেশের একজন ‘নির্যাতিত সংখ্যালঘু’ হিসেবে সেখানে উপস্থিত হবার সুযোগ পান। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, তিনি ‘নির্যাতিত এক সংখ্যালঘু’ এই তথ্য বা এর সত্যতা যাচাই করল কে এবং কারাইবা এ কারণে তার নাম সুপারিশ করল? নির্যাতিত হবার যে অভিযোগটি তিনি করেছেন (যা সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে) তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে, এমনকি তার বিরুদ্ধেও অনুরূপ পাল্টা অভিযোগও রয়েছে। তিনি ট্রাম্প সাহেবের কাছে যে ভঙ্গিতে নালিশটি করেছেন তাতে দেশের মানুষের মাথা হেঁট করে দিয়েছেন। প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্টকে বললেন, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু নাকি গুম হয়ে গেছে এবং এসবই নাকি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। প্রথমত. এত সংখ্যক সংখ্যালঘুর গুম হওয়ার এই ডাহা মিথ্যা তথ্য তিনি কেন ও কোন্ মহলের হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনে উচ্চারণ করলেন অবিলম্বে তার তত্ত্ব-তালাশ নেয়াটা সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরী। গোটা বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে ঐ প্রিয়া বর্ণিত সংখ্যক সংখ্যালঘুর গুম হবার তথ্য যে সর্বৈব মিথ্যা তা জানেন না বা বোঝেন না তা কি করে হয়? এই সংখ্যা সত্য হলে বাংলাদেশে মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশের যেসব এজেন্ট ( এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা ইত্যাদি) নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে তাদের কারোরই চোখে এটি পড়েনি? আর মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বময় ঘটমান বর্তমানের সার্বিক তথ্যাদি বলতে গেলে রোজ পরিবেশন বা সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যে অনেক প্রতিষ্ঠান সদা তৎপর থাকে তা কাউকে নতুন করে বলে দেয়া লাগবে না নিশ্চয়ই! অবশ্য এর উল্টো দিকটিও বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈকি! বিষয়টি সাজানো দৃশ্যও হতে পারে নিশ্চয়ই! আর এই কথাটি মাথায় রেখে আমাদের জানার চেষ্টা করতে হবে যে, আসলে এ প্রিয়া কার? কার হয়ে তিনি ময়দানে এই অভিনব চেহারায় আবির্ভূত হয়েছেন বা খেলতে নেমেছেন? এ বিষয়টি জানা কিন্তু আমাদের সকলের জন্য অত্যন্ত জরুরী। সংশ্লিষ্ট সব মহল এ ব্যাপারে তাদের জোরালো তৎপরতা চালাবেন এটি সকলেই দেখতে চায়। তবে এর মধ্যে যে এক গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে এতে কোন সন্দেহেরই অবকাশ নেই। আর সে ষড়যন্ত্রের স্বরূপটি অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলার স্বার্থে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা পাকিস্তান এবং বিএনপি-জামায়াতের আমলে বেকায়দায় ছিল এ কথা মিথ্যা নয়, কিন্তু শেখ হাসিনার অধীনস্থ সরকারের আমলে তারা সরকার দ্বারা নির্যাতিত হয় বা হচ্ছে এ ধরনের অসত্য কথা উচ্চারণের আগে ভদ্রমহিলার একবারের জন্য মনে হলো না যে, এ কত বড় মিথ্যা ভাষণ! তবে এই আমলে কোন কোন ক্ষেত্রে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে, যেখানে কি-না ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বিভ্রান্ত নেতা-কর্মীরা জড়িত ছিল বা থাকে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই সরকারের আমলে একে কোনক্রমেই সাধারণ ঘটনা বলে অভিহিত করা যাবে না নিশ্চয়ই! বরঞ্চ দেখা যাবে ইতোপূর্বে এ দেশ থেকে বহু সংখ্যালঘু ভারতে বা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হলেও বর্তমান সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা দুই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশেই ব্যবহার করা হয়, হচ্ছে এবং হয়ে থাকে। বিএনপি-জামায়াত আমলে এ কথা সত্য ছিল। কেননা, তখন এখানে তালেবানী ও উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সরকার এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা যোগান হচ্ছিল আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ এবং ফের বাংলাদেশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেবার অসৎ ও অসাধু উদ্দেশ্যে। আরেকটি সত্য তথ্য এই সকল এনজিও নেতা-নেত্রীদের চোখে কেন পড়ে না তাও আমার কাছে দুর্বোধ্য! তথ্যটি এই যে, উগ্রবাদীরা বা মুসলিম মৌলবাদীরা কিন্তু শুধু খুঁজে খুঁজে হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘুকেই কতল করছে না, এক্ষেত্রে প্রগতিবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ স্বাধীনচেতা মুসলমানরাও কিন্তু তাদের চক্ষুশূল এবং তারাই দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৌলবাদীদের হত্যা-গুম ইত্যাদির শিকার হচ্ছে। এমনকি, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকা পেশীজীবীরা জমি দখল বা অন্য নানাবিধ নির্যাতন-নিপীড়ন চালানোর ক্ষেত্রে কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদেরকেই বেছে নেয় না, বরং দেখা যাবে যে, স্থানীয়ভাবে বেশিরভাগ নিগৃহীত ব্যক্তিই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত অতি সাধারণ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ। সুতরাং, অসৎ রাজনীতির কাছে সব সময়ই নিরীহ, শান্তিবাদী ও প্রগতিবাদী ব্যক্তিকেই শত্রুরূপে বিবেচিত হতে দেখা যায়। আর তাই এক্ষেত্রে দেশে সংখ্যালঘুদের মৌলবাদীদের একমাত্র টার্গেট মনে করার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। সাতচল্লিশে উপমহাদেশ বিভক্ত হবার পর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার যেখানে ছিল শতকরা ২৯ তা মুসলিম লীগ, সেনা-শাসন ও বিএনপি-জামায়াত প্রভৃতি সরকারের অপশাসনজনিত কারণে ক্রমান্বয়ে কমে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত আমলে মাত্র ৯ শতাংশে এসে ঠেকে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বৃদ্ধি পেয়ে এখন এই হার দাঁড়িয়েছে শতকরা ১১ ভাগে। তার এই উক্তির মধ্যে এক ধরনের বিস্ফোরক লুকিয়ে আছে যা মুহূর্তেই একটি প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিতে পারে! এই সরকারের বিরুদ্ধে তাই কোন স্বার্থান্বেষী মহলের হয়ে তিনি খেলছেন কি-না সেটিও এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে বৈকি! যাহোক, প্রিয়ার এই নালিশের পরপরই ঢাকায় এক বৌদ্ধ মন্দির পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গত আট মাস ধরে অবস্থানকালে তিনি নিশ্চিতভাবে লক্ষ্য করেছেন যে, বাংলাদেশ সত্যিকারেরই ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যরে একটি দেশ। এখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মাঝে আদর্শস্থানীয় গভীর সখ্য ও সম্প্রীতিও যে বিদ্যমান সেটি উল্লেখ করতেও কিন্তু রাষ্ট্রদূত সাহেব ভোলেননি। এই দুরভিসন্ধির পেছনে কেউ কেউ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের হাত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সার্বিক ঘটনাপরম্পরা বিশ্লেষণ করলে এমন সন্দেহ তথা জয়ের এ বিষয়ক পুরো বক্তব্যটিকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাবে না নিশ্চয়ই! বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় কিছু দেশ যে মাঝে মাঝেই কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে এবং স্পষ্টতই যে তারা বিএনপি ঘরানার প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে এর পেছনেও তাদের ‘দুষ্ট রাজনীতি’ রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি ছিল তা কি আমরা জানি না! এবং ’৭১-এ বাংলাদেশে সংঘটিত এত বড় গণহত্যাকে ‘গণহত্যা’ বলে স্বীকৃতি প্রদান দূরে থাক বরং একে বিতর্কিত করার এবং বর্তমান হাসিনা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমকে নস্যাৎ করার বা অন্ততপক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ করার সার্বক্ষণিক অপচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এবং সেসব দেশের শিখ-ী মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং তাদের (ঐ সব দেশের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের) তাঁবেদারদের অর্থানুকূল্যে পালিত বাংলাদেশের বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে যে চলছে ও চলে সে সম্পর্কেইবা আমাদের দেশবাসী কতটুকু ওয়াকিবহাল? হেফাজতের তথাকথিত আন্দোলনকালে আমরা ‘অধিকার’ নামক স্থানীয় একটি এনজিও’র মিথ্যাচারের বিষয়টি নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি! মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের অর্থে লালিত-পালিত স্থানীয় বেশ কিছু এনজিও যে আমাদের দেশে ওদের স্বার্থসংরক্ষণ ও মতলব চরিতার্থ করার কাজে নিয়োজিত ছিল এবং রয়েছে এ কথা এখন দেশের নাবালেগ শিশুদেরও জেনে রাখা দরকার। প্রিয়া সাহার জানা থাকা উচিত, গোটা পাকিস্তান আমলে এবং মুক্তিযুদ্ধকালে সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচার হয়েছে এবং যে কারণে লাখ লাখ সংখ্যালঘু মৃত্যুর মুখে পতিত এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র কম দায়ী নয়। কেননা, মার্কিন সরকার বরাবরই পাকিস্তানের গণবিরোধী ও সেনা-শাসকের নেতৃত্বকে মদদ জুগিয়ে এবং তাদেরকে এই জঘন্য কাজে লিপ্ত থাকতে সাহায্যই করেছে কেবল। মার্কিন দূতাবাসের অভ্যন্তরে জামায়াত ও বর্তমান সরকার-বিরোধী ব্যক্তিদের শক্তিশালী অবস্থানেরইবা ভিত্তিভূমি কি? কেন এই বাংলাদেশবিরোধীরা মার্কিন কর্তৃপক্ষের এত আদর-যতœ পায়? এ বিষয়গুলো জানা ও বোঝা আজ দেশের স্বার্থে দেশপ্রেমিক মাত্রেরই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×