ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে জঙ্গী, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমনে সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ৩০ জুলাই ২০১৯

বাংলাদেশে জঙ্গী, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমনে সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়

(গতকালের পর) সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও যে ধর্মীয় কারণ আছে, এ কথা বলতে অনেকে আড়ষ্ট বোধ করেন। বাংলাদেশে এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়Ñ ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম কোন সন্ত্রাস অনুমোদন করে না, কিংবা বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই, আমরা জাতি হিসেবে অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি। ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙালীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনেক কাহিনী আছে। আবার এই বাঙালী পাকিস্তান আন্দোলনও করেছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, মুসলমান, বাঙালী, পাহাড়ী, আদিবাসী নির্বিশেষে এদের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করেছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যাশায়। ১৯৭২-এ প্রণীত বাংলাদেশের আদি সংবিধানে সেই চেতনাই প্রতিফলিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে- ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের নৃশংস হত্যকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির যে পাকিস্তানীকরণ, মৌলবাদীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ শুরু হয়েছে, তা এখনও বন্ধ হয়নি। ১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল পাকিস্তানের এদেশীয় এজেন্ট স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতে ইসলামীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যে কারণে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম দাবিÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেও জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের দাবি আজও পূরণ হয়নি। ‘২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর কাপুরুষোচিত হামলার প্রধান কুশীলব ছিল জামায়াত। জামায়াত তখন নেপথ্যে থেকে মাঠে নামিয়েছিল হেফাজতসহ স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবরে নাসিরনগরের হিন্দুদের ওপর হামলার জন্য নিঃসন্দেহে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা দায়ী। তবে হামলার আগের দিন জনসভায় হিন্দু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে যারা কদর্য উক্তি করেছে, স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি তাদের শুধু রসরাজ দাসকে উপলক্ষ করে হিন্দুবিরোধী সমাবেশ করার অনুমতি দেননি, স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ২৯ অক্টোবর আহলে সুন্নতওয়ালাদের সমাবেশ যারা করেছে দলীয় পরিচয়ে তারা হে-জা-বি, হেফাজত-জামায়াত বিএনপির অনুসারী। আওয়ামী লীগের স্থানীয় তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বদলি করা হয়েছে, বিএনপির একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তবে হেফাজত-জামায়াত এখনও অধরা থেকে গেছে। এ কথা আমরা রামুর ঘটনাকাল থেকে বলছি- দল থেকে বহিষ্কার বা বদলি কোন শাস্তি নয়, তারপরও এর ভেতর দিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসন কিছুটা হলেও নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করছে, যা বিএনপি-জামায়াত জোটের জমানায় কখনও দেখিনি।’ (বাংলাদেশে আস্তিক-নাস্তিক দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, অনন্যা প্রকাশনী, ২০১৭)। ॥ তিন ॥ বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী আত্মপ্রকাশের পর সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে শত শত কোটি টাকা এনেছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত মাদ্রাসা ও মসজিদ পুনর্নির্মাণ এবং কোরান শরিফ ছাপার জন্য। তখন জামায়াত নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আরব শেখদের বুঝিয়েছেন ভারত ইসলাম ধ্বংসের জন্য পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বানিয়েছে। নয় মাসের যুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্য এবং তাদের এদেশীয় এজেন্ট মুক্তিবাহিনী সব মাদ্রাসা মসজিদ ধ্বংস করেছে, বাংলাদেশে কোন কোরান শরিফ নেই। তারা আরও বলেছেন ইসলাম ও পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার জন্য জামায়াতের রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর হাজার হাজার নওজোয়ান শহীদ হয়েছে, তাদের পরিবারের পুনর্বাসনের জন্যও প্রচুর টাকা প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রাপ্ত বিপুল অর্থ জামায়াত বিভিন্ন শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন ও আবাসন খাতসহ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। জামায়াতে ইসলামীর সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকার যদি অধিগ্রহণ না করে তাহলে শুধু দল নিষিদ্ধ করে কোন লাভ হবে না। অর্থের জোরে ব্যাঙের ছাতার মতো জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন একের পর এক গজাতে থাকবে। ১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ জনশক্তি রফতানি আরম্ভ করে। এরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে পেট্রোডলার যেমন এনেছে, একইভাবে সৌদি ওয়াহাবি সংস্কৃতি ও জীবনধারাও বাংলাদেশে আমদানি করেছে। বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছে এক হাজারেরও বেশি বছর আগে। সুফী সাধকরা বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে স্থানীয় ধর্ম, সামাজিক ও লৌকিক রীতিনীতির সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হননি। তাদের ইসলামে এক ধরনের সমন্বয়ের উদ্যোগ ছিল। প্রচলিত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম এবং লোকায়ত সংস্কৃতির অনেক উপাদান তারা গ্রহণ করেছিলেন। যে কারণে ভারতবর্ষে ইসলাম এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। কট্টরপন্থী ওয়াহাবি মোল্লারা বিভিন্ন সময়ে ইসলাম ধর্মকে শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করেছেন বটে। তবে বাংলার মানুষ ধর্মের নামে উগ্রতা কিংবা গোঁড়ামি কখনও অনুমোদন করেনি। এমনকি হাজী শরিয়ত উল্লাহদের হিন্দু জমিদার ও ইংরেজবিরোধী ওয়াহাবি বা ফারায়েজি আন্দোলন মুসলমান কৃষক কিংবা শহুরে মধ্যবিত্তের কিছু সমর্থন পেলেও তাদের ধর্ম সংস্কারের কট্টর দাবির প্রতি তেমন জনসমর্থন কখনও ছিল না। ওয়াহাবিরা মিলাদ ও মাজার জেয়ারতকে যতই ‘বেদাত’ বা পূজা বলুক না কেন, সাধারণ মানুষ কখনও তা সমর্থন করেনি। সৌদি ওয়াহাবি সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশের চিরায়ত বাঙালী সংস্কৃতি আজ হুমকির সম্মুখীন। তরুণরা আকৃষ্ট হচ্ছে ‘আল কায়দা’, ‘আইএস’-এর ইসলামের নামে সন্ত্রাসের প্রতি। ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশে সৌদি বোরখার আমদানি শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হজের মৌসুম ছাড়াও প্রতিবছর হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে কথ্য ভাষার ক্ষেত্রেও। সত্তর দশকেও মুসলমানরা বিদায় নেয়ার সময় ‘খোদা হাফেজ’ বলতেন। ‘খোদা হাফেজ’, এখন ‘আল্লাহ হাফেজ’ হয়ে আরবীভাষীদের হাসির খোরাক জোগাচ্ছে। নামাজকে এখন ‘সালাত’ বলা হচ্ছে। রমজান মাসকে বলা হচ্ছে ‘রামাদান। রোজাকে আরবীতে ‘সিয়াম’ বলা হচ্ছে। বাংলা কথ্যভাষার আঙ্গিনায় ‘ইনশাল্লাহ’, ‘মাশআল্লাহ’, ‘সোবহান আল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ যেভাবে অনুপ্রবেশ করেছে- যেন আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা আল্লাহ বোঝেন না। ‘খোদা’ ফারসী শব্দ হওয়ায় ‘আল্লাহ’কে ‘খোদা’ সম্বোধন করা ওয়াহাবি সংস্কৃতিতে নাজায়েজ হয়ে গেছে। মাথায় ঘোমটা দিলে চলবে না, শাড়ির সঙ্গে মেয়েদের হিজাব পরা ক্রমশ বাধ্যতামূলক হয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ‘হিজাব সুন্দরী’ প্রতিযোগিতা হচ্ছে, শিরোপা দেয়া হচ্ছে শ্রেষ্ঠ হিজাব পরিধানকারীদের। নির্বাচনের সময় গ্রামে গ্রামে জামায়াতি এনজিওগুলো বিনামূল্যে মহিলাদের বোরখা ও ছেলেদের গলায় ঝোলানোর স্কার্ফ দেয়। যে মেয়ের বাইরে পরার মতো একখানা শাড়িও নেই, সে বিনামূল্যে পাওয়া বোরখা স্বাভাবিকভাবেই লুফে নেবে। তবে এভাবে যে হিজাব বা বোরখার প্রতি আসক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে, এতেও কোন সন্দেহ নেই। সৌদি ওয়াহাবি সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিহত করতে হলে অসাম্প্রদায়িক বাঙালী সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে হবে। মৌলবাদ মনোজগতে অন্ধকারের আধিপত্য বিস্তার করে। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনকে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করে যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে। চেতনার জগতে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর লড়াই তীব্রতর করতে হলে, মানুষের ভালবাসা ও সহমর্মিতা পেতে হলে মানুষকে ভালবাসতে হবে শর্তহীনভাবে। মানুষের সকল আচরণ ও কার্যক্রমের সীমানা নির্ধারিত রয়েছে। নিজের বিশ্বাস, আচরণ বা কর্মকা- যদি অন্যের ক্ষতির কারণ হয় কিংবা হৃদয়বৃত্তি সংকুচিত করে, তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। রাষ্ট্রের আচরণ ও বিধান যা সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে, তা যত উদার ও গণতান্ত্রিক হোক না কেন, মনোজগতে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার আধিপত্য স্থায়ী না হলে অন্ধকারের বোধ ব্যক্তি থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় সংক্রমিত হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ড. কুদরত এ খোদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশন সুপারিশ করেছিলÑ রাষ্ট্রের চার মূলনীতি শুধু সংবিধানে থাকলে চলবে না। বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারা সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করেছিলেন। কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাঁর শিক্ষানীতিকে চিরদিনের জন্য মর্গে পাঠিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষা এবং সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো হয়েছে। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। এই কমিশন একমুখী শিক্ষার প্রস্তাব না করলেও মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সুপারিশ করেছিল। মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন হেফাজতে ইসলামসহ তাবৎ মৌলবাদীদের প্রচ- বিরোধিতার কারণে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। হেফাজতে ইসলাম কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি আদায় করে নিলেও তাদের পাঠক্রমে সরকারী হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হেফাজতিদের দাবির কারণে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক বিবেচনা থেকে সাধারণ পাঠক্রম থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কিছু উজ্জ্বল নির্দশন বাদ দেয়া হয়েছে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার করাল থাবা থেকে কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। আমাদের শিশু-কিশোর-তরুণদের মৌলবাদের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতিনীতি ও শিক্ষানীতির বিকল্প নেই। মানবতা আস্তিকতায় যেমন আছে, নাস্তিকতা ও অজ্ঞেয়বাদেও আছে। চলবে...
×