ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাং বেষ্টিত মিন্নি ও সাম্প্রদায়িকতার নমুনা

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ৩০ জুলাই ২০১৯

গ্যাং বেষ্টিত মিন্নি ও সাম্প্রদায়িকতার নমুনা

আমাদের পক্ষে এখনও নারীকে আর দরিদ্র-নিরক্ষরকে আইনের মাধ্যমে মানবাধিকার দেয়ার মতো শক্তিশালী সমাজ ব্যবস্থা, আইন-আদালত, নিরাপত্তা বাহিনী, প্রশাসন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তা না হলে রিফাত নামক তরুণটির দিনে দুপুরে হত্যার সময় তাকে প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা করার যে দৃশ্যটি ভাইরাল হয়েছে, যারা ফটো তুলেছে এবং তাদের চার-পাঁচ জনও যদি একত্রে বাধা দিতে যেত, তাহলে রিফাত আহত হলেও প্রাণে বাঁচত বলে বিশ্বাস করি। তা ছাড়া ওই মেয়েটি চাক্ষুস সাক্ষী হওয়ার পর যদি হঠাৎ আসামি হয়ে যায়, তা হলে ফটো তোলা কিন্তু হত্যাকা- থামাতে না যাওয়ারা কি হত্যাকা-টির সমর্থক ছিল? ওরা কিন্তু হত্যাকা-টি হতে দিয়েছে! অথচ একটি তরুণী শুধু দু’হাত দিয়ে প্রাণান্ত চেষ্টা করছিল তরুণটিকে রামদার আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য। ভিডিও ফুটেজে তরুণীটিকে অসীম সাহসে ভর করে এক ঘাতককে জাপটে ধরে সরিয়ে দিতেও দেখা গেছে। তবে চার-পাঁচ ঘাতক, যারা হত্যা সংঘটিত করার লক্ষ্যেই এসেছিল, তাদের কাছে নিরস্ত্র তরুণী কতটা অসহায়, সেটি বার বার ভাবছিলাম। আমরা কতক খুনী-গু-ার কথা জানি। সম্ভবত ২০০৮-এর নির্বাচনে মহাজোট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর পর সেগুনবাগিচার ত্রাস হিসেবে পরিচিত এক বিশাল ক্ষমতাধর গু-া-গডফাদারের হাতে প্রথমে ভদ্র, শিক্ষিত ঘরের এক সুশ্রী কিশোরীকে স্কুল থেকে ফেরার পথে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা করা। মেয়েটিকে বেশ কিছুদিন যাবত উত্ত্যক্ত করছিল ওই গু-াটি, যার প্রতিবাদ করেছিল কিশোরীর বড় ভাই। আশ্চর্য এই যে, অসীম ক্ষমতাধর এই গু-ার হাতে কিশোরী নিহত হওয়ার মাস খানেকের মধ্যে বড় ভাইটিও নিখোঁজ ও নিহত হয়। ভাই-বোন দু’জনের হত্যায় সে সময় পুলিশ একটি সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিল যে, দু’জনকে ঘাড়ের পেছন থেকে ঘাড় মটকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল! সে দুটি মর্মান্তিক ঘটনার পর তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সে বাড়িতে গিয়েছিলেন। তবে সান্ত¦না ছাড়া পরিবারটি কি এই দুই সন্তানের হত্যাকা-ের বিচার পেয়েছিল? নাকি ওই গুণ্ডা-খুনী জামিন নিয়ে বহাল তবিয়তে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে! এই ঘটনাটি মনে পড়ল মিন্নির অসহায়তা আন্দাজ করে। পাঠক ভাবুন, আপনার আশপাশের পাড়ার পরিবেশ শাসন করছে কতক গুণ্ডা, খুনী, চাঁদাবাজ। যেখানে কোন ছেলেসন্তানেরও এদের এড়িয়ে ভাল থাকা, পড়াশোনা করা, চাকরি করা কঠিন, সেখানে কিশোরী-তরুণীর স্কুল-কলেজে যাওয়া, এমনকি তাকে যখন এক গ্যাং লিডার বিয়ের প্রস্তাব দেয় অথবা তুলে নিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে করে- তখন সে, তার পরিবার, মা, বাবা, ভাইরা কি কোন দৃঢ় ভূমিকা নিতে পারে? ভূমিকা নেয়ার কথা যাদেরÑপুলিশ, র‌্যাব ও প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু তারা যদি আগে বলা ঘটনার মতো গু-া-খুনী গ্যাং লিডারের কাছে অর্থের বিনিময়ে অথবা ভয় ও আতঙ্কের কারণে ভূমিকা গ্রহণ না করে, তাহলে যা হবার তাই বরগুনার ওই এলাকায় ঘটেছে। এটা অবশ্যই জনপ্রতিনিধির এবং প্রশাসন ও পুলিশের ব্যর্থতা। এমন তো হতেই পারে যে মিন্নির সঙ্গে হয়ত নিহত রিফাত ফরাজীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল, যদিও নিহত খুনী গ্যাং লিডার নয়ন তাকে জবরদস্তি করে কোন কাজীকে দিয়ে একটা বিয়ের কাবিনপত্র জোর করে করেছে। রিফাত ও মিন্নি এই গ্যাং লিডার নয়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে সম্ভবত বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। আমার ধারণা, বহু উদার ছেলের মতো রিফাত মিন্নিকে সামাজিক প্রথা মেনে বিয়ে করে, যা গ্যাং প্রভাবিত সমাজে একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। এই সুশ্রী তরুণীটি যে কোন গ্যাং লিডারের নজরে পড়বে এবং তাকে নিয়ে উপরোল্লিখিত অবস্থার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। ওর স্বামী যে ওকে কলেজে আনা-নেয়া করছিল, সে অনেক স্থানীয় তরুণের মতো নয়নের গ্যাংয়ে হয়ত শুরুতে যুক্ত ছিল। কিন্তু পরে হয়ত সে নয়নের কার্যকলাপ অপছন্দ করে অন্য স্থানীয় নেতার অনুগত হয়ে তার দলে যোগ দেয়। সম্ভবত নয়ন গ্যাংয়ের খুনখারাপিমূলক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকতে এ পদক্ষেপ সে গ্রহণ করে। এটা জানা যে, যখন কোন এলাকা, পাড়া কয়েকটি গ্যাংয়ের দৃশ্যমান, অদৃশ্য শাসনে শাসিত হয়, তখন কম শিক্ষিত তরুণদের প্রাণ ও জীবিকা টিকিয়ে রাখতে তাদের কোন না কোন স্থানীয় নেতার অধীনে সুরক্ষার আনুগত্য রেখে চলতে হয়। এই সত্যটি সম্ভবত সব জেলা, উপজেলায় দেখা যাবে, যেটি বরগুনায় বা উত্তরায় হত্যাকা-ের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছেÑ নয়নের স্থানীয় নেতা-গডফাদারটি এক্ষেত্রে বড় অপরাধী, যার নামোচ্চারণ করতে স্থানীয় জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত। কথা হচ্ছে, কোন জনপ্রতিনিধি যদি এলাকায় গ্যাং তৈরি করে এলাকার জনমানুষকে জিম্মি ও ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখে, তবে সে স্থানের প্রশাসক, পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ তো নুসরাত হত্যা ঘটনায় উদঘাটিত হয়েছে। বরগুনার সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনাটি হচ্ছে, মিন্নিকে স্থানীয় কোন আইনজীবীর সহায়তা দিতে অস্বীকার করা! আমাদের দেশে জঙ্গী-খুনী ২১ আগস্ট হত্যাকা-ের খুনী, এমনকি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য যেখানে আইনজীবী পাওয়া যায়, সেখানে কোন শক্তিশালী ক্ষমতাবানের অঙ্গুলি নির্দেশে একটি অসহায় তরুণীর পক্ষে একজন আইনজীবীও দাঁড়াতে সম্মত হয় না! শেষ পর্যন্ত আইন ও সালিশকেন্দ্র ও অন্য আইনী সংস্থার উদ্যোগে যখন ঘোষণা দেয়া হলোÑ ৪০ আইনজীবী মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য ঢাকা থেকে বরগুনা যাবেন, তখন স্থানীয় একজন আইনজীবীকে বোধহয় গডফাদারটি থলের কালো বেড়াল বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজ উদ্যোগে রাজি হতে নির্দেশ দিয়েছেন। ভিডিওটি দেখে মিন্নি যে অভিনয় করছে, এ কথা কেউ মনে করবে না। রিফাতকে রক্ষায় তার আন্তরিক চেষ্টার কোন ত্রুটি দেখা যায়নি। তা ছাড়া তার চেহারা জুড়ে আছে বেদনামিশ্রিত ভয় ও আতঙ্ক- এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই কেসটিতে মিন্নির সুরক্ষা যেন প্রতিষ্ঠা পায় এবং ওই নয়নের গডফাদারের চেহারাটি যেন জনসমক্ষে উদঘাটন করা হয় এবং একই সঙ্গে বরগুনাকে গ্যাং মুক্ত করে তরুণ, তরুণীদের প্রকৃত নাগরিক হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। এবারে দৃষ্টি প্রিয়া সাহাকে নিয়ে সংঘটিত আমাদের প্রজন্মের জন্য অবিশ্বাস্য এক ঘোরতর সাম্প্রদায়িকতার প্রতিযোগিতার বিষয়ে। প্রথমেই বলব, এ সরকারের মন্তব্য প্রদানকারী কতিপয় নেতা, মন্ত্রী বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে চরম সাম্প্রদায়িক, হেফাজত ও জামায়াতকে বগল চাপড়ানোর অমূল্য সুযোগ দিয়ে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে বিশ্বাসীদের চরম অবমাননা করেছেন। বলা বাহুল্য, বর্তমান আওয়ামী লীগ শুধু যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ থেকে লক্ষ যোজন দূরে বাস করে তা নয়, এদের অনেকে এখন ‘চাটার দলে’ পরিণত হয়েছে। অনেকেই বিএনপি-জামায়াত যেমন জঙ্গীদের জন্ম দিয়ে দেশকে সন্ত্রাসের উপত্যকায় পরিণত করেছিল, তাদের মতোই স্থানীয়ভাবে বহু উপজেলায় সন্ত্রাসী-গুম-খুনের ‘গ্যাং’-এর জন্ম দিয়ে রাজনীতিকে অপরাজনীতিতে পরিণত করছে! বরগুনা, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, গাইবান্ধায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। যারা মন্তব্য করেছেন তারা ২০০১-০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের গু-াদের দ্বারা পূণিমাশীল, আগৈলঝারা, সিরাজগঞ্জসহ অনেক এলাকার হিন্দুর বাড়িঘরে আগুন, লুটপাট ও নারী ধর্ষণের অসংখ্য ঘটনা জানেন ও দেখেছেন। পূর্ণিমা, শেফালীসহ বালিকা, তরুণী, প্রৌঢ়া পর্যন্ত পাড়ার কিশোর, তরুণদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল! এ সময় ধারণা করা হয় অন্তত দু’লাখ হিন্দু মাতৃভূমি বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। যাদের ক্যাম্পের ভিডিও, সাক্ষাতকারের ফিল্ম নিয়ে বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে শাহরিয়ার কবির গ্রেফতার হয়েছিলেন। মন্তব্যদানকারী সবাইকে বলব- ১. ১৯৪৭ এ দেশভাগের সময় ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে লাখ লাখ হিন্দু সে সময় দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। ২. এরপর হিন্দুদের জমি, পুকুর দখলের উদ্দেশে শুরু হয় হিন্দু পুরুষ হত্যা, গুম, যেমন- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিদারাবাদ ঘুম ও হত্যাকা-। এর ফলে দুর্বল নারীর পক্ষে জমি, বসতবাড়ি রক্ষা সম্ভব হয় না। এদের অনেকে সে জন্য দেশত্যাগে বাধ্য হয়। ৩. আমার স্কুল জীবনের ’৫৩ সাল থেকে ’৬১ পর্যন্ত আমার হিন্দু সহপাঠিনী এবং অতি উচ্চ মানের হিন্দু দিদিমনিদের ক্রমান্বয়ে দেশত্যাগ করতে দেখেছি, যারা নিরাপত্তার অভাবে এবং সন্তানের জীবিকার অভাবে ভুগছিল। ৪. হিন্দু পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তানকে বাঁচানো দেখা গেছে কষ্টসাধ্য। ১৯৯৭ সালে সম্ভবত দুই ভাইয়ের পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান অর্নবকে পাখি দেবে বলে প্রতিবেশী এক নিষ্ঠুর মুসলিম পরিবার অতি কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল, যাতে এরা দেশত্যাগ করে এবং এদের কোন উত্তরাধিকারী না থাকে। ৫.নিদারাবাদের নিষ্ঠুর ঘটনা আর অর্নবের হৃদয়হীন নির্মম হত্যা আমার এখনও রাতের ঘুম হরণ করে। অর্নবকে নিয়ে আমি কবিতাও লিখেছিলাম। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম ওই বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত হয়েছিলেন এবং সম্ভবত এর বিচার হয়েছিল। ৬. হিন্দু পুত্র, কন্যা সন্তানের বড় হয়ে জীবিকা লাভ ক্রমেই কঠিন হওয়ায় দেখা যায়, আমাদের সমবয়সীদের পুত্র-কন্যাদের জানের নিরাপত্তা ও জীবিকার জন্য আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও কানাডা পাঠিয়ে দিয়েছে। এগুলো গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। প্রিয়া সাহা পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ড. আবুল বারকাতের গবেষণা থেকে উদ্ধৃত করেছেন, যা সম্ভবত কয়েক দশকের সংখ্যা। তবে, পাঠক এখনও পত্রিকায় খেয়াল করে দেখবেন, খুলনায় একমাত্র পুত্র সন্তানকে বন্ধুরা হাতুড়ির আঘাতে মেরে ফেলেছে। অন্যদিনকে টাঙ্গাইলের কোন হিন্দু স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছে। কোথাও দেখছি সন্ধ্যায় মা পাশের বাড়িতে কিছু চাইতে গিয়ে ফিরে এসে কিশোরীকে ধর্ষিতা ও নিহত অবস্থায় পেয়েছে। অর্থাৎ এই ধরনের ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটছে। কুমিল্লা শহরে আমাদের বান্ধবীর বাবার বাড়ি, ঢাকায়ও ওদের জমি দখল হচ্ছে, যা দখল করেছে ক্ষমতাসীন দলের লোক! যেটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করা হয়েছে। সর্বশেষ কি হয়েছে জানি না। জানি না, প্রিয়া সাহার ঘটনার পেছনে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের কোন গোপন উদ্দেশ্য ছিল কিনা! তবে বিষয়টিকে সরকারের এতটা গুরুত্ব না দেয়াই উচিত হবে। কেননা হেফাজত-জামায়াত, বাঁশের কেল্লা, ধর্মান্ধ জঙ্গীরা আমাদেরও যদি ধর্মান্ধ করে ফেলতে পারে, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কি আদৌ হতে পারবে? লেখক : শিক্ষাবিদ
×