ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্টারনেটের অপব্যবহার রুখতে সামাজিক উদ্যোগ জরুরী

প্রকাশিত: ০৯:১২, ২৮ জুলাই ২০১৯

  ইন্টারনেটের অপব্যবহার রুখতে সামাজিক উদ্যোগ জরুরী

দেশে ইন্টারনেট বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি নানারকম বিবাদে এর অপব্যবহার নিয়েও আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছি। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট খুব সন্তর্পণে আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে আফিমের মতো নেশায় পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারের অপকৌশল এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে- যা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শক্তি নারী ও অপরদিকে সামাজিক উন্নয়নের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়াতে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পাবার পর থেকে আমরা যেসব সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করি তার মধ্যে বাংলাদেশে বেশি পরিচিত ‘ফেসবুক’ যা এখন একটি সত্য-মিথ্যার বাহন হিসেবে কাজ করছে। অন্যান্য দেশে ঠিক এ রকমটি দেখা যায় না বাংলাদেশে যে রকম অপব্যবহার করে এই মাধ্যমটিকে অনেকটা ঘৃণা ছড়াবার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক দেশেই নানারকম বিদ্বেষ ছড়াবার কাজ ‘ফেসবুকে’ সংঘটিত হয়, যদিও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন এসব সত্য-মিথ্যার মিশেল মাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ খুঁজছে। অপরদিকে প্রচলিত যে কয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে সেগুলোর মধ্যে টুইটার জনপ্রিয়তা ও মানের দিক থেকে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ শিখরে আছে। আমাদের দেশে টুইটার খুব একটা জনপ্রিয় নয়, যদিও ভারতসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের মানুষ-এর ব্যবহার করে বেশি। টুইটার কেন আমাদের দেশে খুব একটা ব্যবহার হয় না এই নিয়ে কিছুদিন আগে গণযোগাযোগ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন অনুসন্ধানী গবেষকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। আমরা কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছিলাম যে, টুইটার আমরা কম ব্যবহার করি এর অন্যতম প্রধান কারণ শিক্ষা। আমাদের লেখাপড়ার মান এখনও এমন এক স্তরে রয়েছে যে আমরা গুজব, অপবাদ ও সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের জগতে আকৃষ্ট হয়ে ফেসবুকের অন্ধকার জগতে ঠাঁই নিয়েছি, এখনও জ্ঞান সমাজের মূল দরোজায় পৌঁছাতে পারিনি। যে কারণে অনেকটাই মানসম্মত শিক্ষার উপযুক্ত বহির্প্রকাশ সামাজিক মাধ্যমের কোন পর্বে কেমন করে হতে হবে সে অনুশীলন আমাদের হয়নি। একজন শিক্ষিত মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা তার শুধু কায়িক শ্রমের মধ্যে সীমিত নয়। সৃজনশীল মেধার যথাযথ প্রয়োগের কৌশল একটি সক্ষম উৎপাদক শ্রেণীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণযোগাযোগের মাধ্যমগুলোর সুপ্রয়োগের সুযোগ আমাদের দেশে যথেষ্টই আছে কিন্তু সমস্যা হলো- আমরা প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অনলাইন মিডিয়ায় উত্তরণের ঠিক মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি। এই শিফটিং বা পরিবর্তনের জন্য আমরা কতখানি তৈরি এখনও সে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মিলেনি। কারণ, আমাদের এই নিয়ে কোন কার্যকর গবেষণা নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প তৈরিরও বেশ আগে থেকে যখন তথ্যপ্রযুক্তির অভিগম্যতা বাড়াতে কাজ চলছিল তখন একটি কথা বেশ জোরেশোরে আলোচনা হতো আর তা হলো ‘ই-রেডিনেস’, জাতি হিসেবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি কি-না। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তথ্যপ্রযুক্তি জনপ্রিয় করতে ও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয় সেখানেও একটি বিষয় উপেক্ষিত ছিল অর্থাৎ আমরা একটি বিষয়ে কোন মনোযোগ দেইনি, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগিতা কি হবে? আমাদের সবার মাথায় কাজ করেছে উপার্জন আর সরকার চিন্তা করেছে কেন্দ্রীভূত সেবাদানের। ফলে একটি দ্বন্দ্ব থেকেই গেছে যে, কম্পিউটার শিখে ছেলেমেয়েরা কি করবে? উপার্জনের উপায় কি? নাগরিকেরা সেবা পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত সাধারণ ছেলেমেয়েদের মাথায় কোন বুদ্ধি আমরা দিতে পারিনি। যা যা বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছি তার বেশিরভাগ দিয়েছি ইংরেজীতে শহরের কথা চিন্তা করে। প্রথমে শুরু হলো আউটসোর্সের প্রশিক্ষণ, বিদেশ থেকে কাজ এনে দেশে বসে করে দেয়া। এর ফলাফল নিয়ে কোন ভাবনা এখন আর নেই। স্কুলে-কলেজে ব্যাপক পরিমাণে ল্যাব তৈরি করে দেয়া হয়েছে সেগুলো পাঠদানের জন্য অতি জরুরী ছিল। কিন্তু ফলাফল বিশ্লেষণও জরুরী ছিল, আমরা যাকে প্রসেস ডকুমেন্টেশন বলি তা-ও করা হয়নি। ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র সরকারের কেন্দ্রীভূত সেবাদানের সম্প্রসারণ যেখানে সরকারী হিসেবে কর্ম-সংস্থান হয়েছে আনুমানিক ৮ থেকে ১০ হাজার তরুণের। আর যা হলো সবই ইংরেজী মাধ্যমে, ঢাকার বড় বড় হলে ব্যাপক পরিমাণ সম্মেলন হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কি হয়েছে তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। দেশে প্রতিবছর কর্মজগতে প্রবেশ করছে ২৬ লাখ নতুন কর্ম-প্রত্যাশী। নতুন কর্ম-সৃজন হচ্ছে আনুমানিক ৪ লাখ। অবশিষ্টের একটা ক্রমবর্ধনের হিসাব নিলে দেখা যাবে এই অবহেলিতের সংখ্যা খুব একটা সুখকর নয়। আমাদের ভাবা দরকার এই সংখ্যার মানুষের একটি অংশের জন্যে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোন মেধা তারুণ্যের অবচয় সৃষ্টি করছে কি-না। আমাদের দেশের ইন্টারনেট বাজারের প্রায় সবটাই দখল করে আছে মোবাইল ফোনের সেবা। এর ডাটা কিনে যে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাহক চাইলেই ইন্টারনেট সেবা নিতে পারে ও হিসাব অনুযায়ী প্রায় অর্ধেক গ্রাহক নিচ্ছেও তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের উপযোগিতা কি সেটা আমরা পর্যবেক্ষণ করি না। হালনাগাদ নাগরিক সেবার কোন কিছু আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাওয়া দুষ্কর। কারণ, যেসব এ্যাপ আমরা করেছি সেগুলোর মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার অনলাইন অর্ডার, বিকাশ বা টাকা পয়সার লেনদেনের কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো সর্বজনীন নয়। উবার আমাদের দেশে তৈরি নয়। এর বাইরে গিয়ে আমরা যা যা করছি সবই সীমিত ও দেখা গেছে অনেক ওয়েবসাইটের একটি মোবাইল সংস্করণ করে তাকে এ্যাপ বলা হচ্ছে, যা ব্যাকরণসম্মত নয়। এখানেও আমাদের সঠিক নির্দেশনা দেয়ার দরকার ছিল। ফলে বেশিরভাগ মানুষ যারা গ্রামে বা শহরের চতুর্পাশে বসবাস করেন তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা আর নাগরিকের তথ্য সেবা দিয়েই যদি আমরা ক্ষান্ত থাকি তাহলে যে ইন্টারনেট সংযোগ মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় তার ব্যবহার হবে কিসে? কিছু কিছু দৈবচয়ন গবেষণায় দেখলাম বেশিরভাগই ফেসবুক আর ইউটিউবে ব্যস্ত। অভাবের সংসারে যাদের টাকা পয়সা টানাটানি ডাটা কিনতে তাদের গড় খরচ দিনে ১৮ টাকা। এই টাকার সিংহভাগ যায় মোবাইল ফোন কোম্পানির পকেটে, সরকার তাদের কাছ থেকে পায় ন্যূনতম একটা কর, তাও ঠিকমতো এরা দেয় না। ফলে যে কেউ হিসাব করে দেখতে পারেন কম করে হলেও ১৬ কোটি মানুষের মাত্র ১০ লাখ মানুষও যদি দৈনিক ১৮ টাকা খরচ করে ফেসবুক আর ইউটিউবের পেছনে তাহলে প্রতিদিন কত টাকা নিম্নবিত্ত সাধারণ পরিবারগুলো থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ২ কোটি টাকা! কিন্তু আমাদের উপার্জন কি সেটা ভেবে দেখা দরকার। একটি গুণগত উপার্জন হচ্ছে জ্ঞান আহরণ, কিন্তু সেখানেও তো প্রশ্ন আছে মানের। আমরা কন্টেন্ট ব্যবস্থাপনার জন্য এখনও কোন কার্যকরী নীতিমালা তৈরি করতে পারিনি, ফলে যা খুশি তা-ই ফেসবুকে লেখা হচ্ছে আর ইউটিউবে আপ করে দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে যেসব টোটকা চিকিৎসা ইউটিউবে দেয়া হয় তার ফলাফলের সর্বনাশের চিন্তা আমরা কেন করছি না তা বোধগম্য নয়। ফেসবুকে পরচর্চা করে যে অদ্ভুত সংস্কৃতি আমরা তৈরি করেছি তার থেকে মুক্তি সহজে কি মিলবে? জাতিকে আমরা কোথায় ঠেলে দিচ্ছি? সেই ‘ই-রেডিনেস’ আমরা নিশ্চয়ই এসবের জন্য চাইনি। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবধান ঘুচাতে আমরা যে সর্বজনীন সেবা দিতে চেয়েছিলাম সেই নীতি সমুজ্জ্বল রাখা এখনও অনেক বেশি বাস্তব। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপর তথ্যপ্রযুক্তির বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনী আয়োজন করেছিল, এক পক্ষে সরকারের সেবাগুলোর উদ্ভাবন অপরদিকে সাধারণের উদ্ভাবন প্রদর্শনের ব্যাপক সুযোগ ছিল। এই আয়োজন জেলা ও বিভাগীয় এমনকি উপজেলা পর্যায়েও বিস্তৃত ছিল। এই আয়োজন আবারও শুরু করা দরকার, না হলে ওই অবহেলিতদের জন্য কোন নির্দেশনা প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত যাচ্ছে না। ফলে তাদের ফেসবুক আর ইউটিউব ছাড়া গত্যন্তর নেই। উদ্ভাবনের কিছু নির্দেশক যদি ওইসব আয়োজনে থাকে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও তাতে অংশ নিয়ে মেধা ও সৃজনশীল কাজে নিজেদের যোগ্যতা যাচাই করে নেবার সুযোগ পাবে। এর সঙ্গে কন্টেন্ট পরিষেবার একটি গাইডলাইন সরকারের পক্ষ থেকে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। সাইবার আইন, নিরাপত্তা ও করণীয় সম্পর্কে গ্রামের তরুণদের কাছে বার্তা পৌঁছাবে যা তাদের মনোসংযোগ বিকাশে সহায়ক হবে। সবচেয়ে জরুরী হলো ইন্টারনেট কেমন করে তাদের স্থানীয় পর্যায়ে আয়ের পথ হতে পারে তা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়েই আলোচনা হওয়া দরকার। উপর থেকে আমরা যতই বুদ্ধি পরামর্শ দেই গ্রামে এসব কোন কাজে লাগছে না কারণ তাতে গ্রামের কোন অংশগ্রহণ নেই। কিন্তু অলস মস্তিষ্কের গুণগত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে আর দেশের বর্তমান প্রধান দুই সমস্যা স্থানীয় সন্ত্রাস ও নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলা করতে হলে ইন্টারনেট ব্যবহারের কার্যকর নির্দেশনা থাকা দরকার। দরকার এসব নিয়ে ব্যাপক গবেষণার যাতে জাতি একটা নির্দেশনা পায়। প্রথম থেকেই আমরা বলে আসছিলাম মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট প্রাইভেট ব্যবহারের জন্যে যে রকম উপযোগী তাতে সর্বনাশের ছায়া আছে, কেউ আমলে নেয়নি। আমলে নিলে ইন্টারনেট সেবায় নির্দেশনাযুক্ত তদারকি থাকত। বিদেশের কেউ ইন্টারনেট নিয়েই যা খুশি করতে পারে না, সর্বক্ষণ সেই ব্যবহারকারী তদারকির মধ্যে থাকে। আর আমরা মুড়ি-মুড়কির মতো ইন্টারনেট দিচ্ছি যার অপব্যবহার বন্ধ করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আমাদের ভাবতে হবে যে সর্বগ্রাসী ইন্টারনেট আমাদের ঘরে এসে হাজির হয়েছে তার ‘অপব্যবহার’ থেকে মুক্তির উপায় কি! যারা ইতিহাসের খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন চীনের আফিম যুদ্ধের কথা। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ ও ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এই দুই পর্বে চীনের জনগণ বিশেষ করে তরুণ সমাজকে আফিমের নেশা থেকে রক্ষা করতে তখনকার চীনের রাজ-সরকারকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। বাংলাদেশকে ইন্টারনেটের ক্ষতিকর নেশা থেকে মুক্ত করতে পশ্চিমা বাণিজ্য বুদ্ধিদাতাদের বিরুদ্ধে আমাদেরও সজাগ থাকতে হবে। আমাদের নিশ্চয়ই বুদ্ধির যুক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা আছে, তাকে মনোজগতের অভ্যন্তরে সুপ্ত করে রেখে দেয়ার বিদেশী বাণিজ্যবুদ্ধি নিশ্চয়ই আমরা পরাস্ত করতে সক্ষম হব। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×