ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দরিদ্র তিন মেধাবীর জিপিএ-৫ অর্জন ॥ উচ্চশিক্ষা নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ২৮ জুলাই ২০১৯

 দরিদ্র তিন মেধাবীর জিপিএ-৫ অর্জন ॥ উচ্চশিক্ষা নিয়ে শঙ্কা

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে ॥ দরিদ্র তিন মেধাবীর জিপিএ-৫ অর্জন। এ যেন গোবরে পদ্মফুল। এমনটাই মন্তব্য করছেন এলাকাবাসী ও শিক্ষকরা। ওদের একজন রাজমিস্ত্রির মেয়ে তাহেরুন নেছা, অন্যজন দরিদ্র ঈমামের ছেলে মাসুম ও অপরজন ভূমিহীন প্রান্তিক চাষির মেয়ে শারমিন আক্তার। এত ভাল সাফল্যের পরেও উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শঙ্কায় এসব মেধাবীর পরিবার। জানা গেছে, চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় শিবচর উপজেলার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজ থেকে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জনই হতদরিদ্র পরিবারের জীবন সংগ্রামী। তাদের জীবন সংগ্রামের গল্প তাক লাগানোর মতো। কলেজ কর্তৃপক্ষের বৃত্তি, শিক্ষকদের সহযোগিতা ও স্থানীয়দের দান-দক্ষিণা এবং নিজেদের অধ্যবসায় এনে দিয়েছে সাফল্য। অবর্ণনীয় অভাব-অনটনের মধ্যে কাটে তাদের জীবন জীবিকা। রাজমিস্ত্রির মেয়ে তাহেরুন নেছার টিউশনি, স্থানীয় মসজিদের দরিদ্র ঈমামের ছেলে মাসুম দর্জির কাজ করে এবং ভূমিহীন প্রান্তিক চাষির মেয়ে শারমীন আক্তার জীবনযুদ্ধের বিজয়ী সৈনিক। কলেজে তারেক মোহাম্মদ হায়দার ট্রাস্ট, সালেহ কল্যাণ ট্রাস্টসহ উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বৃত্তি তাদের পথচলায় কিছুটা হলেও সহায়তা জুগিয়েছে। বরাবরের মতো এবার ফলাফলে ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে এই কলেজ থেকে। অর্জন করেছে জেলার শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা। জানা গেছে, শিবচর উপজেলার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছাত্রী তাহেরুন নেছা চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করে। তাহেরুন নেছা শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের চৌধুরী কান্দি গ্রামের মোঃ রফিক মাতুব্বরের মেয়ে। তার মা পারুল বেগম একজন গৃহিণী। ৬ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে তাহেরুন নেছা ৫ম। বাবা পেশায় রাজমিস্ত্রি। নিজের বসবাসের যে ঘরটি আছে তাও তৈরি করে দিয়েছেন তার চাচা। রফিকের দৈনিক আয় মাত্র ৪/৫শ’ টাকা হরে মাসের মধ্যে ১২/১৪ দিন বেকার থাকতে হয়। যেদিন কাজ থাকে না সেদিন এক রকম অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হয়। রাজমিস্ত্রি বাবার একার সামান্য আয়ে চলে পরিবারের ৯ সদস্যর ভরণপোষণ। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী ও মেধাবী তাহেরুন অভাবের কারণে ৯ম শ্রেণী থেকেই টিউশনি শুরু করে। টিউশনি করে যে টাকা পায় তাই দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে মায়ের হাতেও তুলে দেয় অবশিষ্ট টাকা। চাচা মৃত শাহাবুদ্দিন মিয়াসহ স্থানীয় দানশীল চৌধুরী পরিবারের সহযোগিতায় তাহেরুনের বড় ৪ বোনের বিবাহ হয়ে গেছে। মেধাবী হওয়ায় তার প্রতি স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষ ও অন্যান্য শিক্ষকের সহযোগিতা ছিল সব সময়। শিক্ষকরা বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়াতেন-বই নোট দিয়ে তাকে সহযোগিতা করেছেন। খেয়ে না খেয়ে দীর্ঘ হেঁটে কলেজে যাতায়াত করতে হয়েছে তাকে। তাই আজ তার শ্রমের ফসল জিপিএ ৫ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায়ও সে জিপিএ ৫ অর্জন করে। এত ভাল ফলাফল করেও ভবিষ্যত লেখাপড়া নিয়ে শঙ্কিত সে ও তার পরিবার। একই কলেজের আরেক মেধাবী শারমিন আক্তার। চলতি বছর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে সেও জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। শিবচর দত্তপাড়া ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামের ভূমিহীন প্রান্তিক চাষি মোঃ শামীম বেপারীর মেয়ে শারমিন। অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে স্ত্রী তাসলিমা বেগম ও ৪ সন্তানের ভরণপোষণ করেন তিনি। অভাব-অনটনে আচ্ছাদিত শারমিনের পরিবার। ভাল খাবার, ভাল পোশাক কোনদিন জোটেনি শারমিনের কপালে। জন্মমাত্র সে দেখেছে শুধু অভাব আর দারিদ্র্যর অভিশাপে নিমজ্জিত পরিবার। সীমাহীন কষ্টে কাটে তাদের জীবন। তার বাবা-মা চায় শারমিন ভাল কলেজে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অভাবি পরিবারের পাশে দাঁড়াক। কিন্তু ভাল ফল করেও দারিদ্র্যর ভারে নুয়ে পড়া শারমিনের পরিবার তার ভবিষ্যত লেখাপড়া ও উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শঙ্কিত। ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজের মানবিক শাখার ছাত্র মাসুম। সেও চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অর্জন করেছে জিপিএ-৫। বাবা স্থানীয় একটি মসজিদে ইমামতি করেন। মা গৃহিণী। ২ ভাই ২ বোন নিয়ে ৬ জনের সংসার তাদের। তাইত লেখাপড়ার পাশাপাশি দর্জি কাজ শিখে নেয় মাসুম। লেখাপড়ার পাশাপাশি দর্জি কাজ করে পরিবারের চাহিদাও মিটায় সে। কলেজের অধ্যক্ষ ও অন্য শিক্ষকরা তাকে পাঠ্যবই, টেস্ট পেপারসহ বিভিন্ন নোট দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সে স্বপ্ন দেখে বড় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে। তবে দরিদ্রতার কাছে অন্ধকারে বন্দী সে আজ অসহায়। তার চোখে চারদিকে শুধু অন্ধকার আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত। হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে মাসুমের পরিবার। উচ্চ শিক্ষা যেন তাদের কাছে এখন আকাশের চাঁদ।
×