ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেন শরণার্থী হতে হয়েছিল?

প্রকাশিত: ০৯:১১, ২৭ জুলাই ২০১৯

 কেন শরণার্থী হতে হয়েছিল?

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন ল্যান্সনায়েক মেজবাহ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নালিতাবাড়ী থানার অন্তর্গত তন্তর ও মায়াঘাসিতে পাকিস্তানী সৈন্যের একটি টহলদার দলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ১৬জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্সনায়েক মেজবাহ উদ্দিন গুরুতর আহত হন। চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হেয়াঁকো ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ৪জন পাকসেনা নিহত হয়। সিলেটে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ছোটলেখা চা বাগান ঘাঁটি আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। দু’ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা অবস্থান ত্যাগ করে পালাতে শুরু করে। এ যুদ্ধে ৪জন পাকসেনা গুরুতর আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গুরুতর আহত হন। মুক্তিবাহিনীর সিলেটের মনুনদী অবস্থানের ওপর পাকহায়েনার দল অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে ৪ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ২০জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহান বাবুল শহীদ হন। সুনামগঞ্জের বিরামপুরে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর একজন বীর শহীদ হন। ৪ জন গেরিলার একটি দল মতিঝিলের পাওয়ার সাবস্টেশনে প্রবেশ করে এবং ২ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশসহ সব গার্ডদের নিরস্ত্র করে ফেলে। তারা গার্ডদের ওখানে বেঁধে ফেলেন এবং তালা ভেঙ্গে বিস্ফোরক স্থাপন করেন এবং ওই দুই পুলিশকে মেরে ফেলেন। ৮টা ১১ মিনিটে মতিঝিলের পাওয়ার সাবস্টেশন সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যায়। মতিঝিল, শাহজাহানপুর, গোপীবাগ এবং কমলাপুর রেলস্টেশন এরিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পুরো মতিঝিল এলাকা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রেলওয়ে কলোনি দিয়ে যখন লোকজন পলায়ন করছিল ৫০ জন রাজাকার তাদের ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড হামলা করেন এবং গুলি চালান। প্রায় ৮-১০জন রাজাকার ঘটনাস্থলে মারা যায়। ঘাটাইল থানার দেওয়া পাড়া রণাঙ্গনে বর্বর পাক হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে আজকের দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী গেরিলাযোদ্ধারা বীর বিক্রমে বিরামহীন আঘাত হেনে চলছেন। গেরিলা বাহিনীর প্রবল আক্রমণাত্মক তৎপরতার সামনে পাক বাহিনী টিকতে না পেরে তাদের ছাউনিতে ফিরে যায়। মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী গেরিলা স্কোয়াড রাতের বেলা অতর্কিতে তাদের ছাউনি ঘিরে ফেলেন ও মধ্য রাতে অগ্নিসংযোগ করেন। অগ্নি বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসার সময় গেরিলারা ১১ জন রাজাকারসহ ৩৭ জন শত্রুসেনা খতম করেন এবং ১৯ জনকে আহত করেন। এই অগ্নিসংযোগের ফলে শত্রু ছাউনি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। পরদিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টারের সাহায্যে মৃত পাঞ্জাবি সেনাদের উঠিয়ে নেয় আর রাজাকার দের ১১টি লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেয়। সিনেটর প্রক্সমায়ার ও সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি মার্কিন সিনেটে বলেন, অবশ্যই বাংলাদেশের ট্রাজেডির অবসান হওয়া উচিত। গণহত্যা, তা যে ভূখ-েই সংঘটিত হোক না কেন কখনোই সমর্থন পেতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাসবোধের কারণে হাজার হাজার নর-নারী-শিশু বর্বরতার শিকার হবে, তাদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চলবে, কোন সভ্য মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়ের প্রতিই কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেননি, লাখ লাখ অধিবাসীকে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছেন। এসব হতভাগ্য মানুষের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত। পূর্বপাকিস্তানে এখনও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। অধিকাংশ মানুষ সেখানে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তাদের ওপর চরম ব্যবস্থা নেমে আসতে পারে বলে তারা মনে করছেন। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ইতোমধ্যে হাজার হাজার তরুণ গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান সরকার এ মূহুর্তে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সত্যিকার রাজনৈতিক মীমাংসার উদ্যোগ না নিলে কেবল পাকিস্তানে নয়, গোটা অঞ্চলের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পাড়ে। কুষ্টিয়ার ইউনাইটেড স্কুলে কুষ্টিয়ার মুজাহিদদের প্রথম দল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়। কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদ ও আহমদ আলী মুজাহিদদের বাংলা ও উর্দুতে শপথ বাক্য পাঠ করান। কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকার আমির তেহেরি সম্প্রতি পাকিস্তানে সপ্তাহব্যাপী সফর করেছেন। তিনি উভয় অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। রাষ্ট্রপতি আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে তিনি দেখা করেছেন। এখানে তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতকারের একটি বিবরণ দেন। সাম্প্রতিক ঘটনায় এটাই প্রথম লেখা যখন পাকিস্তান গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ দেখতে সাধারণ একটি বাড়ির মতই। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ধীর পদক্ষেপে ওয়েটিং রুমে নিয়ে গেলেন। হৃদয়ে সৈনিক নামের এই কক্ষে যিনি কাজ করেন তিনি একজন চার তারকা জেনারেল। আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু অন্তরে এখনও একজন খাঁটি সৈনিক। এটাই প্রথম পয়েন্ট যার উপর তিনি জোর দিচ্ছেন। তার কাছের সহকারীরা দর্শনার্থীদের জানায় যে- প্রেসিডেন্ট এখনও নিজেকে আর্মি সিইনসি হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালবাসেন। আমরা ইয়াহিয়া খানের সাথে অন্য এক দিন সাক্ষাৎ করেছিলাম যখন তিনি কয়েক দিনের জন্য এ্যাবোটাবাদে ছুটিতে ছিলেন। এটি উত্তর-পশ্চিম পাহাড়ি সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি প্রধান অঞ্চলের একটি যেখান থেকে অনেক বীর সৈন্যের জন্ম হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট কিছু সেনাপ্রধানদের সঙ্গে মিটিং করেন এবং গত গৃহযুদ্ধের অশান্ত ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি আমাদের বলেন, শুরু থেকেই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং একটি নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু সে উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত রয়ে গেল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সত্যিকারের উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতির বাইরে থাকা। আইয়ূব খানের রাজনৈতিক কর্মকা-ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া এবং পুরনো ও নতুন দলের সমন্বয়ে রাজনৈতিক কর্মকা-ের অনুমতি প্রদান।... পাকিস্তান পিপলস পার্টি যারা ভৌগোলিকভাবে দেশের পশ্চিম শাখার মধ্যের আসনগুলোতে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুব কম। ইয়াহিয়া খান আমাদের বিষণ্ণ সুরে জানালেন যে- ‘আমি পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য সকল প্রচেষ্টাই নিয়েছি। আমি এই চেয়ারের প্রতি আগ্রহী ছিলাম না এবং সুযোগ পেলেই আবার সৈনিক জীবনে ফিরে যাব।’ নৈরাশ্য ভাব নিয়ে তিনি জানালেন, তাকে রাজনীতিবিদরাই নিচে নামিয়েছেন যারা নিজেদের কলহই থামাতে অপারগ। এবং পরবর্তী সময়ে যারা দেশ বিভক্তির চিন্তা করছেন। তিনি স্মরণ করলেন কিভাবে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আপসে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন শেখের সঙ্গে দেখা করার জন্য এবং যদিও তার পিন্ডিতে আসা উচিত ছিল। এমনকি আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, আমি বিশ্বাস করি না সে মানুষ সম্পর্কে কি বলা হচ্ছিল এবং ভেবেছিলাম তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চান। আমি জানতাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বৈধ ক্ষোভ ছিল এবং আমি আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, পাকিস্তানকে দুটি পৃথক দেশে বিভক্ত করা হবে না। ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসনের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিমাপে বৃহত্তম একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তাকে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল কারণ শেখ মুজিব বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি পূর্ণ পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রপতিকে অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তবে কিছু মানুষ ও সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মনে করেন এর জন্য কোন প্রচেষ্টা করা হয়নি। এখনো ইয়াহিয়া খান মনে করেন যে- বেসামরিক সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি আমাদের বলেছেন, তিনি আশা করছেন অক্টোবরে ইরানের রাজতন্ত্রের ২৫০০তম বার্ষিকীর আগেই এ ধরনের একটি সরকার হবে। আমি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত আছি। এই মুহূর্তে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সিরিজ উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন যার ভিত্তিতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের শূন্য সদস্যপদ পূরণ করা হবে। আওয়ামী লীগের ডেপুটি যারা ভারতে পালিয়ে গেছেন ধারণা করা হচ্ছে ১৬৮ জনের মধ্যে এরকম সদস্যদের সংখ্যা ৪০ হবে। তাদের কেউ কেউ হয়ত ফিরে আসবে এবং তাদের আসন ধরে রাখতে সক্ষম হবে-যেহেতু তাদের রাজনৈতিক অপরাধের একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু উচ্চ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত অথবা ‘হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, সহিংসতা ও সশস্ত্র ডাকাতিতে দোষী সাব্যস্ত মানুষদের ব্যতিক্রম ধরা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট একথা প্রত্যাখ্যান করলেন যে অনেক আওয়ামী লীগের নেতাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। রাষ্ট্রপতি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান পরিদর্শন করতে যাবেন ও উপনির্বাচন আগামী আগস্টে হবে। একবার শূন্য আসনে উপনির্বাচন হয়ে গেলে জাতীয় পরিষদ অবিলম্বে আহূত হবে। সংবিধান প্রণয়ন এর কাজগুলো শুরু করা হবে এবং একটি সরকার গঠন করতে বলা হবে। ইয়াহিয়া খান জানালেন খসড়া সংবিধান হবে দলগুলোর দাবির ওপর ভিত্তি করে। আমি জানি রাজনীতিবিদরা কি চান এবং আমি আমার উপদেষ্টাদের বলেছি তাদের সব দাবি আমলে নিতে। মনে রাখতে হবে দেশের ঐক্য বজায় রাখার জন্য দরকারি সব ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি কিছু অজনপ্রিয় লোকদের দিয়ে কোন ‘পুতুল বেসামরিক সরকার’ উভয় অঞ্চলে গঠন করবেন কিনা? তিনি বলেন, এটি একটি গুজব এবং একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মনে করেন গুজব ছড়ানো ‘একটি অপরাধ’। ‘আমি গুজবে কান দেই না।’ ‘আমি একজন সৈনিক এবং সবসময় খোলা মনে কথা বলতে পছন্দ করি। আমি ওরকম কোন কৌশল ব্যবহার করি না।’ আমরা জিজ্ঞাসা করলাম তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টির সাহায্যে একটি সরকার গঠন করার ব্যাপারে বিবেচনা করছেন কিনা? তিনি বলেন, ‘আমি চাই পুরো জাতির প্রতিনিধিত্বকারীরা জাতীয় পরিষদে উপস্থিত থাকুক। আমি প্রতিনিধি সভায় একটি বেসামরিক সরকার দেখতে পেলে খুশি হব। সেটা না হলে কোন বিশেষ দল বা ব্যক্তির কাছে ক্ষমতা দেয়া ঠিক হবে না। তিনি বললেন, মামলা হবার পরেই শেখ মুজিবকে খুব দ্রুত বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করা হবে কি-না। তিনি বললেন, এটি সামরিক আইনের ওপর নির্ভর করে। ‘তাকে কোর্ট মার্শালে বিচার করা হবে এবং আমি জানি না আগামী এসেম্বলির আগে তিনি জীবিত থাকবেন কিনা।’ জিজ্ঞাসা করা হলো ভারতে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সম্পর্কে তার সরকারের সিদ্ধান্ত কী? তিনি জানান যে তিনি সবাইকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি জানেন না তার বার্তা ঠিক মতো পৌঁছে দেয়া হয়েছে কি-না। তিনি বলেন, ভারত তার এলাকায় বিদ্রোহীদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করেছে। প্রায় ৩৫০০০ বিদ্রোহীকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। যারা চলে গেছে তাদের দিয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। তিনি আর বলেন, আমি যে কোন সময় যে কোন স্থানে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত আছি - রাজনৈতিক না, বরং মানবিক কারণে।’ কিন্তু তারা আমাদের সব অফার প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য কাজ করছে এবং জাতিসংঘের কাজে স্যাবোটাজ করছে।... ইয়াহিয়া খান বলেন যে সোভিয়েত এবং আমেরিকা সরকার সঙ্কট শুরুর থেকে পাকিস্তানের প্রতি একটি সঠিক নীতি অবলম্বন করেছে তবে তিনি ব্রিটেনের ব্যাপারে একই কথা বলতে পারছেন না। ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে আমাদের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়েছেন এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন। তাদের পররাষ্ট্র সচিব এটা স্পষ্ট করেছেন। কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে আমি আশা করেছিলাম ব্রিটেন আমাদের পক্ষ না নিক অন্তত নিরপেক্ষ থাকবে- এভাবে খোলাখুলিভাবে ভারতের পক্ষ নেবে না। জনাব প্রক্সমায়ার পূর্ব পাকিস্তানে চলমান ব্যাপক গণহত্যা নিয়ে সিনেটে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেন, জনাব প্রেসিডেন্ট, যারা গণহত্যা চুক্তি অনুমোদনে কালক্ষেপণ করেন তারা আমাদের উপকূল থেকে ৮০০০ মাইল দূরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ট্র্যাজেডি উপেক্ষা করতে পারেন না। মার্চ থেকে শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দৃশ্যত দেশকে বলাৎকার করছে, হাজার হাজার পুরুষ, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে যাদের একমাত্র অপরাধ এই যে- তারা হিন্দু। এদেশ ত্যাগ করে যাওয়া সাংবাদিকদের চোখ দিয়ে আমরা বৃদ্ধ ও শিশু, গরিব চাষী, জনতা যাদের কখনই কোন বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে কোন সংযোগ ছিল না তাদের হত্যা করতে দেখেছি। আমি ১৩ জুন লন্ডন সানডে টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের উদ্ধৃতি দেই: পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মার্চের শেষ থেকে শুরু করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এই হলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার কর্তৃক মার্চের শেষ থেকে আরোপিত সংবাদ নিষেধাজ্ঞার পিছনের ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এ কারণেই পাঁচ মিলিয়নের অধিক উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে স্রোতের মতো চলে গিয়েছে, কলেরা এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি নিয়ে। জনাব প্রেসিডেন্ট, এই নিবন্ধটির নামকরণ করা হয়েছে শুধুই ‘গণহত্যা’। পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটে যাচ্ছে ঐ শব্দ তা বর্ণনা করে। আমি ১৩ জুন লন্ডনের সানডে টাইমসে ‘কেন শরণার্থীগণ পালিয়ে গিয়েছিল’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ থেকে আবার উদ্ধৃতি দেই: হাড়-চূর্ণ করা সামরিক অপারেশনের দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর একটি হলো গণহত্যা, কর্তৃপক্ষ যাকে ‘নির্মূল অভিযান’ বলতে পছন্দ করে। আরেকটি হলো ‘পুনর্বাসন প্রচেষ্টা’। এটি হােল পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধীন একটি উপনিবেশে রূপান্তর করার পদক্ষেপসমূহ বর্ণনার একটি মাধ্যম। এই বহুল ব্যবহৃত বিশেষণসমূহ এবং সরকারী দলিলাদিতে পুনঃ পুনঃ ‘দুষ্কৃতকারী’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ উল্লেখ করাও এই হেঁয়ালিরই একটি অংশ যা বিশ্ব কল্যাণে প্রণীত হচ্ছে। অপপ্রচারের আড়ালে বাস্তবতা হলো উপনিবেশ স্থাপন এবং হত্যা করা। গণহত্যা কেবল অতীতের বিষয় নয়। শুধু দেখুন পাকিস্তানে এই মুহূর্তে কি ঘটছে। গণহত্যা কনভেনশন নিয়ে কাজ করতে আমরা আর কত দেরি করতে পারি? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশে বলা হয়েছে, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরু করেছিল, যে যুদ্ধ জন্ম দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য এক আপোসহীন যুদ্ধের। পর্যবেক্ষকরা ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তে তদন্ত করে পাকিস্তানের দাবিমতো এটাই প্রতিষ্ঠা করবে যে, ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে আসছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীন কোন অঞ্চল নেই। বিখ্যাত পশ্চিমা সাংবাদিক যারা স্বাধীন অঞ্চলগুলো ঘুরে রিপোর্ট করেছে তাদেরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জাতিসংঘ পাকিস্তানের মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে। তবুও ভারত তার সীমান্তে জাতিসংঘের তদন্তকারী দলের উপস্থিতিকে অনুমোদন দিবে। বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকার জাতিসংঘের এই সর্বশেষ পদক্ষেপকে শুধু বেআইনী হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর ক্ষমার অযোগ্য হস্তক্ষেপ এবং স্থূল অবমাননা হিসেবে বিবেচনা করছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×