ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

মৃৎ শিল্পের কাছে

প্রকাশিত: ১১:৫৩, ২৬ জুলাই ২০১৯

 মৃৎ শিল্পের কাছে

সবেমাত্র অফিস থেকে এসেছি ঘড়ির কাঁটাতে রাত নয়টা বাজি বাজি। অফিসে খুব কাজের চাপ গিয়েছে। খুব ক্লান্ত এর মাঝে মোবাইল বেজে উঠল। দেখি উত্তম মহারাজ ফোন দিয়েছেন। ফোন ধরার পর ওপরপ্রান্ত থেকে মহারাজ বললেন- ‘কিরে কেমন আছিস?’ আমি বললাম ভাল। মহারাজ বললেন- শুক্রবারে তুই কি ফ্রি আছিস। আমি বললাম এখন পর্যন্ত আছি। তুই ফ্রি থাকলে তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব তবে ওই জায়গায় পৌঁছার আগে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। আমি বললাম ঠিক আছে, মহারাজ বললেন- তবে তুই শুক্রবার সকাল সকাল প্রস্তুত হয়ে নিস। আমরা সকাল সাতটার মধ্যে রওনা দেব। আমি বললাম মহারাজ এত সকাল ... বারে শুক্রবার তাই আরেকটু পরে বের হই মহারাজ বললেন- ঠিক আছে তাহলে আমরা সকাল আটটায় রওনা দেব। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে মহারাজটা কে। রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন তাদের মহারাজ নামে ডাকা হয়। বৃহস্পতিবার ঘড়ির কাঁটাতে রাত এগারোটা মোবাইলে ফোন বেজে উঠল। মোবাইল ধরতেই মহারাজ বলে উঠলেন কি রে মনে আছে তো কাল সকাল সকাল বের হতে হবে। আমি জিহ্বায় কামড় দিলাম আয় হায় আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি বললাম ঠিক সময়ে ফোন দিয়েছেন মহারাজ। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তাই সময় নষ্ট না করে প্রথমে ক্যামেরার ব্যাটারি বের করে চার্জে দিলাম। পরে মোবাইলের ঘড়িতে এ্যালার্ম দিয়ে নিদ্রা দেবীর কোলে আবিষ্ট হলাম। এই বুঝি ভোর হলো ভেবে ভেবে আমার চোখের ঘুম দূর হবার উপক্রম। এর মাঝে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি একটু ও টেরই পাইনি। মোবাইলে এ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ভোরের মিষ্টি হাওয়া জানালার ফাঁক দিয়ে হু হু করে ঢুকছে। আমি আরও কাঁথা টান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কপালে ঘুম না থাকলে যা হয় একদিকে মোবাইলের এ্যালার্মের শব্দ অন্যদিকে মা’র ডাকা ডাকি। না পারতে সাধের ঘুম থেকে উঠেতেই হলো। ঘুম থেকে উঠে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। ফোন দিলাম পাইলট ফরহাদ কে, ও বলল বাসার নিচেই আছে চলে আসার জন্য। গাড়িতে চেপে বসলাম আমার সঙ্গে আমার ভাই। ও খুব অলস বলা চলে আমার থেকে একগুণ বাড়িয়ে। যার দরুন ওকে নিয়ে তেমন একটা কোথাও যাওয়া হয় না। মহারাজ আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন শুনে ও আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। আমরা চার চাকার বাহন নিয়ে প্রথমে গেলাম সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশনে সেখান থেকে মহারাজকে নিতে হবে। মিশনে সামনে আসতেই মহারাজের দেখা পেলাম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন সঙ্গে আরও কয়েকজন। গাড়ি থেকে নামতেই মহারাজ বললেন এই কিছু খেয়ে নে তোদের জন্য ভুনা খিচুড়ি, সবজি রেখেছি। প্রথমে না বলেছিলাম পড়ে লোভ সামলাতে পারলাম না। অন্যদিকে ভুনা খিচুড়ি আমার খুব প্রিয় খাবার। গরম গরম ভুনা খিচুড়ি সঙ্গে সবজি অসাধারণ স্বাদ। পেট পুরে খেয়ে মহারাজকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। শুক্রবার তাই রাস্তায় তেমন একটা জ্যাম নেই। মিরাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা হয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। সূর্যদেবের আভা সারা সড়কজুড়ে তির্যকভাবে পড়েছে। এর মাঝেই আমরা চলছি এগিয়ে। মহারাজ শুরু করলেন গল্প নরসিংদীতে বুঝি একটি মন্দির আছে মহারাজ গত সপ্তাহে গিয়েছিলেন সেখানে বুঝি সব ভক্তদের চার পাঁচ পদের মাছ দিয়ে আহার করানো হয়। আর মাছ ও খুব টাটকা খেতে ভারি স্বাদ। মহারাজকে বললাম কি কি মাছ দিয়ে আহার করলেন। মহারাজ বললেন- ছোট মাছ, চাপিলা মাছ, রুই মাছ, বাউস মাছ, কৈ মাছ দিয়ে। আর তাদের পরিবেশন পদ্ধতিও বেশ ভিন্ন। আমার তো এত আইটেমের নাম শুনে জিহ্বায় জল আসার যোগার। মহারাজকে বললাম কবে আমাকে নিয়ে যাবেন। মহারাজের এক কথায় উত্তর তুই যখন যেতে চাবি তখনই নিয়ে যাব। তবে সকাল সকাল রওনা দিতে হবে। উত্তম মহারাজের কথা সঙ্গে চলছে গাড়ি। এবার আমাদের বিরতি নেয়ার সময় এসে গেছে। আমরা লামাকাজি বাজার পেরিয়ে এসে পৌঁছেছি গোপীনাথ মন্দির বিশ্বনাথে। সেখানে সবাই মহারাজের অপেক্ষায় ছিলেন। মহারাজের জন্য বেশ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা মহারাজের সঙ্গী হিসেবে বেশ আপ্যায়িত হলাম। বিভিন্ন রকমের ফল, লুচি, সবজি, হালুয়া, মিষ্টি, দই, পায়েস। এত বাহারি খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। সব কিছুই চেখে দেখলাম। ভোজন পর্ব শেষ করে আমরা চললাম আমাদের গন্তব্য পানে। আমরা চলছি পথে প্রান্তরে দিকে প্রকৃতির মোহনীয় রূপ আমাদের মোহিত করছে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাবার সড়কটি অসাধারণ। দুই পাশের সবুজ গাছ পালা আপনাকে মোহিত করবে নিশ্চিত। গোবিন্দগঞ্জ, জাউয়ার বাজার পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম পাগলা বাজারে। মহারাজ বললেন- এবার বাজার থেকে হাতের বাঁয়ে যেতে হবে। আমরা পাগলা বাজার থেকে হাতের বাঁয়ে আমরা ঢুকলাম। গ্রামীণ পরিবেশ কিছুদূর যাবার পর মহারাজ বললেন- এবার আমাদের গাড়ি থেকে নামতে হবে। আমাদের বাকি পথ পদব্রজে যেতে হবে। আমরা এগিয়ে চলছি গ্রামীণ পথ ধরে পথের ধারে বয়ে চলছে প্রবাহ মান নদী শাখা। গ্রামীণ মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছালাম পালপাড়ায়। আমি এত সময় পর মহারাজের গন্তব্যের নাম না বলার কারণ বুঝতে পারলাম। অতি সাধারণ পরিবেশ কিন্তু খুব ছিমছাম। নেই কোন কোলাহল। যে যার কাজে ব্যস্ত। মহারাজ বলছিলেন বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়েই পরিচিত হয় সেই দেশ বা জাতি। একেকটি শিল্পের বিস্তারের পেছনে রয়েছে একেকটি দেশ বা জাতির অবদান। তেমনই একটি শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প। ‘মৃৎশিল্প’ শব্দটি ‘মৃৎ’ এবং ‘শিল্প’ এই দুই শব্দের মিলত রূপ । ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর ‘শিল্প’ বলেত এখানে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে তৈরি সব শিল্পকেকর্মকেই মৃৎশিল্প বলা যায়। এই ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের কুমার বলা হয়। প্রাচীনকাল থেকে বংশনুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। অতীতে গ্রামের সুনিপণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেকাংশ বেশি। পরিবেশবান্ধব এ শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে। এখানে ৭০টি পরিবার আছে যাদের জীবন ধারণ এই কাজের ওপর নির্ভরশীল। পালপাড়ায় প্রবেশের পর আমরা দেখতে পেলাম প্রত্যেকের বাড়ির আঙ্গিনায় তাদের তৈরিকৃত দ্রব্য সামগ্রী রোডে শুকাতে দিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মাটির খেলনা, পাতিল, প্রদীপ, কলস আরও কত কি। মহারাজকে পেয়ে সবাই খুব খুশি। আমরা ঘুরে ঘুরে তাদের কাজগুলো দেখলাম। কেউ মাটির পুতুল বানাচ্ছে, কেউ বানাচ্ছে মঙ্গল প্রদীপ। দীপাবলি আসন্ন বলে অনেকেই মঙ্গল প্রদীপ বানাতে ব্যস্ত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এখানকার সবাই এই কাজ করেন। আট বছরের বালক থেকে শুরু করে নব্বই বছরের বয়স্ক লোকটি কাজ করছেন। কথা হলো সুনিতি রুদ্র পালের সঙ্গে বললেন- তারা এই কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজ করতে পারেন না। দশ পুরুষ ধরে এই কাজ করে যাচ্ছেন। সুনিতি দুঃখের সঙ্গে বললেন- তারা অনেক কষ্ট করে মাটির কাজগুলো করেন কিন্তু ঠিকমতো দাম পান না। এর মাঝে মাটির পণ্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের সামগ্রী। তাদের অনেক সময় অনাহারে থাকতে হয়। ভেবে খুব কষ্ট লাগল। আমাদের এই প্রাচীন মৃৎশিল্পকে আমরা মূল্যায়ন করছি না। তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি না। এমন এক সময় আসবে প্লাস্টিক সামগ্রীর ভিরে এই প্রাচীন শিল্পের কারিগররা হারিয়ে যাবেন কালের অতলে। আমরা পুরোপাড়া ঘুরে বেড়ালাম উত্তম মহারাজের সঙ্গে। দরিদ্রতা তাদের গ্রাস করছে তবু তাদের আপ্যায়নের কমতি নেই। আমাদের আপ্যায়নের জন্য নানা ধরনের ফল, পায়েস, বিস্কুট নিয়ে হাজির। কীভাবে যে চার ঘণ্টা পার করে ফেললাম বুঝতেই পারলাম না। এবার আমাদের বিদায় নেয়ার পালা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য মৃৎ শিল্পের এই জাদুকরদের ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। তবুও আমাদের ফিরে যেতে হবে শহরপানে এবং যুক্ত হতে হবে কর্মে। যাবেন কিভাবে : পাগলাবাজার যেতে হলে আপনাকে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জগামী সরাসরি বাস রয়েছে তাতে উঠতে হবে। এনা, হানিফ, শ্যামলী, ইউনিকসহ অনেক বাস এই পথে চলে। সুনামগঞ্জ পৌঁছার আগেই পাবেন পাগলাবাজার। সেখান আপনাকে নামতে হবে। পাগলাবাজার থেকে হাতের বাঁয়ে গেলে কিছুদূরে দেখা পাবেন ছোট একটি ব্রিজের। ব্রিজ পাড়ি দিয়ে কিছুদূর গেলেই দেখা পাবেন পাল পরিবারের। অথবা প্রথমে সিলেট শহরে ট্রেন অথবা বাসে করে গিয়ে পরে গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন পাগলাবাজার।
×