ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাহাত রাব্বানী

নিভৃতচারী দুঃখের কারিগর

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ২৬ জুলাই ২০১৯

নিভৃতচারী দুঃখের কারিগর

কলম দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার ফসলি জমিকে যে ক’জন কবি উর্বর করে তুলেছেন কবি মহাদেব সাহা তাঁদের অন্যতম একজন। ষাটের দশককে আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ দশকের কবিতায় স্বাধিকার, মুক্তিসংগ্রাম, বিপ্লব ছিল প্রধান সুর। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এ যুগের কবিতায় বৃহৎ অংশজুড়ে বিস্তৃত। ষাটের দশকের এ অস্থির সময়ের কবি হয়েও মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় এনেছেন নতুন বাঁক। অনেকটা ব্যক্তিজীবনের মতোই চুপচাপ, মিতভাষী। সৌন্দর্য সচেতনা, নদী-ফুল-পাখি, প্রেম-বিরহ তাঁর কবিতাকে নিয়ে যায় তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তায়। মহাদেব সাহা হয়ে ওঠেন প্রেম ও প্রকৃতির কবি। প্রেম ও প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পান জীবনের অন্য এক মাদকতা। কবিতা পাঠকদের মাঝে মহাদেব সাহার এক বিশেষ পরিচয় তিনি প্রেমিক কবি। তাঁর প্রেমের কবিতা হৃদস্পর্শী, আবেগময়। কবিতায় তিনি যে প্রেমের চিত্র এঁকেছেন তা কামগন্ধহীন। বাংলা প্রেমের শাশ্বত রূপটিই সহজভাবে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়, জীবন্ত হয়ে উঠেছে প্রেম ও প্রকৃতি। ‘তুমি যদি আমাকে না ভালবাসো আর/ এই মুখে কবিতা ফুটবে না,/এই কণ্ঠ আবৃত্তি করবে না কোন প্রিয় পঙ্ক্তিমালা’; ‘একবার তোমাকে দেখতে পাব/এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-/বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার হব ভরা দামোদর’; ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও,/খামে ভরে তুলে দিও/আঙুলের মিহিন সেলাই/ভুল বানানেও লিখো প্রিয়,/বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,/এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও’ ; ‘ভালবেসে যে নারীকে প্রথম চুম্বন করি কোন একদিন/ ওষ্ঠ তার হয়ে ওঠে দীপ্ত স্রোতস্বিনী/ ঝর্ণার কল্লোল নামে তার সারাদেহে’ -এসব হচ্ছে মহাদেব সাহার প্রেমজ উচ্চারণ। প্রেমজ শব্দ উচ্চারণ সহজ হলেও প্রেমের কবিতা লেখা সহজ নয়। অত্যধিক জটিল। একইভাবে কবিতার মাধ্যমে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলা আরও কঠিন। এই কঠিন কাজগুলোই অতি সহজে করেছেন ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহা। প্রেম ও প্রকৃতি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার মনে মানুষের প্রতি প্রেমবোধ জাগ্রত হয় না, থাকে না মানুষের প্রতি ভালবাসা সে সাধারণত প্রকৃতির কাছে যেতে পারে না। নারী প্রকৃতিরই অন্যতম এক অংশ। দুটোর মধ্যেই সৌন্দর্য, আকর্ষণ ও মুগ্ধতা আছে। আছে হৃদয়ের টান, আকুতি ও উচ্ছ্বাস। যে যত বেশি নারীকে ভাল বেসেছে, বুঝতে পেরেছে সে ততবেশি প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়েছে। তবে নারী প্রেমের চেয়ে মানবপ্রেম কখনও কখনও সবকিছুকে ছাপিয়ে কবিসত্তাকে মহিমান্বিত করেছে। প্রেম ও প্রকৃতির ভেতর দিয়েও গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায় মহাদেব সাহার কথায়, কবিতায়। কবি মহাদেব সাহা দুঃখের কারিগর। বার বার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন নিজেকেই ক্ষয় করে। নির্মোহভাবে নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখেছেন নিজেরই ভেতর। তাই তাঁর কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে আত্মমগ্ন, যন্ত্রণাবিদ্ধ, বিপন্ন কবির অসাধারণ অবলোকন, নিজের দুঃসহ একাকীত্ব ও অসহায়ত্বের নিখুঁত চিত্র। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। মানুষের কাছেই গিয়েছেন। মানুষের কথা বলেছেন। নির্ণয় করেছেন মানুষেরই বিশুদ্ধ ভালবাসা। সংবেদনশীল একজন প্রকৃত কবির জীবনপরিণাম মহাদেব সাহার যাপিত জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রবল বেদনাবোধ ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। কিন্তু জীবনের এই গোধূলি বেলাতে এসেও নিরাশা নামক ব্যাধি তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। নৈরাশ্যের মধ্যেও তিনি জাগিয়ে রাখেন আশা ও প্রত্যয়। তিনি বলেন, আমার আর কিছুর দরকার নেই। না অর্থ, না পুরস্কার। তোমাদের এত এত ভালবাসা পাচ্ছি, এত এত ভালবাসা দিচ্ছ আমাকে তা কম কিসে? কতজনের ভাগ্যে জুটে? আমি অনেক পেয়েছি। আর পাওয়ার নেই। প্রেম ও প্রকৃতির কবিতার মতোই মহাদেব সাহার রাজনৈতিক কবিতাও সমান জনপ্রিয়। এদেশের সকল গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে অসামান্য ব্যঞ্জনায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ঘাতকদের হাতে নিহত হওয়ার পর যে দুজন কবি প্রথম কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিলেন মহাদেব সাহা তাঁদের একজন। লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা ও সেই নির্মম ট্র্যাজেডির অশ্রুসজল পঙ্ক্তিমালা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তাঁর বহু কবিতা যেমন মানুষের মুখে মুখে তেমনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর কবিতা দিয়ে রচিত হয়েছে পোস্টার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এগারো-বারো বছর বয়সী মহাদেব সাহার কণ্ঠে একবার স্বরচিত কবিতা শুনেছিলেন। পরম আদরে চুমো খেয়েছিলেন কবির কপালে। আশীর্বাদ করেছিলেন মহাদেব সাহা অনেক বড় কবি হবেন। স্রষ্টা তাঁর আশীর্বাদ ফেলেনি। মহাদেব সাহা কবি হয়েছেন, শুধু কবি নন, হয়েছেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। কৈশোরে লেখালেখির শুরু হয় কবি মহাদেব সাহার। প্রেম, বিরহ, স্বদেশ ভাবনা, নিসর্গসহ জাগতিক জীবনের নানা অনুষঙ্গকে উপজীব্য করে কবি মহাদেব সাহা এখনো চলমান রেখেছেন তাঁর কাব্যচর্চা। বিরল কাব্যপ্রতিভা নিয়ে আপন মহিমায় নির্মাণ করেছেন রোদেলা আলো ঝলমলে তাঁর কবিতার পৃথিবী। তাঁর কবিতায় ভেসে আসে ভিন্ন এক জগত। যে জগত অতি চেনা হয়েও অচেনা, কাছের হয়েও দূরের, ধোয়াশার আড়ালে থেকেও অতিসাধারণ, যার কারণে তাঁর কবিতা আলাদাভাবে শনাক্তযোগ্য। আর একারণেই তাঁর প্রতিটা কবিতাই পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী। তাঁকে নিয়ে কবিতা পাঠকেও আগ্রহও বিস্তর। কাব্যপ্রতিভার জন্য লাভ করেছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। পুরস্কারের সমুদয় টাকা মেহনতি মানুষের জন্য খরচ করেন তিনি। অত্যন্ত নির্মোহ এই কবি তাঁর নীতি থেকে সরে দাঁড়াননি ন্যূনতম। এরশাদ শাসনামলে সাংবাদিকদের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে মহাদেব সাহাকেও এই জমি নিতে অনুরোধ করলে তা তিনি গ্রহণ করেননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কবিকে উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরি প্রদান করলেও তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। ইচ্ছা করলেই গড়তে পারতেন বাড়ি, গাড়ি। কিন্তু তিনি বার বার ফিরে এসেছেন কবিতার টেবিলে। কবিতার জন্যই বিনিয়োগ করেছেন পুরোটা জীবন। নিজেকে ভেঙেছেন, নিজেকে গড়েছেন। কবি মহাদেব সাহা ১৯৪৪ সালে সিরাজগঞ্জের এক ছায়াঘেরা পাখিডাকা সুন্দর-মনোরম পরিবেশে আঁকা ধানঘড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৫ আগস্ট কবির ৭৬তম জন্মবার্ষিকী। বয়সের ভারে অনেকটা ক্লান্ত দেশের অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহার দেহে বাসা বেঁধেছে জটিল সংক্রামক। জীবন সায়াহ্নে এসে একাকীত্বকে সঙ্গ করে যন্ত্রণাদায়ক এই ব্যাধি নিয়ে বাসার বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন নির্মোহ এই কবি। যন্ত্রণাদায়ক এই ব্যাধির চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে তা কবির পরিবারে করানো সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাও সাহিত্য প্রিয় মানুষ। নিজেও লেখক। কবি ও কবিতার প্রতি আলাদা দরদ আছে তাঁর। বরেণ্য এ কবির ব্যয়বহুল চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষ থেকে নেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কৃপাদৃষ্টি কামনা করছি। দেশের মাটি, ফুলের ঘ্রাণ, পাখির গান, মেঘ, বৃষ্টি, নদী, জল, জোছনা সঙ্গী করে এ পৃথিবীতে তিনিও বেঁচে থাকতে চান।
×