ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গৌরব জি. পাথাং

শ্রাবণের গান

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ২৬ জুলাই ২০১৯

শ্রাবণের গান

শ্রাবণের মেঘগুলো আকাশে জমতে শুরু করেছে। আমার উদাসী মন আকাশ পানে তাকিয়ে বৃষ্টির প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে। কখন আসবে? ও কি আসবে নাকি আসবে না? বজ্রপাত ঘণ্টার মতো আওয়াজ তুলে সভা সমাপ্তির ঘোষণা দিল। মনে হলো, এখনই বৃষ্টি নেমে আসবে। বৃষ্টি না এলেও ফোনে একটা মেসেজ এলো। ফোন খুলে দেখলাম বাগেশ্রীর মেসেজ। ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন কাছে যাব, কবে পাব, ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।’ কাছে আসার এই আকাক্সক্ষা, এই ব্যাকুলতার উত্তরে লিখলাম, ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, তুমি চলে এসো এই বরষায় এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে, জলভরা দৃষ্টিতে, এসো কোমল শ্যামল ছায়। যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।’ প্রতিত্তোরে সে লিখল, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তোমাকে আমার মনে পড়েছে’ আমি লিখলাম, ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে ভুলিও স্মৃতি মম নিশিথ স্বপনসম’ এমনিভাবে বৃষ্টির দিনে বাগেশ্রীর সঙ্গে মেসেজ আদান প্রদান সমাপ্ত হলো। কিন্তু মনের মধ্যে এক অতৃপ্তি বাসনা, অসমাপ্ত খেলা চলমান রয়েছে। কে কাকে হারাবে তারই অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে। গানের বাণীতে একজন আরেকজনকে ক্ষতবিক্ষত করার প্রতিযোগিতা। তাই রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতের সমুদ্রে ডুব দিয়ে মুক্ত আহরণের মতো দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় অবিচল থেকে এক এক করে সঙ্গীতের শাখা-প্রশাখা, নাম জানা অজানা নদ-নদীতে ডুব দিয়েছি। আহরণ করেছি সুর-সঙ্গীতের মূল্যবান মণি-মুক্তো। সঙ্গীতের ডালি সাজিয়ে এখন প্রতিদিন প্রতীক্ষায় থাকি কখন অনলাইনে পাব তাকে। মনের জানালা খুলে উঁকি দিয়ে থাকি। কখন তাকে দেখতে পাব, কখন সে দেবে ধরা। মেসেজ দিলাম, ‘কেন দূরে থাকো, শুধু আড়াল রাখো কে তুমি, কে তুমি, আমায় ডাক? উত্তর এলো, ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও—-’ আমি লিখলাম, তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল, ক্লান্তদুপুর বেলা তুমি আমার সারা দিনমান, তুমি আমার সারাবেলা’ সে ছোট ক’রে লিখল, ‘বেশি কিছু আশা করা ভুল’ তারপর আর কোন মেসেজ নেই। অনলাইন বন্ধ হয়েছে নাকি বন্ধ করে দিয়েছে তাও বুঝতে পারলাম না। দিন পেরিয়ে রাত হলো, রাত পেরিয়ে ভোর হলো কিন্তু কোন দেখা নেই তার। বিনিদ্র রাতে লিখে পাঠিয়েছিলাম, ‘যদি বন্ধু হও, যদি বাড়াও হাত যেন থামবে ঝড় মুছে যাবে রাত’ দিনের আলো ফুটে উঠার সঙ্গে সঙ্গে তারও উদয় হলো। কিন্তু আমায় নিরাশ করে দিয়ে সে লিখল, ‘প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ, আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ’ আমিও ছাড়বার পাত্র নই। তাই লিখলাম, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়, মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো’ সে লিখল, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে দেখেছি” আমি লিখলাম, ‘ তুমি দূরে দূরে আর থেকো না, এ চোখে চেয়ে দেখো না ভালবেসে আমাকে ঐ হৃদয়ে বেঁধে রাখো না।’ বাগেশ্রী লিখল, ‘যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে এসো গান করি মেঘমল্লারে করুণধারা দৃষ্টিতে।’ আমি লিখলাম, ‘তুমি হাতটা শুধু ধরো আমি হব না আর কারো তোমার স্বপ্নগুলো আমার চোখে করছে জড়োসরো’ দ্বিতীয় দিনের বাণী আদান-প্রদানের খেলা এমনি করেই সমাপ্ত হলো। অনুভব করলাম, বাগেশ্রী হয়তো আমার প্রেমে ধরা দিয়েছে। প্রেমে পড়েছে বলেই তো বৃষ্টিতে ভেজার আমন্ত্রণ জানিয়েছে, ‘এসো হাত ধরো, চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে।’ এখন শুধু বৃষ্টির অপেক্ষা। দু’জনে বৃষ্টিতে ভেজার প্রতীক্ষা। বাগেশ্রীর বাবা-মা দু’জনই খুবই সঙ্গীত অনুরাগী। তাই শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন বাগেশ্রী। বাগেশ্রী রাগে নজরুল সঙ্গীত ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে উড়াই ঝরাফুল একেলা আমি’ গানটি শুনতে শুনতে বাগেশ্রী নামটাই তাদের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। তাই জন্মের পরই শিশুটির নাম রেখেছিল বাগেশ্রী। বাবা মায়ের আশা তাদের মেয়ে একজন শিল্পী হোক। বাগেশ্রীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে। খুব দরদীকণ্ঠে এই গানটি গেয়েছিল ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান আমি দিতে এসেছিলেম শ্রাবণের গান’ তার সুমধুর কণ্ঠ দিয়ে সেই দিন শ্রোতাদের বিমোহিত করেছিল। আমিও আনন্দ আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে দেখা করে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি। যদি সময় দেন তবে দুটি কথা বলতে চাই। বিনীতসুরে বললেন, ‘নিশ্চয়, বলুন’ ‘চমৎকার গেয়েছেন। গানটি আমার হৃদয় ছুঁয়েছে।’ সে ছোট্ট করে বলল, ‘ধন্যবাদ’। ‘ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন? আমি তো ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কিছুই করিনি। বরং আপনিই ধন্যবাদ ও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।’ ‘আপনার কণ্ঠ ও দক্ষতার প্রশংসা না করেও পারছি না। আপনি কঠিন গান সাবলিল কণ্ঠে, খুব সহজ করে মধুর মত শ্রোতাদের খাইয়ে দিতে জানেন। কোথায় শিখেছেন?’ ‘এখনও শিখছি, শান্তিনিকেতনে। আর আপনি?’ ‘ছায়ানটে, আমিও শিখছি। আমারও খুব ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করার।’ ‘তা করেননি কেন?’ ‘তা হয়ে উঠেনি। আপনার মতো ভাগ্য কি আমার আছে?’ ‘আপনি ভাগ্যে বিশ্বাস করেন?’ ‘বিশ^াস নয়, তবে সান্ত¡না’ ‘সত্যি তাই। আসলে কি জানেন? ভাগ্য আমাদের গড়ে নিতে হয়’ ‘গড়ে নিতে পারিনি বলেই তো —-’ ‘থাক আর বলতে হবে না। চলুক এগিয়ে যাই।’ ‘কিন্তু যাবেন কি করে? মেঘ ঘনিয়ে আসছে। আপনার হাতে তো ছাতাও দেখতে পাচ্ছি না’ ‘ভিজেই যাব। ভিজতে ভাল লাগে তাই।’ ‘বর্ষামঙ্গলে এসেছেন অথচ ছাতা নিয়ে আসেননি যে? আসুন, ঐ টুকু পথ না হয় একসাথেই যাই’ ‘না, না আপনিই যান। নইলে দু’জনকেই ভিজতে হবে’ ‘আসুন না। আজ না হয় দু’জনই ভিজলাম’ বাগেশ্রীর ছাতায় আশ্রয় নিয়েও রক্ষা পেলাম না। ঐ অভদ্র-অবাধ্য বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়েই দিল। ও ধানমন্ডিতে বাসার সামনে নেমে গেল। আর আমি ভেজা কাপড়ের অস্বস্তিতে তাড়াতাড়ি তেজগাঁও চলে এলাম। এক সপ্তাহ পর শান্তিনিকেতনে ফিরে এলাম। কিন্তু আগের মতো মন বসাতে পারছি না। বার বার কেবলই মনে হচ্ছে, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার।’ এক অজানা অস্থিরতা-শূন্যতা অনুভব করছি। বাগেশ্রীকে খুব অনুভব করছি। অনুভব করছি দেহ আর মন পৃথক হয়ে গেছে। দেহ কলকাতায় আর মন আছে ঢাকায়। মনকে সান্ত¡না দিয়ে বললাম, আর এক বছর অপেক্ষা কর। শান্তি নিকেতনের নীরব-নির্জনতা যেন বাগেশ্রীর কথাই বলে। একা আর ভাল লাগে না। নিঃসঙ্গতা বড় কষ্ট দেয়। শান্তি নিকেতনের মূল মন্ত্রই হচ্ছে, ‘সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং’ অর্থাৎ ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি।’ কিন্তু সেই প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি আজ গেল কোথায়? কেন নিজেকে একা একা মনে হচ্ছে? একদিন খবর পেলাম বাগেশ্রীর বাবা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন। খবর পেয়ে দ্রুত দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দেশের মাটিতে পা রাখতেই ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়লাম। ফলে পদ্মা নদীর তীরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলো। বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলতে শুরু করলাম। কিন্তু আর পারা গেল না। ঝড়ের কবলে পড়ে নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের বিরতি নিতেই হলো। এক ঘণ্টা পর গাড়ি ছাড়ল। ভাবলাম আর সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা ছাড়তেই চায় না। সম্মুখে দেখতে পেলাম রাস্তার ওপর গাছের ডাল আমাদের পথ অবরোধ করে রেখেছে। সব বিপদ-বাধা পেরিয়ে রাত দশটায় বাগেশ্রীর দরজায় এসে দাঁড়ালাম। সে নিজেই দরজা খুলে দিল। তাকে দেখে সান্ত¡নার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। চোখের জলে বুক ভেসে যাওয়ার চিহ্ন দেখতে পেলাম। শুষ্ক শীর্ণ যেন কোন বাসী গোলাপ। দু’হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে অস্ফূত কণ্ঠে বললাম, ‘যেখানে ঘর বাঁধব আমি আসে আসুক বান তুমি যদি ভাসাও মোরে চাইনে পরিত্রাণ।’ মৃতের সমাধি দেওয়ার কাজ চুকে গেছে। চোখের জলও শুকিয়ে গেছে। কিন্তু দাগ এখনও বিদ্যমান। তবু আমাকে শান্তি নিকেতনে ফিরতে হবে। তাই বিদায় নেবার জন্য তার রুমে প্রবেশ করলাম। গিয়ে দেখি ও বিছানায় শুয়ে গান শুনছে। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে। সব যে হয়ে গেল কালো নিভে গেল দীপের আলো আকাশ পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে’
×