ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘পাঠ্যবই’ কবিতার শারীরিক রূপ বদলে দিয়েছে

প্রকাশিত: ১১:৩৯, ২৬ জুলাই ২০১৯

 ‘পাঠ্যবই’ কবিতার শারীরিক রূপ বদলে দিয়েছে

বাংলা কবিতায় তিরিশ-চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ-ষাট কাল নানাদিক থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অনেক পুরনো বিশ্বাস, পুরনো মূল্যবোধ ভেঙে যাচ্ছে, অতি দ্রুত কোথাও কোন শূন্যতা সৃষ্টি করেই জন্ম নিচ্ছে নতুন-নতুন বিশ্বাস, স্বাভাবিক কারণেই সেই নতুন চিন্তা-চেতনা কবিতায়ও শারীরিক রূপে প্রবেশ করেছে। সারা বিশ্বে দস্যুতারকালে সমসময়ের দোলাচল, দ্বন্দ্ব, প্রেম, সংঘাত-সংশয়-জর্জর কবিদের মতো নব্বই দশকের কবি মুজিব ইরম যথেষ্ট সচেতন কিন্ত তিনি অন্যান্যা কবিদের মতো বিদেশী কবিদের বিমুগ্ধ আবেগ ও মননের সঙ্গী না হয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির কাব্য-পুরাণ কাহিনী এক কথায় দেশীয় ঐতিহ্য চেতনার পথ ধরে হাঁটতে থাকেন। সমসময়ের পাঠকদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেন, ‘ ভালা থাইকো তোমরা সবে আমি খবর লইবো, দুঃখী ইরম জিতে মইলে কার কী আর অইবো।’ সময় সচেতনতার এবং অনুভবের নান্দনিক স্বতঃস্ফূর্ততার থেকেই জন্ম নেয় সার্থক ও সময় অতিক্রান্ত কবিতা। দেশীয় ঐতিহ্যের মানবিকতা ও দেশাত্মবোধের যুক্তিবাদে স্থিত প্রত্যয়ী কবির কবিতায় নতুন ঊষার স্বর্ণদ্বারের স্থান মিলেছে। নিজ সময়ের সত্য-সুন্দর, ব্যথা-বেদনা, অতীতানন্দ, সুখ-অসুকের স্মৃতি শিক্ষিত-অশিক্ষিত মুখের প্রচলতি ভাষায় ‘পাঠ্যবই’ কাব্যগ্রন্থে বয়ান দিয়ে কবি মুজিব ইরম নিজকালের অন্যান্য কবিদের মতো সচেতন থেকেই অন্যান্য কবিদের চেয়ে অনেক উচ্চকণ্ঠ- প্রত্যক্ষ অবয়বে বিষয়ের কাব্যরূপ দিয়েছেন। এই কারণেই বাংলা কবিতাবংশে মুজিব ইরম সমকালীন কবিদের মধ্যে কিছু পরিমাণে স্বতন্ত্রবাসী। তাঁর এই স্বাতন্ত্র্য অনেকাংশে কবির নিযত্নে চিন্তা-চেতনারই পরিণতি। সময়ের ও সময়ের মানুষের প্রয়োজনেই সমাজ বাস্তবতারও কিঞ্চিত প্রকাশে কবিকে প্রবক্তার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে কিছু সত্যভাষণ করতেই হয়। পিতামহ জানে জন্মভোরে তোমার নামের ধ্বনি কান্না হয়ে বাজে নালিহুরী গ্রামে। আমারও কি তবে বাস ছিল টুঙ্গিপাড়ায়? এ নামের কলঙ্গ রবে-ধানমন্ডি বত্রিশের নামে যদি না রচি আজ কান্নার জিকির। —মুজিব-পাঠ্যবই-পৃ. ৬১ এই যে বিবেক ও মূল্যবোধে পৌনঃপুনিক উদ্বোধন ঘটানো ও চাষ করানো একজন সৎ কবির সামর্থ্যরে অন্তর্গত ব্যাপার। এত সব আজ জানি মিথ্যে হয়ে যায় স্তব্ধ হয় নিব দীর্ণ হয় বুক লিখতে পারিনি আমি পিতা হারানোর শোক। -পিতা, ‘পাঠ্যবই’-পৃ. ৬০ রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের বিপর্যয় ও বিভ্রান্তিই এ যুগের নিয়ন্তা। সেই হাওয়া বদলে যায় দ্রুতলয়ে। কিছু মানুষ ভুলতে থাকে আদিকাল, আন্দোলন, জাতীয়তা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা। ‘পাঠ্যবই’-এ পঞ্চান্নটি কবিতায় পরিষ্কার আঞ্চলিকভাষা, হারিয়ে যাওয়া কতেক শব্দে আমাদের জানিয়ে দেয় ক্লাসেও এ পাঠ্যবই আজ কত জরুরী! অকৃত্তিমভাষা, ছন্দের স্বাভাবিকতা ও সৌন্দর্য রক্ষা করে চিন্তা-চেতনা ও অনুভূতির সামঞ্জস্য রেখে কীভাবে কল্পনার অতিচার গতি প্রশমন করে। আবার চিত্ররূপময় প্রতীক উদ্ভাবন করে দৃষ্টির সূক্ষ্মতা ও সৃষ্টির ইঙ্গিতময়তা দেয়-এই কুলজীগ্রন্থে কাটাকাটা উচ্চারণে গদ্য-পদ্যের চর্চা কেমনে হালনাগাদের খতিয়ানে যোগোন্বয় করে এবং সহজ ভাষা-ছন্দে পাঠমহলে জাদুমুগ্ধতার আকর্ষণ ছড়ায় সেই রীতি গ্রহণ করেছেন প্রাগ্রসর কবি মুজিব ইরম। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর কাব্যধারায় এই জাদুমুগ্ধতা-ই বেশিরভাগ কবিতার মূল চাবিকাঠি বলে প্রতীয়মান হয়। দিও তুমি দেহধূলি, দিও তুমি ঘামের শরীর, শান্ত নিরবতা। সত্যি আমি ফিরে এলাম, সত্যি আমি ঘরের মানুষ। দিও তুমি সান্ত¡নার ঢেউ, স্রোতের উজান, তেঁতুল জলে শীতল দুপুর, কাগজী লেবুর ঘ্রাণ। দিও তুমি পাখার বাতাস, নিমের ছায়ায় শুশ্রুষার হাত, দিল উচাটন গান। আহা, কতদিন হয় নিজ ইদারায় নিজের মুখের ছায়া দেখিনি! কতদিন হয় তুকমা জলে তৃষ্ণা মিটেনি! -ফেরা, পৃ: ৪৭ এ যেন কবির আত্মজীবনেরই এক টুকরো। যে-জীবনে বাস করেছেন তিনি। ‘আমি, কান্নাকাটি, দেশী কবিতা, ফকিরি কবিতা, জিওল কবিতা, চিরচর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সহজ সুন্দরী, মা রাঁধতেন, পত্রপুঁথি, দয়ার দরবেশ, রাধাভাব, ছন্দশাস্ত্র, লোকনিন্দা, দস্তুরখানা, কিরাণ কিরাণি, হারানো বিজ্ঞপ্তি, গীত, ছিঠি, পাঠ, মোরাকাব্য, জন্মদিনে ক’লাইন, জন্মরোগ’ সহ এরকম আরও কোলাজ এ কুলজী গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই তো ছিল সামান্যই চাওয়া, আটে-চাইরে বউ রাঁধবে মেহমানদারি খাবার, দুধেভাতে থাকবে খুশি ঘরভর্তি শিশু। -নামধাম, পৃ. ৫০ এ কারণেই কবিতা আমাদের ভাবায়-পাঠকমনে তার নিত্যপাঠ কীভাবে হয় কবি মাত্রই জানেন! কবিবংশের ঋণ কীভাবে শোধ করতে হয় সেটা এই গ্রন্থের কবি ভাল করেই মেনেছেন! সমর মজুমদারের প্রচ্ছদে চৈতন্য একুশে বইমেলা (২০১৯) চারফর্মায় একশত ষাট টাকা মূল্য রেখে প্রকাশ করেছে এমন অবিনাশী কবিতা গ্রন্থ। ফেলে আসা অতীত আতাতুর্ক কামাল পাশা হয়ত ইন্টারমিডিয়েটে কোন একটা প্রবন্ধে পড়েছিলাম, ‘যাহারা কখনো গ্রাম দেখেন নাই বা রেলগাড়ির জানালা দিয়ে গ্রাম দেখিয়াছেন’... সে কথাটি যে আজকের প্রজন্ম অর্থাৎ থ্রি জির ক্ষেত্রে কতখানি প্রযোজ্য তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অন্তত ‘ফেলে আসা অতীত’ পড়লে আজকের থার্ড জেনারেশন কথাটির মর্মার্থ মনেপ্রাণে বিশে^স করতে পারবে। মোস্তাক আহমেদ তাঁর দূর অতীতের ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর ও বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের দিনগুলোকে অত্যন্ত সহজভাবে প্রকাশ করেছেন এ বইতে। বইটি আমাদের মতো সেকেন্ড বা ফাস্ট সিঁড়ির জেনারেশনের কাছে অমূল্য উপন্যাসের মতো মনে হবে যাঁরা গ্রামে তাঁদের শৈশব কাটিয়েছেন। হয়তবা তাদের কাছে এটি চিত্তাকর্ষকও মনে হবে। আর তৃতীয় বা আজকের প্রজন্মের কাছে কৌতূহল সৃষ্টকারী কাহিনী মনে হতে পারে। সাহিত্য বিচারে এটি শরৎচন্দ্র বা আদি লেখকের গ্রাম্য সমাজ, গৃহদাহ, দেনা পাওনা বা বিভূতিভূষণ ঘরানার একটি উপন্যাসের মতো মনে হবে। যেমন, মোস্তাক আহমেদ লিখেছেন, ‘প্রাইমারীর একেবারে শুরুতে আমরা কলা পাতায় লিখতাম। কয়লা গুঁড়া করে পানিতে ভিজিয়ে কালি করে বাঁশের কঞ্চির আগার সম্মুখভাগ দাঁতে কামড়িয়ে থেঁতলিয়ে এর সঙ্গে কয়লার কালি মিশিয়ে কলা পাতার ওপর আমরা অ, আ, ক, খ ও ১, ২ লিখতাম। বাড়ির কাজও আমরা একই করতাম। দেখা যেত স্কুলে যেতে যেতে লেখা পাতার ওপর লেপ্টে যেত। একটু বড় হলে অর্থাৎ টু থ্রি পড়ার সময় শ্লেটে লিখতাম। চক দিয়ে কাঠের কালো শ্লেটে লেখা। এটা ছিল কলা পাতার পরবর্তী ধাপ। কলা পাতা থেকে উত্তরণের পর শ্লেটকে তখন আভিজাত্যের প্রতীক মনে হতো। মনে হতো আমি উন্নত জাতে উঠেছি। প্রথম প্রথম শ্লেট পেয়ে মহা খুশি। লিখে কি রকম আবার মুছে ফেলা যায় লিখি আর মুছি। লেখাপড়ার জগতে শ্লেট আমাদের কাছে নবযাত্রার সূচনা করল। এভাবেই আনন্দ আর উৎসাহের মাঝে নিজেরাই বর্ণমালা ও ধারাপাত মুখস্থ করে ফেলি। আমাদের কাগজ ও কলমের যুগে পদার্পণ করতে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।’ (পৃ-৩১) লেখক তাঁর শৈশব নানা বাড়িতে কিছুকাল এবং দাদা বাড়িতে কাটিয়েছেন। তখনকার দিনে সদ্য জমিদারী প্রথার অবসান এবং সমাজের সাধারণ মানুষের এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা বহু যুগ ধরে চলে আসা সমাজ ব্যবস্থায় যে বেশ প্রভাব ফেলে তার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাবে লেখক বড় হয়েছেন এবং প্রত্যেক স্তরের বা সময়ের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন নির্লোভ ব্যক্তিত্বে। নানাবাড়ির জমিদারি অবস্থার অবসানেও তাঁদের নানা পরিষ্কার ধোপদুরস্ত ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরতেন, তাঁর ছেলেরাও তাই, অথচ ঘরে ফিরে এসে উপোস হয়ে শুয়ে থাকতেন। এমন চিত্র বোধকরি অনেক প্রবীণ, যাঁরা গ্রামে তাঁদের শৈশব কাটিয়েছেন, তাঁরা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। মাত্র ১১২ পৃষ্ঠার বইটি ১২ পয়েন্টে বেশ ঠাসাঠাসি করে গ্রামীণ জীবনের ও লোকালয়ের অনেক অসাধারণ তথ্য আনা হসেছে যা আজকের দিনে রেফারেন্স হিসেবে সংরক্ষণ করার মতো। আর লেখক নিজের প্রকৃত পরিচয়, পারিবারিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র যেভাবে নির্লোভ ব্যক্তিত্বে লিখেছেন এবং হুমায়ূন আহমেদ ও শরৎচন্দ্রের মতো সরল ভাষায় লিখেছেন তাতে আরও বলিষ্ঠ রূপ পেয়েছে তাঁর ছেলেবেলা। লেখক ফাইভে ফার্স্টবয় ছিলেন, অথচ বৃত্তি পাননি, এ কথা নির্দ্বিধায় বলে গেছেন। ‘কার্তিক ও চৈত্র মাস ছিল ভরা আকালের মৌসুম। সিংহভাগের ঘরেই তখন খাবার থাকত না।’ (পৃ-২৯)। এ সত্য বোধকরি আজকের কেতাদুরস্ত অনেক সচিবও স্বীকার করবেন। ‘জুতা বা প্যান্টের ব্যবহার সেকালে খুব একটা ছিল না। যারা কদাচিৎ প্যান্ট পরত তাদের ‘ভদ্রলোক’ বা ‘বড়লোক’ বলা হতো। গ্রামে কেউ প্যান্ট পরে আসলে আমরা হা করে তাকিয়ে দেখতাম।’ (পৃ-৩৫) মহাবিদ্যালয় থেকে বিশ^বিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত এবং শেষে এবং ছাত্র জীবনে বাড়ি থেকে আসা টাকার অপর্যাপ্ততা মেটাতে অনেককে যেমন টিউশনি করতে হতো লেখককেও টিউশনি করতে হয়েছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বেশ দূরে মগবাজারের কাছাকাছি স্থানে। আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক দিনগুলোর কথা অনেকের মনে আছে, বাথরুম, পায়খানার কথাও মনে আছে, মনে আছে, ভাঙা দরজাবিশিষ্ট পায়খানায় বসলে গান গাইতে হয়, তাতে করে অন্য জনের কাছে লজ্জায় পড়তে হতো না, এসব বিষয়ও সুন্দরভাবে লিখেছেন মোস্তাক আহমেদ। এভাবে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষশেষে এসে স্মৃতিকথা শেষ করেছেন। তবে বড্ড বিরক্ত লেগেছে লেখক বর্ণনায় একই সঙ্গে ইংরেজী, বাংলার কথ্যরূপ, এমনকি কিছু হিন্দী শব্দও এনেছেন। বইয়ের ফ্ল্যাপে দেখা যায় লেখকের আরও দু’একটি বই প্রকাশ পেয়েছে, সেখানে লেখক কেমন করে এসব শব্দ ব্যবহার করতে অনুমোদন করলেন তাঁর বইয়ে। যেমন, সাঁই (হবে সায়), বয়সের রেঞ্জ, ম্যাচুরড (হবে ম্যাচিওর্ড), ‘অভিমুখে’ (হবে অভিমুখে), ‘ক্যাটেগরি মোতাবেক’, ‘পরিবেশের সঙ্গে এডজাস্ট করে লোটা-কম্বল নিয়ে’, ‘খাহেশ’ হবে খায়েশ, (পৃ-৯২), ‘ফল ফ্রুটস, ইত্যাদি। কিছু অসমাপিকা ক্রিয়ারও ত্রুটি আছে যেমন, ‘ঢুকা’ (হবে ঢোকা), খুলা (হবে খোলা), ‘ওঠেছিলাম (হবে উঠেছিলাম)। কিছু শব্দের বানান বিরক্তিকর রকম ভুল। কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুুল্লাহ’ উপন্যাস, বা আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ উপন্যাস যেমন একটি জনপদের বর্ণনা দেয়, ঠিক সে রকমই একটি সময়ের ও জনপদের একটি অনন্য সুন্দর বর্ণনা এই ‘ফেলে আসা অতীত’ হিসেবে মননশীল পাঠকদের মনে হবে।
×