ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রূপ বদল শ্রাবণেরও ॥ প্রকৃতির খেয়ালি আচরণ

প্রকাশিত: ১০:০৫, ২৬ জুলাই ২০১৯

রূপ বদল শ্রাবণেরও ॥ প্রকৃতির খেয়ালি আচরণ

শাহীন রহমান ॥ শ্রাবণ মানে সারাদিন মেঘে ঢাকা আকাশ। সকাল থেকে রাত অবধি রিমঝিম বৃষ্টি। প্রেম, ভালবাসা, কবিতা, গান কত কিছু রচিত হয়েছে শ্রাবণ ঘিরে। মাসটির প্রকৃতি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যত কবিতা, গল্প লেখা হয়েছে অন্য কোন মাসের প্রকৃতি বর্ণনায় তা স্থান পায়নি। শহুরে জীবনের বৃষ্টিময় শ্রাবণের সন্ধ্যাটা যেন সবার ভাল লাগার একটা মুহূর্ত। কিন্তু শ্রাবণের সেই চিরচেনা বৈশিষ্ট্য যেন আর নেই। বৃষ্টি নেই, মেঘ নেই, প্রকৃতিতে চলছে একটানা দাবদাহ। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী গত বৈশাখ মাস থেকেই শুরু হয়েছে তাপপ্রবাহ। তা থেমে থেমে এখনও চলছে। এবারে যে তাপপ্রবাহ প্রকৃতিতে বয়ে যাচ্ছে তা নিকট অতীতে দেখা মেলেনি। মধ্য শ্রাবণে এসেই দাবদাহে জীব ও প্রকৃতি যেন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। শুধু শ্রাবণ নয়, পুরো ষড়ঋতুতেই প্রকৃতি যেন খেয়ালি আচরণ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা দেশের ষড়ঋতুর ওপর ভালভাবেই জেঁকে বসেছে। ঋতুবৈচিত্র্যের ধরন পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শীতকালে শীতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্ষায় বৃষ্টিও হচ্ছে না। শীত শেষে অকাল বৈশাখীর দাপট বয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্ম আসার আগেই শুরু হচ্ছে তাপপ্রবাহ। বর্ষায় এসে বজ্রপাতে মানুষ মরছে। শ্রাবণের আকাশ মেঘে ঢাকা থাকছে না। দাবদাহে অতিষ্ঠ মানুষ। প্রকৃতির এই উল্টাপাল্টা আচরণের কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও বর্তমানে দৃশ্যত এখন আর ৬ ঋতুর দেখা পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইতোমধ্যে ঋতুর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। কারও কারও মতে ঋতুবৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী ৩টি ঋতু আবার কারও মতে ৪টি ঋতুর অস্তিত্ব রয়েছে। তিন অথবা চার ঋতু যাই হোক না কেন, আগের আর ৬টি ঋতুর সন্ধান যে পাওয়া যায় না তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শ্রাবণ মাসেই প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঋতুবৈচিত্র্যের ধরন একটু বিশ্লেষণ করলে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ঋতুবৈচিত্র্য অনুযায়ী আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও এ সময়ে ঠিকমতো বর্ষা আসছে না। আষাঢ় ও শ্রাবণ প্রায়ই বৃষ্টিহীন থাকছে। শ্রাবণে কিছুটা বৃষ্টিপাত হলেও ভাদ্র- আশ্বিনে গিয়ে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরতের আবহাওয়া এখন বর্ষার মতো হয়ে পড়ছে। আষাঢ়-শ্রাবণে গরম ও তাপমাত্রা বাড়ছে। আষাঢ় শুরু হওয়ার সময়ই মৌসুমিবায়ু প্রবেশের কথা থাকলেও এটি এখন আর সময়মতো আসছে না। দেরিতে আসার কারণে বৃষ্টিপাত দেরিতে শুরু হচ্ছে। ফলে বর্ষা শেষ হতে সময় লাগছে। শীতে দেশের বিভিন্নস্থানে নদী ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারাচ্ছে দেশের নদীকবলিত এলাকার লোকজন। এবারের বাংলা বছরের হিসাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অকাল বৈশাখী দিয়ে শুরু হয়েছে বসন্তের যাত্রা। বৈশাখের শুরুতে প্রকৃতিতে শুরু হয়েছে তাপপ্রবাহ। তা এখনও অব্যাহতভাবে চলছে। দেশে ১০ জুন মৌসুমিবায়ু প্রবেশ করলেও বৃষ্টির দেখা মেলা কঠিন হয়ে পড়ছে। মাঝ কয়েকদিন দেশের কয়েকটি বিভাগে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে ঠিকই। এর বাইরে বৃষ্টিপাত হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। শ্রাবণ মাসেই ঢাকায় এখন পর্যন্ত বড় বৃষ্টির দেখা মেলেনি। প্রচ- তাপপ্রবাহ আর ভ্যাপসা গরমে নগর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। আষাঢ় অনেকটা বৃষ্টিহীন থেকেছে। শ্রাবণে বর্ষার পানি আসতে দেখা যায়নি। যে বন্যা এখন চলছে তা উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, শ্রাবণও বদলে যাচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণে বাংলাদেশে দিন দিন বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। পঞ্জিকার পাতায় ৬টি থাকলেও অনেকের মতে এখন ঋতু দৃশ্যমান ৩টি। কেউ কেউ বলছেন গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত তিন ঋতুর মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে বসন্ত, শরৎ ও হেমন্ত। এখন শরতের আবহাওয়া মনে হয় বর্ষার মতো। হেমন্ত ও বসন্ত যেন মিশে যাচ্ছে শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যে। বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয় না। সময়মতো মৌসুমিবায়ুর দেখা মেলে না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হেঁয়ালি আচরণ চলছে বিশ্ব আবহাওয়াতেও। বিশ্বের এক অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিক খরা, অন্য অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ বন্যা, জলাবদ্ধতা। কোথাও ঘূর্ণিঝড়, কোথাও সাইক্লোন। কোনও এলাকায় প্রচন্ড শীতের সঙ্গে পড়ছে মাত্রাতিরিক্ত বরফ, কোন কোন এলাকা হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে মানুষের জীবন। তারা বলছেন, প্রকৃতির নিয়মেই আবহাওয়ায় ক্রমবিবর্তন আসছে। এর সঙ্গে সব ক্ষতিকর কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে মানুষের সৃষ্ট নানা উপসর্গ। চলতি বছরেও শুরু থেকেই আবহাওয়া বেশ ব্যতিক্রম আচরণ করছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই আবহাওয়া তার রুটিন মেনে চলছে না। সুমেরু বা কুমেরু অঞ্চল থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বে এ পরিবর্তন দৃশ্যমান। মেরু অঞ্চলে বরফের স্তর ক্রমেই কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, বায়ু দূষণ, কলকারখানার দূষণ, অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনসহ নানা কারণে আবহাওয়ার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ‘বর্ষে যদি মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ’ এই প্রবাদবাক্যের মতো দেশে মাঘের শেষ বৃষ্টিপাত শুরু হয়। কিন্তু বৈশাখের শুরুতেই তাপপ্রবাহ শুরু হয়। তা থেমে থেমে এখন অব্যাহত। মে মাস থেকে তাপপ্রবাহের মাত্রা অতিক্রম করতে থাকে। কিন্তু মের শেষ সপ্তাহে সাগরে ঘূর্ণিঝড় ফনির প্রভাবে দু’একদিন দেশে বৃষ্টির দেখা মেলে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় চলে যাবার পরই আবার তাপপ্রবাহ স্বমহিমায় হাজির হয়। আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষা ঋতু হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বাংলায় বর্ষা আসার পরও কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা মেলেনি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্ষায় মূলত বৃষ্টি হয় মৌসুমিবায়ুর কারণে। কিন্তু মৌসুমিবায়ু জুনের ১০ তারিখে দেশে প্রবেশ করেছে। এর প্রভাবে কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা নেই বললেই চলে। আষাঢ়ের শেষে এসে চট্টগ্রাম-সিলেটসহ কয়েকটি বিভাগে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড় ধস ও বন্যা দেখা দেয়। এছাড়া উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে এখন উত্তরাঞ্চল পানির নিচে রয়েছে। অথচ দেশে ভরা শ্রাবণে বৃষ্টি নেই। আকাশে মেঘ নেই। আবহাওয়া অফিস বলছে, দেশে মৌসুমিবায়ু সক্রিয় অবস্থায় না থাকার কারণেও এই শ্রাবণে কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশে মেঘ জমছে না। এর বিপরীতে চলছে কাঠফাটা রোদ্দুর। সঙ্গে যোগ হয়েছে বাতাসের জলীয়কণা। তারা বলছেন, এই সময়ে বেশি পরিমাণ আর্দ্রতা থাকার কারণে তা গরম হয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত আবহাওয়ার এমন বিরূপ আচরণ চলছে। আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, এবারের আবহাওয়ায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমত মৌসুমিবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হলেও এবার মৌসুমিবায়ু সক্রিয় হচ্ছে না। ফলে শ্রাবণেও বৃষ্টি দেখা নেই। বায়ুর নিম্নস্তরে জলীয় কণার পরিমাণ বেশি। এই জলীয় কণা রোদের সংস্পর্শে এসে পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। তবে তিনি জানান, আজ শুক্রবার থেকে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হবে। ফলে সমুদ্র বন্দরসমূহকে তিন নম্বর সতর্কতা দেয়া হয়েছে। আশা করি, এই অবস্থা কেটে যাবে। ২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্যায় ভাসছে দেশের বিভিন্ন এলাকা। উজান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রতিনিয়ত বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কিন্তু আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা শ্রাবণের আকাশ। শ্রাবণ মাসের আকাশ দেখে বোঝা দায় যে, প্রকৃতিতে বর্ষাকাল চলছে! শ্রাবণধারার দেখা মিলছে না। অথচ আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ আজ ১১ তারিখে পা দিয়েছে। এ কারণেই আজ সবার কাছে একই প্রশ্ন, শ্রাবণ কি প্রকৃতি থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। শুধু এই বছর নয়, ২ দশকের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে প্রায় একই চিত্র ধরা পড়ে। সাধারণ জনগণের কাছে আজ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে শ্রাবণ মাসে বাদল বাদল দূরে থাক, আকাশে যে প্রকৃতির দাবদাহ চলছে তারই কোন বদল হচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়ত প্রচ- রোদ আর দাবদাহে অস্থির হয়ে পড়ছে প্রকৃতি। গনগনে রোদ গোটা বাংলা উত্তপ্ত করে তুলছে। তাই শুধু রোদের তাপ নয়, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি হওয়ার কারণে ভ্যাপসা গরম সহ্য করতে হচ্ছে। এই সময়ে তাপমাত্রা উঠে যাচ্ছে ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। অথচ প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই শ্রাবণে আবহাওয়া থাকার কথা ছিল শীতল ও বৃষ্টিভেজা। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী নিকট অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এবারের জুনে উষ্ণতম মাস পার করেছে বাংলাদেশ। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এ মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি ছিল। জুলাইয়ে কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাতের দেখা মেলেনি। তারা বলছেন মৌসুমি বায়ু কম সক্রিয় থাকার কারণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। আবার এই সময়ে বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাপ বেশি থাকায় গরম সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, জুন মাসে দেশে গড়ে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ ৩১ দশমিক ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। ১৭ জুন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে রেকর্ড করা হয় ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আর ১০ ও ১১ মে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রাজশাহীতে রেকর্ড করা হয় ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। জুন মাসে স্বাভাবিক গড় ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও রেকর্ড করা হয়েছে ২৭৩ দশমিক ৯ মিলিমিটার। অর্থাৎ, ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। জুনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে আবহাওয়াবিদরা বলেন, মৌসুমিবায়ু দেরিতে আসায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম ছিল। বৃষ্টিপাত কম থাকার কারণে রোদের প্রখরতা বেশি ছিল। তাপমাত্রাও বেশি উপরে উঠেছে। এ কারণে গড়ে তাপমাত্রা বেশি ছিল। জলবায়ু পরিবর্তের ফলেই আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণ। যার প্রভাব পড়ছে মানুষ জীবনের ওপর।
×