ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের নতুন তারিখ ১ সেপ্টেম্বর

দীর্ঘ ২৩ বছরেও জট খোলেনি সালমান শাহ মৃত্যু রহস্যের

প্রকাশিত: ১০:০৬, ২৫ জুলাই ২০১৯

 দীর্ঘ ২৩ বছরেও জট খোলেনি সালমান শাহ মৃত্যু রহস্যের

শংকর কুমার দে ॥ জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন দীর্ঘ ২৩ বছরেও তার মৃত্যুরহস্যের জট খুলতে পারেনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। বিতর্কিত অবাঙালী শিল্পপতি আজিজ মোহাম্মদ ভাই, তার সাবেক স্ত্রী সামিরাসহ এই মামলার অভিযুক্ত আসামির সংখ্যা ১১। অভিযুক্তরা বিদেশে পলাতক। এক সময়ের বিউটিশিয়ান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রাবেয়া সুলতানা রুবি ওই ভিডিও বার্তায় প্রথমে সালমানের মৃত্যুকে হত্যা বলে আখ্যা দেন। ওই ভিডিও বার্তা ধরে সালমান শাহ মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বহুল আলোচিত সালমান শাহ মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে এখন তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্ধারিত তারিখ ছিল গত ২৩ জুলাই। অবশ্য নির্ধারিত তারিখে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। আদালত অধিকতর তদন্ত করে তার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছে আগামী ১ সেপ্টেম্বর। জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সামিরা হক, লতিফা হক লুসি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও মনোয়ারা বেগম। ’৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহর লাশ ১১/বি নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বাসার নিজ কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রথমে হলি ফ্যামিলি ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই সালমানকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করা হয়। ’১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর আলোচিত এ মামলাটি তদন্ত করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেয় আদালত। এর আগে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ওপর নারাজির প্রেক্ষিতে ’১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সিএমএম আদালত র‌্যাবকে মামলাটি আবারও তদন্তের নির্দেশ দেয়। ওই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিশন করলে র‌্যাবকে দেয়া তদন্তের আদেশ বেআইনী ঘোষণা করা হয়। কয়েক দফা তদন্তে সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও। তা এখনো মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার ও ভক্তরা। ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদনের পর অপমৃত্যুর মামলার সঙ্গে হত্যাকা-ের অভিযোগের বিষয়টি আদালত একসঙ্গে তদন্তের নির্দেশ দেয় সআইডিকে। তদন্ত শেষে ৯৭ সালের ৩ নবেম্বর আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। সেখানে সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে রিভিশন মামলা করা হলে ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত। দীর্ঘ এক যুগ মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তাধীন ছিল। ’১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এ প্রতিবেদনেও সালমানের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ’১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। ’১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন করেন। নারাজি আবেদনে আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন সালমান শাহর হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা বলা হয়। আদালত নারাজি আবেদনটি মঞ্জুর করে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। এরপর মামলাটিতে র‌্যাবকে তদন্ত দেয়ার আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা করেন। ওই বছরের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করে র‌্যাব মামলাটি আর তদন্ত করতে পারবে না বলে আদেশ দেন। এরপর ৭ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট লস্কার সোহেল রানা মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। বর্তমানে পিবিআই মামলাটি তদন্ত করছে। সালমান শাহের মৃত্যুর ১০ মাস পর তদন্তে এক নাটকীয় মোড় নেয়। সালমানের বাবা কমরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ’৯৭ সালের ১৯ জুলাই রিজভি আহমেদ নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে বাসায় অনধিকার প্রবেশের অভিযোগ এনে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রিজভি আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে সালমানকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি করেন। তার দাবি, এই হত্যার পেছনে আছেন সালমানের স্ত্রী সামিরা হক, তার শাশুড়ি লতিফা হক, চলচ্চিত্রের খল চরিত্রের অভিনেতা ও সালমানের বন্ধু আশরাফুল হক ওরফে ডন ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এদের সঙ্গে তিনি (রিজভি) নিজেও ভাড়াটে খুনী হিসেবে যুক্ত হন। তবে তদন্ত শেষে পুলিশ বলেছে, রিজভির জবানবন্দী মিথ্যা। ’১৬ সালের শেষের দিকে পিবিআইকে নতুন করে মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে। তবে এত দীর্ঘ সময়ে মামলার অসংখ্য আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। একই সঙ্গে সম্পৃক্তদের অনেকেরই জবানবন্দী নেয়া সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় অধিকতর তদন্তে কতটুকু অগ্রগতি হবে তা নিয়ে খোদ তদন্ত সংশ্লিষ্টরাই সন্দিহান। তদন্ত সংস্থা পিবিআই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। মামলাটি বেশ পুরনো বিধায় এ মামলার নতুন করে কোন আলামত পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে। যেসব আলামত ছিল তারও অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকাংশ সাক্ষী ও আসামি বিদেশ থাকায় মামলার তদন্ত নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কবেনাগাদ এ তদন্ত শেষ হতে পারে তা বলা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যেই মামলার সাক্ষী হিসেবে নতুন করে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী ও সালমানের মামার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া এ মামলার আসামি রুবির দুটি ভিডিও বার্তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তবে দুই ভিডিওবার্তায় দুই রকম কথা বলেছেন রুবি। এক সময়ের বিউটিশিয়ান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রাবেয়া সুলতানা রুবি সম্প্রতি একটি ভিডিও বার্তায় প্রথমে সালমানের মৃত্যুকে হত্যা বলে আখ্যা দিলেও। তিন দিনের মাথায় ভোল পাল্টে ফেলেন তিনি। ভিডিওবার্তায় তিনি প্রথম বলেছিলেন ‘সালমান শাহ আত্মহত্যা করেনি, তাকে খুন করা হয়েছিল। আমার স্বামী তার খুনের সঙ্গে জড়িত। রুবির এমন ভিডিও বার্তা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার তিন দিন পর নতুন আরেকটি ভিডিও বার্তা পাঠান তিনি। এতে তিনি বলেছেন, ‘আমি বলব না যে এটা আত্মহত্যা বা হত্যা। এটা আমার বলা উচিত না। আমি আগেরবার যেটা বলেছি সেটাতে আমার ‘রং’ ছিল। আমি ইমোশনাল ছিলাম বেশি, যার জন্য আমি বলেছিলাম হত্যা। হত্যা নাকি আত্মহত্যা-এটা সামিরা ও তার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বের হবে। সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বলেছেন, এতদিন পর এক নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সালমান শাহ হত্যার বিচার হবে বলে প্রধানমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছিলেন। বিচার এখন দ্বারপ্রান্তে। আসামি (রুবি) নিজেই স্বীকার করেছেন। রুবিকে দেশে এনে সাক্ষী নেয়ার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানিয়েছেন নীলা চৌধুরী।
×