ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘শেখের বেডির সাক্ষাত ছাড়া আমাগো আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নাই’

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ২৫ জুলাই ২০১৯

 ‘শেখের বেডির সাক্ষাত ছাড়া আমাগো আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নাই’

রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর থেকে ॥ ‘আমরা সরকার প্রধান শেখের বেডি শেখ হাসিনারে ধন্যবাদ দেই। আগে আমরা বিনা আহারে দিন কাডাইতাম। অহন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাইয়া নাতি-পুতি লইয়া ভালাই চলতাছি। আমগোর এমপি মতিয়ার চেষ্টায় সরকার আমগোরে থাহার লাই¹া ঘর বানাইয়া দিতাছে। অহন আমরা সুখেই আছি। তবে আমগোরে আবাদি জমি নাই। অহন বয়স অইছে কবে যে মইরা যাই। শেখের বেডির কাছে আমগো আর বেশি দাবি-দাওয়াও নাই। এহন জীবনের শেষ ইচ্ছা আমরা যেন শেখের বেডির সাক্ষাত পাই।’- এমন অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন সরকারের কল্যাণে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া শেরপুরের সেই সোহাগপুর বীরকন্যাপল্লীর (বিধবা পল্লী) বীরাঙ্গনা শহীদ ইব্রাহিম মিয়ার স্ত্রী হাফিজা বেগম (৬৯)। ২৫ জুলাই ঐতিহাসিক সোহাগপুর গণহত্যা দিবস উপলক্ষে সরেজমিনে ওই এলাকার বীরকন্যাপল্লীতে গেলে স্বামী-সম্ভ্রম হারানোসহ পাওয়া-না পাওয়ার কথোপকথনের এক পর্যায়ে ওই অনুভূতি ব্যক্ত করেন বীরাঙ্গনা হাফিজা বেগম। শহীদ বাবর আলীর স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া বীরাঙ্গনা জোবেদা খাতুন (৭৪) বলেন, ‘আমরা স্বামী-সন্তান হারানির বিচার পাইছি, ঘাতক কামরুজ্জামানের ফাঁসি অইছে। এইজন্য আমগো আর আফসোস নাই। আমগোর গাও-গতরে আগের মতো শক্তি-বল না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধার ভাতা মিলছে। মিলছে সরকারী-বেসরকারী আরও ছোড-খাডো ভাতা। এহন পাইতাছি মাথা গুঁজার ঠাঁই; সরকারী ঘর। আমগো প্রতি শেখের বেডির টান ও মতিয়া আফার দরদ না থাকলে বাইচ্চা থাকাই কডিন অইতো। তাই আর শেখের বেডির সরকারের কাছে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই। অহন সবার বয়স অইছে। তাই আমগো শেষ ইচ্ছা, শেখের বেডির বুহের সাথে যেন নিজেগো বুকডা মিলাইতে পারি।’ বীরাঙ্গনা হাফিজা বেগম ও জোবেদা খাতুনের মতো একই ইচ্ছা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও ভাতাপ্রাপ্ত বীরাঙ্গনা শহীদ কাইঞ্চা মিয়ার স্ত্রী আছিরন নেছা (৭৯) ও শহীদ আবদুল লতিফের স্ত্রী হাসেনা বানু (৬১)সহ ওই বিধবাপল্লীর প্রায় সবারই। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া বীরাঙ্গনা মোছাঃ আকিরন নেছা (৬৯) বলেন, ‘অন্য ৬ জনের মতো গত বছর আমারেসহ আরও ৬ জনকে অন্যান্য সহযোগিতার পাশাপাশি সরকার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ায় পোলাপান-আত্মীয়-স্বজনসহ আমরা বেজায় খুশি। আমরা শেখের বেডির মতোন সব হারায়াও যেন সব পাইছি। কাজেই অহন শেখের বেডির সাক্ষাত চাওয়া ছাড়া আমগোর আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই।’ একই কথা জানান মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া মোছাঃ হোসনে আরা (৬৫)। স্বামী-সম্ভ্রম হারানোর বিচারসহ এখন দিন-মানের পরিবর্তন হওয়ায় তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই ওই সাক্ষাতের প্রত্যাশা করছেন। বীরাঙ্গনা বিধবাদের ওই প্রত্যাশার সঙ্গে একমত পোষণ করে স্থানীয় শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন বলেন, সোহাগপুর গণহত্যার ঘটনায় ৫৭ জন নারী বিধবা হন। তাদের মধ্যে এখনও জীবিত আছেন ২৩ জন। আর সেই ২৩ জনের মধ্যে দুই ধাপে কেবল ১২ জন বিধবাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেবার পরও এখনও আরও ১২ জন বাকি রয়েছেন। তাই বেঁচে থাকা অবশিষ্ট ১২ জনসহ মারা যাওয়া বিধবাদেরও স্বীকৃতি দাবি করেন তিনি। এছাড়া শহীদদের অস্থায়ী বেদির স্থলে একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণেরও দাবি করেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী সোহাগপুর গ্রামে ঘটে এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি। সেদিন ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় ১৫০ জনের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্থানীয় প্রফুল্লের দীঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। হায়েনার দল অর্ধ দিনব্যাপী তা-ব চালিয়ে খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাদের আশ্রয়দাতাদের। ওই সময় প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যান স্থানীয় কৃষক আলী হোসেন ও জমির আলী। কিন্তু তারা বেশিদূর এগুতে পারেননি। এক রাজাকার গুলি করে দু’জনকেই হত্যা করে। এরপর শুরু হয় নারকীয় তান্ডব। মাঠে কর্মরত রমেন রিছিল, চটপাথাং ও সিরিল গাব্রিয়েল নামে ৩ গারো আদিবাসীকে হত্যা করে। তারপর একে একে হত্যা করে আনসার আলী, লতিফ মিয়া, ছফর উদ্দিন, শহর আলী, হযরত আলী, রিয়াজ আহমেদ, রহম আলী, সাহেব আলী, বাবর আলী, উমেদ আলী, আছমত আলী, মহেজ উদ্দিন, সিরাজ আলী, পিতা-পুত্র আবুল হোসেনসহ প্রায় ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষ মানুষকে। একইসঙ্গে ওইসময় হায়েনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন ১৩ জন নারী। সেদিন কলাপাতা, ছেড়া শাড়ি আর মশারি দিয়ে কাফন পড়িয়ে চার-পাঁচটি করে লাশ এক একটি কবরে দাফন করা হয়েছিল। আবার কোন কোন কবরে সাত-আটটি করে লাশও এক সঙ্গে কবর দেয়া হয়েছিল। ওই নারকীয় হত্যাকান্ডের জীবন্ত সাক্ষী রয়েছেন অনেকেই। সেদিন সোহাগপুর গ্রামের সকল পুরুষ মানুষকে হত্যা করায় পরবর্তীতে ওই গ্রামের নাম হয় ‘বিধবা পল্লী’। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘদিন বুকচাপা কষ্ট আর অনটনে কেটেছে সেই বিধবাপল্লীর বিধবা ও তাদের সন্তান-সন্ততির। কিন্তু কেউ খোঁজ রাখেনি তাদের। বাড়ায়নি সহযোগিতার হাত। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হলে এলাকার সংসদ সদস্য, সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সহায়তার হাত বাড়ান সোহাগপুর বিধবাপল্লীর প্রতি। ধাপে ধাপে তারই প্রচেষ্টায় বিধবাদের প্রত্যেকে ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ২ হাজার টাকা, বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক থেকে ৪শ’ ও সরকার থেকে ৪শ’ টাকা হারে বয়স্ক ভাতাসহ মোট ২ হাজার ৮শ’ টাকা পাচ্ছিলেন। ওই অবস্থায় সরকারের প্রচেষ্টায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় সোহাগপুরে গণহত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আলবদর প্রধান কামারুজ্জামানের ফাঁসি হওয়ায় বিধবাদের বুকে চেপে থাকা কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়। এক পর্যায়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেক্টরস কমান্ডারস ফোরাম বিধবাপল্লীকে বীরকন্যাপল্লী নামে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু এরপরও অর্থের অভাবে তাদের দিন-মানের খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছিল না। সেজন্য এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় বীরকন্যাপল্লীর ৬ জন করে ২ ধাপে ১২ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ায় তারা প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাতাসহ সরকারী অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। কেবল তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ওই পল্লীতে করে দেয়া হয়েছে একেকটি প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকা করে মোট ৩০টি টিনশেড হাফ বিল্ডিং ঘর। তাছাড়া সোহাগপুরে যাতায়াতে ১ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তাটিও করা হয়েছে পাকা। আর বিধবাপল্লীর ছেলেমেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই বিধবাদের মূল্যায়নের পাশাপাশি তাদের পরিবার-পরিজনের দিন-মান পরিবর্তনে কাজ করছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। নানা উৎসব পার্বণে জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব ও পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম শরিক হন তাদের সঙ্গে। বীরকন্যাপল্লীর সদস্যদের দিনমান পরিবর্তনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরু বলেন, দুই দফায় সোহাগপুর বীরকন্যাপল্লীর ১২ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেবার পরও আরও কয়েকজন অপেক্ষমাণ রয়েছেন।
×