ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চেয়ারম্যান পদ নিয়ে জাপায় ফের গৃহবিবাদ

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২৪ জুলাই ২০১৯

চেয়ারম্যান পদ নিয়ে জাপায় ফের গৃহবিবাদ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দলের চেয়ারম্যানের পদ নিয়ে বিরোধী দল জাপায় ফের গৃহবিবাদ শুরু হয়েছে। গত ১৪ জুলাই সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের পক্ষ থেকে জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। দেবরকে দলের শীর্ষ পদ দেয়ায় বেঁকে বসেন ভাবি রওশন। সোমবার এক লিখিত বার্তায় দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন বলেন, জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে মানতে সম্মত নন তিনি। তাছাড়া দলের পক্ষ থেকে তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। যদিও ভাবির মান ভাঙ্গাতে শনিবার রওশনের সঙ্গে তার বাসায় দু’ঘণ্টা বৈঠক করেন জিএম কাদের। বৈঠকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে রওশনকে চূড়ান্ত করা হয়। এরপর চলে খাওয়া দাওয়া পর্ব। আশা ছিল এরমধ্য দিয়ে হয়তো উভয়ের মধ্যে চলমান বিরোধের বরফ গলতে শুরু করবে। কিন্তু বিধি বাম। বৈঠকের ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই বেঁকে বসেন ভাবি। যদিও জিএম কাদের, হাতে লেখা বিবৃতিটি রওশনের বলে মানতে রাজি নন। তিনি বলেছেন, দলে কোন বিরোধ নেই। তবে রওশনের স্বাক্ষর করা বিবৃতিটি কার হাতের এই বিতর্কের অবসান হয়নি। রওশনও এ নিয়ে মুখ খোলেননি মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। সূত্রগুলো বলছে, স্বামীর উত্তরসূরি হিসেবে দলের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে মোটেই সম্মত নন রওশন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রধানের মতো তিনিও নারী হিসেবে দল পরিচালনায় থাকতে চান। তাছাড়া রওশনকে দলের চেয়ারম্যান মানতে সম্মত পার্টির সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ। যদিও তৃণমূলের নেতারা আছেন জিএম কাদেরের সঙ্গেই। জাপা নেতারা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার দলের বনানী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পর থেকেই এরশাদের নির্ধারিত কক্ষে বসতে দেখা গেছে জিএম কাদেরকে। তিনি সে সময় উপস্থিত প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ ঘটনার পর থেকেই দলের মধ্যে বিভক্তির ডালপালা দ্রুত ছড়াতে থাকে। সার্বিক বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, রওশন এরশাদ আমার মাতৃসমতুল্য। উনি আমার অভিভাবক। তার পরামর্শক্রমেই দল পরিচালিত হবে। রওশন এরশাদের বিবৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উনি এমন বিবৃতি দিতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না। দুইদিন আগেও ভাবির বাসায় গিয়েছি। আবারও যাব। আমি আবারও বলছি আমাদের মাঝে কোন বিরোধ নেই। পার্টির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দলের ভেতরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। গত ১৬ জানুয়ারি জিএম কাদেরকে নিজের অবর্তমানে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন এরশাদ। পরবর্তীতে ২২ মার্চ আরেক সাংগঠনিক নির্দেশনায় ১৬ জানুয়ারির নির্দেশনা বাতিল করেন তিনি নিজেই। এরপর কাদেরকে বহালে আন্দোলনে নামেন রংপুরের নেতারা। অনেকটা বাধ্য হয়ে ২২ মার্চের নির্দেশনা বাতিল করে কাদেরকে পুনর্বহাল করেন এরশাদ। নতুন নির্দেশনার পর থেকে এরশাদের অবর্তমানে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব জিএম কাদের পালন করে আসছিলেন। কথিত আছে রওশনের চাপের কারণেই বারবার দলীয় সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনছিলেন পার্টি চেয়ারম্যান। জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত বাতিলের চিঠিতে বলা হয়, গত ২২ মার্চ যে সাংগঠনিক নির্দেশ দিয়েছিলাম সোমবারের চিঠির মাধ্যমে আগের আদেশটি বাতিল ঘোষণা করছি। তখন জিএম কাদেরকে ব্যর্থ উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পরদিন ২৩ মার্চ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতার পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়। বিরোধী দলীয় উপনেতা ঘোষণা করা হয় রওশন এরশাদকে। গঠনতন্ত্রে পদ না থাকলেও ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন এরশাদ। এরপর রওশনপন্থীদের চাপে রওশন এরশাদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করেছিলেন তিনি। এরশাদ জীবিত থাকাকালেই জাতীয় পার্টির পদ বণ্টন ও অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিয়ে জিএম কাদেরের সঙ্গে রওশনের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য। অসুস্থ থাকা অবস্থায় এরশাদ গত এপ্রিলে তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। এর পর থেকে রওশন ও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে দলীয় কর্মসূচীতে দেখা যাচ্ছিল না। তার চার দিনের মাথায় এক সংবাদ সম্মেলনে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের নাম ঘোষণা করা হয়। এরশাদের স্ত্রী রওশন ওই সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত ছিলেন না। দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা সেদিন ওই ঘোষণা দিয়ে বলেন, মৃত্যুর আগে এরশাদই এ সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন। এরপর গত শনিবার এরশাদের বড় ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে গুলশান-২ নম্বরে ভাবি রওশনের বাসায় যান জিএম কাদের। রওশন সেদিন পার্টির নতুন চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে আশীর্বাদ করেন বলে দলের প্রেস সচিব শুনীল শুভ রায় জানিয়েছিলেন। আশীর্বাদের মেয়াদ যে খুব বেশি সময়ের জন্য ছিল না তা কে জানত। সোমবার হাতে লেখা এক বিবৃতিতে জিএম কাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান নন বলেছেন রওশন এরশাদসহ দলের কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য। বিবৃতিতে বলা হয়, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বেশিরভাগ প্রেসিডিয়াম সদস্যের মতামত না নিয়ে তাকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে। তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরবর্তী চেয়ারম্যান নির্বাচিত না করা পর্যন্ত তিনি এই পদে থেকেই দায়িত্ব পালন করবেন। বিবৃতিতে রওশন এরশাদসহ ১০ জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, জিএম কাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আছেন। তিনি দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু হুট করে আলাপ-আলোচনা ছাড়া তাকে নতুন চেয়ারম্যান ঘোষণা হঠকারিতা। কারণ, তাকে জাপার চেয়ারম্যান করার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় জিএম কাদের জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। তাকে নতুন চেয়ারম্যানের ঘোষণা থেকে বিরত থাকার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি রওশনপন্থী নেতারা আহ্বান জানান। নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত পাঁচবার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি। ফের গৃহবিবাদের মুখে দলটি আবারো ভাঙ্গনের মুখে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রবল। তাছাড়া দেবর-ভাবির এমন টানাপোড়েনে অস্থিরতায় ভুগছে জাপার নেতাকর্মীরা। বিবাদের কারণে পার্টির চেয়ারম্যান, বিরোধীদলের নেতা ও রংপুর-৩ আসন থেকে দল থেকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তা নিয়ে কোন সিদ্ধান্তেই আসতে পারছে না দলটির শীর্ষনেতারা। এ বিষয়ে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, পার্টি চলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। দলের চেয়ারম্যান জীবিত থাকা অবস্থায় তার অবর্তমানে দল পরিচালনা করার জন্য গঠনতন্ত্রের ২০/১-ক ধারা মোতাবেক তার অনুজ জিএম কাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন এবং বলেছেন তার অবর্তমানে জিএম কাদেরই হবেন পার্টির চেয়ারম্যান। একই গঠনতন্ত্রে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলের উপনেতা বানানো হয়েছে। উনি বিরোধীদলের নেতা হবেন এটাই স্বাভাবিক। এখানে ভুল বুঝাবুঝির কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। পার্টির সবাইকে বলব আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরশাদের দলকে শক্তিশালী করে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাই। পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, এরশাদের ইচ্ছা ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জিএম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান, রওশন এরশাদ বিরোধীদলের নেতা। তাদের যৌথ নেতৃত্বেই পার্টি পরিচালিত হবে। এর বাইরে গিয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার জন্য পার্টির দুইএকজন নেতা চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করছেন। পার্টির তৃণমূলের কাছে তাদের নুন্যতম গ্রহণযোগ্যতা নেই। দলের যুগ্ম-মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, স্যার (এরশাদ) যে সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন তার কোন বিকল্প নেই। জিএম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান এ নিয়ে আমাদের কোন দ্বিমত নেই এবং তার বিকল্পও নেই। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে ভালো হতো। অতি উৎসাহীদের জন্য দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সবাই যদি জিএম কাদেরকে অমরা চেয়ারম্যান ঘোষণা করতাম তাহলে আমরা সবাই সম্মানিত হতাম।
×