ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ রাশেদুল হক

মরগানদের ঘোর যেন কাটছেই না...

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ২৪ জুলাই ২০১৯

মরগানদের ঘোর যেন কাটছেই না...

দীর্ঘ ৪৪ বছরের অপেক্ষার পর প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপার স্বাদ পেয়েছে ইংল্যান্ড। দরজায় কড়া নাড়ছে ঐতিহ্যের এ্যাসেজ। কিন্তু ঘুড়ে ফিরে আসছে বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ। অধিনায়ক ইয়ন মরগান থেকে উইকেটরক্ষক জস বাটলার সবার মুখে এখনও সেই স্বপ্নের ট্রফি। আর বিশ্বকাপ নিয়ে যত কথা হচ্ছে তত সামনে উঠে আসছে লর্ডসের রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল। যেখানে বিশ্বকাপের প্রথম কোন ফাইনালে নির্ধারিত ৫০ ওভার, এমনকি সুপার ওভারেও ফয়সালা না হলে বাউন্ডারি সংখ্যায় বিজয়ী ঠিক করা হয়! ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়ার পর এই সাফল্য দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল। তবে এমন জয়ে অধিনায়ক মরগানও তৃপ্ত হতে পারছেন না। জস বাটলার শুনিয়েছেন সুপার ওভারে গাপটিলকে সেই ঐতিহাসিক রান-আউট করার গল্প। এমনকি ওভার থ্রোয়ে ভুলে ১ রান বেশি দেয়া নিয়ে কথা বলেছেন ফাইনালের আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা। সব মিলিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ক্রিকেটে এখনও আলোচানার বিষয়বস্তু বিশ্বকাপ। নির্ধারিত ৫০ ওভারের পর সুপার ওভারও টাই! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক ফাইনালে বাউন্ডারি সংখ্যায় এগিয়ে থাকায় বিশ্বকাপ জিতেছে ইংল্যান্ড। আইরিশ বংশোদ্ভূত ইয়ন মরগানের নেতৃত্বে চার দশকেরও বেশি অপেক্ষার পর ক্রিকেটে প্রথম শিরোপার পেয়েছে কুলিশ ইংলিশরা। ১০২ ওভারের ম্যারাথন ম্যাচে না হেরেও রিক্তবদনে ফিরতে হয়েছে কিউইদের। বিষয়টি নিয়ে সাবেক, বর্তমান তারকা, বিশ্লেষক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও আলোচনা-সমালোচনার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মর্মপীড়ায় ভোগা ইংল্যান্ড অধিনায়ক মরগানও এবার বললেন, এভাবে শিরোপা জেতা ঠিক হয়নি। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ফাইনালের ফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। পাশাপাশি ভবিষ্যত নিয়েও কথা বলেছেন ইংলিশদের রঙিন পোশাকের অধিনায়ক। জানিয়েছেন ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ অনেক দূরের পথ। সেটি নিয়ে এখনই ভাবছেন না। তবে ২০২০ টি২০ বিশ্বকাপেও ভাল কিছুর জন্য অপেক্ষায় আছেন। মরগান বলেন, ‘দুটি দলের মাঝে যখন তেমন কোন পার্থক্যই নেই তখন এ ধরনের ফল ন্যায্য বলে আমি মনে করি না। (ফাইনালে) এমন কোন মুহূর্ত আসেনি যখন আপনি বলতে পারবেন, ম্যাচটা ফসকে গেল! আমি স্বাভাবিকই আছি। কী ঘটেছে তা মাঠে থেকেই দেখেছি। কিন্তু এভাবে জিতব এটা আমিও নিজেও আশা করিনি। এই জয় কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না!’ ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম টাইমসকে দেয়া দীর্ঘ সাক্ষাতকারে স্মরণীয় সেই ফাইনাল নিয়ে ইংল্যান্ড অধিনায়ক আরও বলেন, ‘ম্যাচের গতিধারা পাল্টে দেয়ার মতো কোন মুহূর্ত নেই। হ্যাঁ, আমরা শুরু থেকেই জয়ের যোগ্য দাবিদার ছিলাম। কেনের (উইলিয়ামসন) সঙ্গে গত কয়েকদিন ধরেই কথা হচ্ছে। যৌক্তিকভাবে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি যে, কেউ ম্যাচে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘জেতা অবশ্যই কঠিন ছিল, কিন্তু হেরে যাওয়া ছিল আরও কঠিন! তবে মরগান স্বীকার করেছেন, এই ম্যাচটি তিনি আজীবন মনে রাখবেন কারণ এই ম্যাচ সর্বকালের সেরার তালিকায় ফেলা যায়। এই রকম শ্বাসরুদ্ধকর এবং নাটকীয় ম্যাচ হয়ত আর সহসা দেখা যাবে না। ইংল্যান্ড অধিনায়ক ওয়ানডে ক্রিকেটে আরও কিছুদিন থাকবেন কিনা, এ ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নেননি। ২০২৩ বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যাওয়া অনেক বড় বিষয়, তবে আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য টি২০ বিশ্বকাপ তার পরবর্তী লক্ষ্য, মরগান বলেন, ‘আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে। সত্যি বলতে কি বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করার আনন্দ থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি। এখনও মানসিকভাবে অন্য কিছু চিন্তা করতে পারছি না। বিশ্বকাপের শিরোপার আনন্দ যে কি তা আগে কখনই উপলব্ধি করতে পারিনি। শারীরিক ও মানসিকভাবে এখনও সেই আনন্দে ভাসছি। আগামী দুই মাসে হয়ত এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। তখন আশা করছি, পরিবার ও দলের সঙ্গে আলোচনা করে ভবিষ্যতের করণীয় ঠিক করব।’ ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে গ্রুপ-পর্ব থেকে বিদায় নিয়ে হতাশ করেছিল ইংল্যান্ড। সেই ইংল্যান্ডই চার বছর পরে নিজেদের দারুণভাবে প্রস্তুত করে তুলে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ দল হিসেবে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে। আর এসব সাফল্য এসেছে মরগানের নেতৃত্বে। মরগানের অধীনে ২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছিল ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের সাফল্যের আরেক কারিগর কোচ ট্রেভর বেলিস অবশ্য আসন্ন এ্যাশেজ সিরিজের পরই দল ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী মরগান প্রথমবারের আয়োজিত ইউরো টি২০ স্ল্যামে ডাবলিনকে নেতৃত্ব দেবেন। আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের ৬টি দল নিয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ২০ ওভারের এই টি২০ স্ল্যাম নিয়ে মরগান দারুণ আশাবাদী। টুর্নামেন্টের অন্যতম তারকা হিসেবে অংশ নিচ্ছেন ৩২ বছর বয়সী মরগান। পরশু লন্ডনে টুর্নামেন্টের খেলোয়াড় ড্রাফট অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে ১০০-এরও বেশি আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া খেলোয়াড় ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজি আমাস্টারডাম নাইটস, বেলফাস্ট টাইটান্স, ডাবলিন চিফস, এডিনবার্গ রকস, গ্লাসগো জায়ান্ট ও রটারডাম রিয়ন্সে খেলছেন। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান পাকিস্তানের বাবর আজম ও মোহাম্মদ আমির, অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন, দক্ষিণ আফ্রিকার জেপি ডুমিনি ও নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিল। আগামী ৩০ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে এই ইউরো টি২০ স্ল্যাম। এক সাক্ষাতকারে জস বাটলার বলেন, ‘(ম্যাচের শেষ দিকে) আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে, যদি একটুর জন্য ম্যাচটা হেরে যাই তাহলে আমি আবার ক্রিকেট খেলব কী করে? সে ম্যাচটা ছিল আজীবনে একবার পাওয়া সুযোগের মতো। লর্ডসের মাঠে বিশ্বকাপের ফাইনাল! ভাবা যায়? যদি ম্যাচটি না জিততাম, তাহলে হয়ত লম্বা সময়ের জন্য আর ব্যাটই হাতে নিতে পারতাম না। আমি এই ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম যে-যদি আমরা হেরে যাই, আমি আর কোনদিন ক্রিকেটই খেলব কি না!’ এ বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে ৮টি ফাইনাল খেলে ৭টিতেই হেরেছিলেন বাটলার। যে কারণে পরাজয়ের ভয়টা বেশিই ছিল তার। বাটলারের ভাষ্য, ‘আমি সেই রোববারের ম্যাচটির আগে আরও ৮টি ফাইনাল খেলেছিলাম। যার মধ্যে ৭টিতেই ছিলাম পরাজিত দলে। তাই আমি জানি ফাইনালে উঠে প্রতিপক্ষের হাতে ট্রফি তুলে দেয়ার যন্ত্রণাটা কেমন। তাই আমি চাচ্ছিলাম না আবারও সেই বেদনা সহ্য করতে।’ কঠিন পরিস্থিতিতে ৬০ বলে ৬ চারে ৫৯ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে টাই করতে সাহায্য করেন বাটলার ও ম্যাচের নায়ক বেন স্টোকস (অপরাজিত ৮৪)। সুপার ওভারেও টাই হলে বাউন্ডারি সংখ্যায় এগিয়ে থাকায় বাইলজ (আইন) অনুযায়ী জয় প্রথম শিরোপার স্বাগ পায় ইংলিশরা। বাটলার জানান, উইকেটরক্ষক হিসেবে সুপার ওভারের সেই শেষ বলের প্রতিটা মুহূর্ত যেন তিনি অনুভব করতে পারছিলেন,‘সে মুহূর্তে আপনি আসলে একজন অটো পাইলট। আমি প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে পারছিলাম। গাপটিল তার পায়ের বলটি অনসাইডে ঠেলে দিল। যখন দেখলাম বলটা সোজা জেসনের হাতে, তখন মনে হচ্ছিল যদি বলটা সোজা আমার হাতে আসে, তাহলে আমরা এটা জিততে পারব। আমি জানতাম গাপটিল তখনও অনেক দূরে থাকবে।’ চাপের মুহূর্তে মাথা ঠা-া রেখে নিজের কাজটা করা কতটা কঠিন, সেই গল্পই শুনিয়েছেন রঙিন পোষাকে ইংল্যান্ডের সহ-অধিনায়ক। বাটলার বলেন, ‘চাপের মুহূর্তে কোনকিছুই সহজ নয়। কিন্তু আমি জানতাম যে এটা সহজভাবেই করতে হবে। আমাকে পিচের ওপরে অনেকটুকু আসতে হয়েছিল। তবু আমি জানতাম যে যদি বলটা ঠিকঠাক গ্লাভসে নিতে পারি, তাহলে স্টাম্প ভাঙার যথেষ্ট সময় থাকবে আমার হাতে। আমি যদি দেখতাম যে গাপটিল খুব কাছে চলে এসেছে, তখন হয়ত চাপের কারণে ভড়কে যেতাম। তখন আমার হাতে সময় ছিল, তাই আমি বিষয়টা সহজ রাখতে চেয়েছিলাম, নিজের হাতেই রাখতে চেয়েছিলাম।’ নিউজিল্যান্ড হেরেছে, এমন কথাও বলতে নারাজ বাটলার, ‘এই ম্যাচে কোন দলেরই হার প্রাপ্য নয়। এমন অসাধারণ ম্যাচের কৃতিত্ব নিউজিল্যান্ডেরও। তাদের হারটা প্রাপ্য নয়।’ বিশ্বকাপ ইতিহাসেই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছিল সুপার ওভার। যেখানেও হয় টাই। আর এই পুরো ঘটনার অংশ জশ বাটলারও। সুপার ওভারের শেষ বলে তিনিই রানআউট করেন মার্টিন গাপটিলকে।, ‘আমার মনে হয় এটা অনেকেরই দেখা ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ম্যাচগুলোর একটি। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। শেষদিকের কিছু বাউন্ডারিই আমাদের শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিততে সহায়তা করেছে।’ যোগ করেন বাটলার।
×