ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

এ অপশক্তিকে থামাতেই হবে

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ২৪ জুলাই ২০১৯

এ অপশক্তিকে থামাতেই হবে

পদ্মা সেতু নিজের অর্থে করা হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন সাহসী সিদ্ধান্ত যাদের পছন্দ হয়নি, এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কেবল বাংলাদেশের ভেতরে নয়, বিশ্বের একাধিক দেশেও তারা রয়েছে। এদের আপনি অপশক্তি বলতে পারেন। দুষ্টবুদ্ধির লোক বা মতলববাজ বলতে পারেন। পদ্মা সেতুর কাজ নির্বিঘœভাবে যেন না আগায়, সেটা তাদের কাম্য ছিল। সবাই যে এ জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে বসেছে বা তার চেষ্টা করেছে- তেমনটি বলা যাবে না। অনেকেই হয়ত ‘অঘটন হলে মন্দ হয় না’ মনোভাব নিয়ে চলেছে। আবার সংগঠিত চেষ্টাও দৃশ্যমান। যখন পদ্মার মূল স্রোতে পাইলিংয়ের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছিল, এই অপশক্তি প্রচার শুরু করে দেয়, স্বপ্নের এ সেতুর কষ্মিনকালেও শেষ হবে না। এ পর্যন্ত যা খরচ গেছে, পুরোটাই পানিতে গেছে। তবে আমজনতা ভরসা হারায়নি। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা পথে প্রায়শই চলাচল করতে হয়। ফেরিতে স্থানীয়দের বলাবলি করতে শুনেছি, পদ্মায় ‘তল’ পাওয়া সহজ নয়। তবে শেখের বেটি হাসিনা এটা করে ছাড়বেন। এ সেতু হলে বরিশাল, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর প্রভৃতি জেলার অনেকে নিজ নিজ বাড়িতে থেকেই প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ঢাকা-বেনাপোল নতুন রেলগাড়ি চালু করতে গিয়ে বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু এবং ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথ নির্মাণ শেষ হলে ঢাকা-বেনাপোলের দূরত্ব অর্ধেক হয়ে যাবে। এটা সবার সহ্য হবে কেন? বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে কেন? উন্নত দেশের সারিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবে কেন? শেখ হাসিনার সরকার যে ১০টি মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের জিডিপি ৩-৪ শতাংশ বেড়ে যাবেÑ বাংলাদেশকে যারা তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম দিয়েছিল, এটাই তা তাদের সহ্য হবে কেন? তবে আঘাতটা ‘পদ্মা সেতু শিশুর রক্ত চায়’Ñ এভাবে আসবে, সেটা ভাবিনি। ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ অঞ্চলের কয়েকজন গাড়িচালকের কাছেই প্রথম বিষয়টি শুনি। একজন বলছিলেন, গ্রামের স্কুলে চিঠি গেছেÑ পদ্মা সেতু শিশুদের লাশ চায়। তারা সেটা গ্রামের বাবা-চাচাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনে ঢাকায় বসে শুনেছে। যারা শুনেছে, তাদের কেউ চিঠি দেখেছে? উত্তরে বলা হলো- না, দেখেনি। এ যেন ২০১৩ সালের মার্চ মাসের শুরুতে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখ চাঁদে দেখার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটে যুক্ত থাকার কারণে যেই না আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দিলÑ সঙ্গে সঙ্গে গুজব রটানো হলো তার মুখ চাঁদে দেখা গেছে। কিছু লোক সেটা বিশ্বাসও করল। কিন্তু এরপর ছয় বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। ভয়ঙ্কর অপরাধের শাস্তি হিসেবে দিন কাটছে তার কারাগারে, কেউ তাকে চাঁদে বা সূর্যে কিংবা নদী-সাগরে দেখে না! পদ্মা সেতু চালুর জন্য ‘শিশু রক্ত চাই’ এ গুজব ডালপালা মেলতে পারল কেন, সেটা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগের ভাবা উচিত। মতলববাজ লোকেরা এত সহজে হাল ছাড়বে না, সেটা মুহূর্তের জন্যও বিস্মিত হলে চলবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের জন্যও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠন। জাতীয় সংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন- স্থানীয় সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মী-সদস্য সংখ্যা কত, সে হিসাব রাখা দায়। তারপরও কি করে অশুভ শক্তি গুজব রটিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোন বাধা ছাড়াই? গুজবের কারণে পদ্মা সেতুর কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু পিটিয়ে হত্যার একের পর এক ঘটনা যেন হঠাৎ করেই আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। সাবেক স্বামীর চক্রান্তে খোদ রাজধানীতে মৃত্যু হয়েছে তাসলিমা রেণু নামের এক নারীর। তিনি শিশু কন্যার ভর্তির বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য বাড্ডার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। তাকে অপবাদ দিয়ে শত শত লোকের উপস্থিতিতে হত্যা করা হয়। বরগুনা শহরে এক তরুণকে হত্যার দৃশ্য ভিডিওতে ভাইরাল। তাসলিমা রেণুকে যেভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়েছে তার দৃশ্যও ধরা পড়েছে সিসি টিভিতে। এ করুণ-মর্মান্তিক দৃশ্য টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। মানুষের সংবেদনশীলতা কি লোপ পেয়েছে? সঙ্গত প্রশ্ন। একটি এলাকায় মাছ ধরা নিয়ে পুকুরের মালিক ও জেলেদের সাধারণ বিবাদের করুণ পরিণতি- গণপিটুনি। অনেক সময় অপরাধীদের পুলিশের হাতে না দিয়ে আইন হাতে নেয়ার ঘটনা ঘটে। কিন্তু গত কয়েকদিনে গণপিটুনিতে হতাহতের যে সব ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে ঠিক এভাবে বিচার করা যায় না। ভারতে আদিবাসী, দলিত ও মুসলিমদের নানা অপবাদ দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার ঘটনা ঘটছে। উগ্র ধর্মান্ধরা এর পেছনে আছে। উচ্চবর্ণের লোকরাও সুপরিকল্পিতভাবে এটা ঘটাচ্ছে। দলিত নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে প্রকাশ্যে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারার একের পর এক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের হতে থাকে। সর্বোচ্চ আদালত তখন নিম্ন আদালতগুলোকে নির্দেশ দেয়- প্রতিটি ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। এ ধরনের অপরাধ করলে পরিণতি হবে ভয়াবহ, এটা যেন বুঝিয়ে দেয়া হয়। অনেকে মিলে হত্যা করা হয়েছে, তাই কাউকে শাস্তি দেয়া ঠিক হবে না, এমন ধারণা যেন সমাজে তৈরি না হতে পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করে দিয়েছে। প্রয়োজনে পৃথক আইন প্রণয়নের কথাও আদালত বলেছে। বাংলাদেশ ভারতের এ দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আমাদের পুলিশ প্রশাসন কঠোর অবস্থান গ্রহণের সংকল্প ব্যক্ত করেছেন, সেটা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের খবরে দেখা যায়। যেখানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, দ্রুত তা জেনে যায় সকলে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনুপস্থিত বিষয়টি হচ্ছেÑ প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠোর দণ্ড দেয়া হয়েছে তেমন খবর নেই। ধর-মার-কাট এমনটি কেউ চায় না। কিন্তু সন্দেহবশত কিংবা দুষ্টবুদ্ধিতাড়িত হয়ে পরিকল্পিতভাবে কিংবা হুজুকে মেতে যারা ভয়ঙ্কর অপরাধ করছে তাদের শাস্তি প্রদানে কালক্ষেপণ চলবে না। এ অপশক্তি সমাজে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। মানুষকে হতাশ করতে চায়। মব কিলিং ঘটতে দেখে অলক্ষ্যে তারা বিকৃত উল্লাস প্রকাশ করে। তাদের অবশ্যই থামাতে হবে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×