ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জ্বর হলেই আতঙ্কে রোগী নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটছেন অভিভাবকরা

প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১০ নতুন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ২১ জুলাই ২০১৯

 প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১০ নতুন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ডেঙ্গু রোগীতে ভরে গেছে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক। রোগীদের ভিড়ে অনেক হাসপাতালে শয্যা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জ্বর হলেই রোগী নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন অভিভাবকরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শেও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না রাজধানীবাসী। অনেক ডেঙ্গু রোগী দেড়/দুই সপ্তাহ ধরে পড়ে আছেন হাসপাতালে। গত এক সপ্তাহ ধরে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় নতুন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৯ জনের নিচে নামছে না। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে নতুন ২৩৩। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে নতুন ১০ ডেঙ্গু রোগী। গত ৮ দিন ধরে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ১১৬ নং কেবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছে সাংবাদিক ফিরোজ মান্না ও গৃহিণী নিশাত সাবেরা দম্পতির একমাত্র সন্তান অদ্রিজা সম্প্রীতি (জয়িতা)। রাজধানীর বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী জয়িতা (১৪)। তার মা নিশাত সাবেরা শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার একদিন পরই দুর্বল হয়ে পড়ে আমার মেয়ে। সে খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। শরীরের তাপমাত্রা থাকে ২০২ থেকে ২০৪ এর মধ্যে। দেরি না করে মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দেই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। কয়েক দিন আগে রক্তচাপ ও রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় খুব আতঙ্কে ছিলাম। আজ মেয়ের শারীরিক অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে কয়েকদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিতে পারব। হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা আন্তরিকভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন বলে জানান নিশাত সাবেরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ৬নং বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৫ বছরের শিশু মিজান। তার মা আয়েশা আক্তার শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, মেরুল বাড্ডায় তাদের বাসা। টিনশেড ঘরে ভাড়ায় থাকেন তারা। এলাকায় মশার উৎপাত রয়েছে। আর এলাকায় মশা মারার ওষুধ ছিটাতে দেখেনি তিনি। শিশুটির অবস্থার বিষয়ে তিনি জানান, চারদিন হয়েছে হাসপাতালে। শিশুটির শরীরে জ্বর রয়ে গেছে। প্যারাসিটামল খাওয়ালে শরীরের তাপমাত্রা কমে। পরক্ষণেই আবার বেড়ে যায় তাপমাত্রা। শিশুটির অনেক কষ্ট হচ্ছে বলে জানান আয়েশা আক্তার। এভাবে রাজধানীর হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়। রাজধানীর বাসিন্দাদের মধ্যে এখন তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর সে আতঙ্কের কারণ মশা। এডিস মশার আতঙ্কে ঘুম হারাম হয়ে গেছে রাজধানীবাসীর। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, চেনা পরিচিত লোকজন ডেঙ্গু থেকে নিরাপদ কি না এই দুর্ভাবনা পেয়ে বসেছে তাদের। গত কিছু দিন ধরে ঘরে ঘরে কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় এবং অধিকাংশ রোগীকে হাসপাতালে অনেক দিন থাকতে হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে রাজধানীবাসী। ডেঙ্গু রোগীর কারণে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ সাফি আহমেদ মুয়াজ। তিনি শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, স্বল্প খরচে ভাল চিকিৎসা হওয়ার কারণে এই হাসপাতালে এমনিতেই রোগীর চাপ থাকে। সিট সঙ্কটে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। হাসপাতালে আগত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ আরও বেড়ে গেছে। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৫৬ ডেঙ্গু রোগী। ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই ভর্তি করানোর অনুমতি দেয়া হচ্ছে। আর ডেঙ্গু সন্দেহে জ্বর নিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে আগত রোগীদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সিট সঙ্কট থাকার পরও আগত রোগীদের যথাযথভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে আন্তরিকতার ত্রুটি নেই বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ সাফি আহমেদ মুয়াজ। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেও প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে নতুন ডেঙ্গু রোগী। এই হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি জ্বর নিয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে আসা রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। জ্বর হলেই ছুটে আসছে হাসপাতালে। ডেঙ্গু রোগীর কারণে হাসপাতালের সিটের ওপর চাপ বেড়ে গেছে বলে জানান পরিচালক। এদিকে, জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। এই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এটি সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে বর্তমানে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জীবাণুর উৎস এখনও বন্ধ হয়নি। এ কারণে মৃত্যুর হার কমে গেলেও আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমছে না। ডেঙ্গুর উৎস বন্ধ না হলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ আরও জানান, নগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও হিমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভোগেন। আর আক্রান্তরা পিঠ, ঘাড়, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা বলে থাকেন। তিনি বলেন, যেহেতু রাজধানীতে ডেঙ্গু প্রকোপ দেখা দিয়েছে এবং মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে, সেহেতু জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া ঠিক হবে না। রোগীকে বেশি বেশি পানি, বিশেষ করে শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। দিনের বেলায় ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করা উচিত। বাসায় খোলা পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। বাসায় সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পরামর্শ দেন ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ।
×