ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

প্রলয়ঙ্করী কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়

প্রকাশিত: ১২:০৭, ১৯ জুলাই ২০১৯

 প্রলয়ঙ্করী কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়প্রবণ দেশ। আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় প্রায়শ বাংলাদেশে বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। স্মরণাতীতকাল থেকেই এ অবস্থা চলে আসছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ যাবত কত সংখ্যক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান করা যথেষ্ট পরিশ্রম সাধ্য কাজ। তবে প্রাণঘাতির দিক থেকে বিভিন্ন সময়ে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী বেশ কিছু ঘূর্ণিঝড় ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। সহায় সম্পদ ক্ষতির কারণেও বহু ঘূর্ণিঝড় ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে। প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে গত পাঁচ শতকে অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি ঘূর্ণিঝড় এতটাই প্রলয়ঙ্করী ছিল যে, তা ইতিহাসে ‘ভয়াবহ বা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রাণহানির দিক থেকে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ঘূর্ণিঝড়টি ছিল ব্যাপক প্রলয়ঙ্করী। ওই ঝড়ে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে অন্তত দুই লাখ লোক মারা যায়। যদিও তখন বরিশাল ‘বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ’ নামে পরিচিত ছিল। বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। সম্রাট আকবরের অন্যতম সভাসদ আবুল ফজল তার বিখ্যাত ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে এ ঘূর্ণিঝড়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, আকবরের শাসনামলের ২৯ তম বর্ষের কোন একদিন বেলা তিনটার দিকে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বৃষ্টি ও বজ্রপাতসহ ঘূর্ণিঝড়ের তা-ব চলে ৫ ঘণ্টা ধরে। ঘূর্ণিঝড়ে গোটা রাজ্য লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ১৭০৭ সালের ঘূর্ণিঝড়েও ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছিল। ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের ঝড়েও চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চল বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। ধারণা করা হচ্ছে- ওই ঝড়ে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। কোন কোন সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, এমন ঐতিহাসিক বিবরণও রয়েছে। ১৭৮৭ সালের ঘূর্ণিঝড় বরিশাল অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাসে এক করুণতম অধ্যায়। ওই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এতটাই প্রলয়ঙ্করী ছিল যে, আড়িয়াল খাঁ নদের একটি শাখা খাল রাতারাতি মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে নদীর সৃষ্টি হয়। যা নয়া ভাঙ্গনী বা হরিণাথপুর নদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সামুদ্রিক এ জলোচ্ছ্বাসে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ অঞ্চলের ক্ষেত-খামারের সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায় এবং স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। সরকারী হিসেবে ওই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৬০ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়টি ইতিহাসে ‘১২২৯ সালের বন্যা’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। কারণ ১২২৯ সনটি ছিল বাংলা সাল। ওই সময়ে মানুষ বাংলা সনের সঙ্গে বেশি পরিচিত ছিল। ওই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সরকারী একটি প্রতিবেদনে বরিশাল অঞ্চলে ২০,১২৫ জন পুরুষ ও ১৯,৮১৫ জন নারী অর্থাৎ মোট ৩৯ হাজার ৯৪০ জন মারা গিয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই হিসেবের বাইরে খলসাখালী, যা বর্তমানে গলাচিপা উপজেলায় ২২ হাজার ৪২২ এবং বাউফল উপজেলায় ১০ হাজার ৯৮৪ জন মারা যায়। ১৮৩২ সালের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল ৬ জুন সন্ধ্যার দিকে। যার বিস্তৃতি ছিল চট্টগ্রাম উপকূল পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসে হাতিয়া দ্বীপে একটি প্রাণীও বেঁচে ছিল না। ১৯৬৯ সালের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসটিও ছিল প্রলয়ঙ্করী। এতেও বহু মানুষ ভেসে গিয়েছিল। এর এক মাস পর আরও একটি জলপ্লাবন আঘাত হানে। পর পর দুটি জলপ্লাবনে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শস্যহানি ঘটে। যার প্রেক্ষিতে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয় এবং বরিশাল অঞ্চলে দশ ভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যায়। বরিশালের উপকূলীয় অঞ্চলে ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর রাত দশটা থেকে তিনটা পর্যন্ত একটানা আঘাত হানা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে ৪০ ফুটেরও উঁচু সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়ের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে কলেরা ও দুর্ভিক্ষ মহামারী আকার ধারণ করেছিল। এতেও লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। বিশ শতকেও বরিশালসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এর মধ্যে ১৯১০ সালে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল অঞ্চলের কোন কোন এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হয়। ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও অনুরূপ আরেকটি ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। ১৯৬০ সালের পর বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার প্রায় প্রত্যেকটি ছিল যথেষ্ট বিধ্বংসী। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালের ১১ ও ১২ মে ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল অঞ্চলে সরকারী হিসেবে ১৬ হাজার ৪৫৬ জন মানুষ মারা যায়। ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বরের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রলয়ঙ্করী। এতে অন্তত ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৯১ সালে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেড় লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তার আগে অপর এক ঘূর্ণিঝড়ে উড়িরচর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, নারগিস, রেশমি, ক্যাটরিনা, রিটা, বিজলীসহ বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে। যার প্রত্যেকটিতেই উপকূলীয় অঞ্চল কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এসব ঘূর্ণিঝড় তাই জনইতিহাসের সঙ্গী হয়ে আছে।
×