ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:১৬, ১৪ জুলাই ২০১৯

 ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে রাজধানীর ডেঙ্গুর প্রকোপ! প্রতিদিন বাড়ছে নতুন নতুন ডেঙ্গু রোগী। শনিবারও গড়ে ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ছয় নতুন ডেঙ্গু রোগী। দু’দিন আগে এই হার ছিল চারজনে। সরকারী হিসাবে চলতি মাসের ১৩ জুলাই পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে মোট ১৯১৫ রোগী। বেসরকারী পরিসংখ্যানে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বর হলেই ডেঙ্গুর টেস্ট করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে যে কোন কারণে জ্বরে আক্রান্ত হলেই মানুষ ছুটে যাচ্ছেন কাছের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। জ্বর হলেই মনে সৃষ্টি হচ্ছে ডেঙ্গুর আতঙ্ক। ডেঙ্গু টেস্ট করানোর জন্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন উপচেপড়া ভিড়। ডেঙ্গু টেস্ট করানোর জন্য পাঠিয়েই প্রাথমিক দায়িত্ব সেরে নিচ্ছেন চিকিৎসকরা। প্রাথমিক পর্যায়ে কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নন তারা। ডেঙ্গুর আতঙ্ক থেকে রেহাই পাচ্ছে না নগরবাসী। অথচ বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যানে প্রতিবছর আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। অর্থাৎ এ বছরও ওই তিন মাসেও বিগত বছরগুলোর মতো ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা দিলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাবে। বর্তমানে জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগেই ডেঙ্গু টেস্ট করানোর প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন। ডেঙ্গুর মৌসুমে চলছে এডিস মশার উল্লাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের বিষয়টি নতুন কোন ঘটনা না। কিন্তু পরিবর্তন এসেছে জ্বর নিয়ে চিকিৎসকদের দেয়া প্রেসক্রিপশনেও। জ্বর হলেই চিকিৎসকদের কাছে যেতে হবে এবং চিকিৎসকরাও ডেঙ্গু টেস্ট করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরও বলছেন, পাল্টে যাচ্ছে ডেঙ্গুর ধরন। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরও রোগীর শরীরে থাকা ডেঙ্গু জীবাণুর ধরন বুঝতে সময় লাগছে চিকিৎসকদের। ততক্ষণে রোগীর শরীরে থাকা ডেঙ্গুর জীবাণু দ্রুত আরেক রূপ ধারণ করছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আঘাত হানছে রোগীর ব্রেইন, হার্ট ও লিভারে। ডেঙ্গুর জীবাণু আগের তুলনায় বেশ শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। জ্বর হওয়ার পর পরই শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছে রোগী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু ঘটছে অনেক রোগীর। এখন জ্বর হলে মানুষ যেমন প্রথমে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ভয় পায়, তেমনি ডাক্তাররাও তা শনাক্ত করে চিকিৎসা করেন। কিন্তু যার ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, তা ঠিক কোন টাইপের ডেঙ্গু, তা শনাক্ত করা হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু পরীক্ষার পাশাপাশি টাইপিংও করতে হবে। না হলে রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেয়া যাবে না। আর ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। জ্বর হলেই কালক্ষেপণ না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। আর চিকিৎসকদের উচিত হবে ডেঙ্গু প্রতিরোধকল্পে সরকার কর্তৃক তৈরিকৃত জাতীয় গাইডলাইন অনুসরণ করে চিকিৎসা প্রদান করা। প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। তবে আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্তের মৌসুম যেন সারাবছর। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ বছর রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার দ্রুত বাড়ছে এবং আক্রান্তদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হওয়ার হিড়িক পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ঘণ্টায় ছয় জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারির ১ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩৮৭৯ জন। মারা গেছেন ৩ জন। চলতি বছরে মোট আক্রান্তের মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৯ জন, মার্চে ১২ জন, এপ্রিলে ৪৫ জন, মে’তে ১৫৩ এবং জুনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৯৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর ১ জুলাই থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৯১৫ জন। অর্থাৎ এই ১৩ দিনে গড়ে দৈনিক ১৪৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বেসরকারী হিসেবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ১৯ বছরে রাজধানীতে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী ও মৃতের সংখ্যা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ৫৫৫১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৯৩ জন, ২০০১ সালে ২৪৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৬২৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১০ জন, ২০০৪ সালে ৩৪৩৪ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৩ জন, ২০০৫ সালে আক্রান্ত ১০৪৮ জন ও মৃত্যু ৪ জন, ২০০৬ সালে আক্রান্ত ২২০০জন ও মৃত্যু ঘটে ১১ জনের। এভাবে ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩জন, ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন এবং ২০১০ সালে ৪০৯ আক্রান্ত হলেও ওই চারটি বছরে কেউ মারা যায়নি। আর ২০১১ সালে ১৩৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১২ সালে ৬৭১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১ জন, ২০১৩ সালে ১৭৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ২ জন, ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন আক্রান্ত, ২০১৫ সালে ৩১৬২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১৬ সালে ৬০৬০ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৪ জন, ২০১৭ সালে আক্রান্ত ২৭৬৯ ও মৃত্যু ৮ জন এবং ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্তের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটে। জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। এই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এটি সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে বর্তমানে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জীবাণুর উৎস এখনও বন্ধ হয়নি। এ কারণে মৃত্যুর হার কমে গেলেও আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমছে না। ডেঙ্গুর উৎস বন্ধ না হলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ আরও জানান, নগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও হিমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। আর আক্রান্তরা পিঠ, ঘাড়, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা বলে থাকে। তিনি বলেন, যেহেতু রাজধানীতে ডেঙ্গু প্রকোপ দেখা দিয়েছে এবং মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে, সেহেতু জ্বর হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া ঠিক হবে না। রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি বিশেষ করে শরবত খাওয়ানো যেতে যারে। দিনের বেলায় ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করা উচিত। বাসায় খোলা পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। বাসায় সর্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ।
×