ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৪ জুলাই, ১৯৭১

আলোচনার কোন পথই খোলা রইল না!

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ১৪ জুলাই ২০১৯

 আলোচনার কোন পথই  খোলা রইল না!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই দিনটি ছিল বুধবার। এই দিন পাকবাহিনীর বেলাবো আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে সুবেদার বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল বেলাবোর নিকটবর্তী এলাকা টোকের কাছে এ্যামবুশ তৈরি করে। বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী এ্যামবুশের কথা জানতে পারে। ফলে তারা লঞ্চে না এসে নৌকাযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান অতিক্রম করে। পরে একটি খালি লঞ্চ এলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাবাহিনী মনে করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা পিছন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা গুলিবিনিময় হয়। এই যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবুল বাশার, সিপাহী আবদুল বারী, সিপাহী নূরুল ওহাব, সিপাহী সোহরাব হোসেন, সিপাহী মমতাজ উদ্দীন, সিপাহী আব্দুল হক ও সিপাহী আবদুস সালাম শহীদ হন। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে। কুড়িগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একদল গেরিলা পাকবাহিনীর বড়খাতা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট, এই তিন দিক থেকে চলবলের ঘাঁটির ওপর হামলা চালায় এবং ক্যাম্পের কাছে রামশীল নামক গ্রামে ঢুকে পড়ে। হেমায়েতের সঙ্গে তখন মাত্র ১৩ জন সঙ্গী ছিল। এদের নিয়েই তিনি অগ্রসর হন এবং এই হামলা প্রতিহত করার প্রয়াস পান। রামশীল গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি খাল গৌরনদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে চলে গেছে। গৌরনদী থেকে ঐ খাল বেয়ে হানাদার বাহিনী আসতে পারে ভেবে পূর্ব দিকে মুখ করে ৩ জন, দক্ষিণ দিকে মুখ দিয়ে ৩ জন এবং সংকেত দেবার জন্য বাইরে একজন বসানো হলো। অতঃপর হেমায়েত বাকি ৬ জনকে পশ্চিমমুখী হয়ে বসালেন। কোটালীপাড়া বান্দাবাড়ী খালের মধ্য দিয়ে হানাদার বাহিনী অগ্রসর হতে পারে মনে করেই তিনি এ জায়গায় অবস্থান নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এদিক থেকেই হানাদারদের অগ্রগামী বাহিনী দেখা গেল। তারা কাছাকাছি আসতেই হেমায়েত মেশিনগানের গুলি চালালেন। তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটা বুলেট তার সহকর্মী মকবুলের মাথার খুলি ভেদ করে চলে গেলে সে তৎক্ষণাৎ মারা যায়। মকবুলের লাশ টানতে যেতেই একটা শেলের টুকরা হেমায়েতের গালের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গেল। এতে জিহ্বার খানিকটা কেটে গেল এবং কয়েকটা দাঁতও পড়ে গেল। তবুও তিনি কর্তব্যচ্যুত হলেন না। বরং অসীম সাহস আর প্রবল প্রতাপের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ রচনা করে চললেন। এভাবে দীর্ঘ সময় তুমুল সংঘর্ষের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটতে শুরু করল। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত হয়। এতে পাকহানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুহাম্মদ আলী বর্বরদের গুলিতে শহীদ হন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম লোকসভায় বলেন, একটি জিনিস আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আর তা হলো মুক্তিফৌজের সাহসিকতার ফলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্র বাংলাদেশের জনগণের ভাবাবেগের ওপর জঘন্য সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে তার ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ খুলে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার মনে করেন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করছেন তারা পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গকে বাঙালী জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাবার উৎসাহ দিচ্ছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গ বাংলাদেশের জনগণের ব্যাপারে অযথা হস্তক্ষেপ করছেন বলে সরকার মনে করছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের নয়াদিল্লী প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইদানীং সামরিক বাহিনীর ট্রাকগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর প্রায়-জনমানবশুন্য রাস্তায় চলতে দেখা যায়, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বন্দীদের তাদের কাজের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটানোর জন্য। তাদের মাথা কামানো এবং তাদের পায়ে কোন জুতা নেই এবং হাফপ্যান্ট ছাড়া তাদের গায়ে আর কোন কাপড় নেই। রাজধানী ঢাকার বিমানবন্দরে প্রতিদিন উড়োজাহাজ এসে নামে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, ভারতের ওপর দিয়ে এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরত্ব পেরিয়ে, গোষ্ঠীগত বিশেষ পোশাক ঢোলা পায়জামা পড়া সৈনিকদের নিয়ে যাতে দেখে সন্দেহজনক কিছু মনে না হয়। বাঙালী সংস্কৃতির ছাপ মুছে দেয়ার অভিযানের অংশ হিসেবে সড়কের নাম থেকে সব হিন্দু নামের পাশাপাশি বাঙালী মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের নামও সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার শাঁখারী বাজার সড়ক এখন টিক্কা খান সড়ক, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক পদাধিকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেলের নামে এবং যাকে বেশিরভাগ বাঙালীরা ‘কসাই’ ডাকে। এগুলো অসংখ্য প্রমাণের গুটিকয়েক মাত্র, যা এই প্রতিবেদক তার সাম্প্রতিক পূর্ব প্রদেশ সফরের সময় দেখেছেন, যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাদের এই দখলদারিত্ব বজায় এবং এই অঞ্চলের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। পঙ্গু অর্থনীতি, ভেঙে পড়া সরকারী প্রশাসন, বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ, ক্রমবর্ধমান সামরিক ক্ষয়ক্ষতি এবং জনগোষ্ঠীর চাপে থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা এটা করছে। প্রতিদিনকার সৈন্য পরিবহনের পাশাপাশি, সরকার স্রোতের মতো পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে আসছে সরকারী পদে পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতিস্থাপন করতে। কোন বাঙালীকেই বিশ্বাস করে কোন গুরুত্বপূর্ণ বা স্পর্শকাতর পদে রাখা হচ্ছে না; এমনকি যে লোকটি ঢাকা বিমানবন্দরের ঘাস কাটে সেও অবাঙালী। গুটিকয়েক বাঙালী ট্যাক্সিচালক এখনও আছে। তাদের আনার কাজটি দেয়া হয়েছে ভারত থেকে অভিবাসী হয়ে আসা অবাঙালী মুসলমান যেমন বিহারীদের, যারা পশ্চিমা সরকারের পক্ষ নিয়েছে এবং সেনাবাহিনীর বেসামরিক শাখা হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তি করছে।... নিউইয়র্ক টাইমসের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে বিশ্বব্যাংক মিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিধ্বংসী সামরিক অভিযান চলছে। এতে করে ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে দেয়া সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতাংশ থেকে জানা যায় উক্ত অঞ্চলজুড়ে মৃত্যু ও ধ্বংসলীলা চলছে। মিশনের এক সদস্য জানান কুষ্টিয়ার শহর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাবর্ষণের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের মতো দেখাচ্ছিল। এখানে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী বারো দিন ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সেনাবাহিনী জনসাধারণের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করছে বিশেষ করে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের সন্দেহভাজন সদস্যদের।... স্বাধীন বাংলা বেতারে সংবাদ পর্যালোচনায় মার্কিন সাময়িকী নিউজইউকের বরাতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য সৈন্য পাঠায় সেই দিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। নিউজউইক পত্রিকায় বলা হয় ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযান চালানোর জন্য বাংলাদেশে যখন সৈন্য ও সমরসম্ভার পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই সময় পাকিস্তানের ঘরে-বাইরে সবদিক থেকেই রাজনৈতিক সমাধানের দাবি উঠছিল। ইয়াহিয়ার সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠছিল। দাবি উঠছিল- পাকিস্তানের যে সঙ্কট তার সমাধান সমরসজ্জা বা সামরিক অভিযানে সম্ভব নয়। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। কোন রকম শর্ত আরোপ না করে গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সমাধান নিহিত রয়েছে। বুলেট-বেয়োনেটে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র ঘরে-বাইরের এই দাবি উপেক্ষা করে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করে বাংলাদেশের ওপর সামরিক অভিযান চালাল। নিউজউইক উল্লেখ করে, গত সপ্তাহে ঢাকায় কয়েকজন বিদেশী কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, আপোষ আলোচনার আর কোন পথই খোলা রইল না। ইয়াহিয়ার গোঁয়ার্তুমির জন্য আলোচনার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আলোচনা এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তান মরে গেছে এবং ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্রই পাকিস্তানকে ধ্বংস করেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×