ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. এ.এইচ.এম. জেহাদুল করিম

প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা

প্রকাশিত: ০৮:২২, ১৪ জুলাই ২০১৯

 প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা

বেশ কিছুদিন যাবত শ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে শিথিলতা কাটিয়ে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে পুনরায় বাংলাদেশী শ্রমিক প্রবেশের বিষয়ে, অতি সম্প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্পোন্নত অর্থনীতির এই দেশটি। মালয়েশিয়া সফররত বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে অতি সম্প্রতি এক বৈঠকের পর মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রী তানশ্রী কুল সেগারান এই তথ্য প্রদান করেছেন। এটি অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগে মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার উন্নয়ন গতিময়তার নেতা, ড. মাহাথীর মোহাম্মদের বিশেষ আনুকূল্য সেখানে ভীষণভাবে কাজ করেছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থই আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে অত্যন্ত গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে রাখছে। অর্থনীতিবিদদের পর্যালোচনায় জানা যায়, বাংলাদেশের জিডিপির ১২ শতাংশেরও অধিক আসে মূলত প্রবাসী রেমিটেন্সের উৎস থেকে- যা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। অনস্বীকার্য যে, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিক ভাইয়েরা মূলত কনস্ট্রাক্শন সেক্টর ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকেন। এরই ফলশ্রুতিতে, এসব শ্রমিকেরা প্রায়শই নানাবিধ অসুস্থতা এবং দুর্ঘটনায় পতিত হন এবং সেই সঙ্গে, তাদের মধ্যে অন্যান্য শারীরিক অক্ষমতা তৈরি হয়। মূলতঃ এটি নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে যে, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও শারীরিক চাপ নেবার কারণেই বিভিন্ন সময়ে। এরা বিদেশে গুরুতর অসুস্থতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কিন্তু এসব শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে তাদের চাকরিদাতা সংস্থাগুলো থেকে কোন ধরনের চিকিৎসা সহায়তা বা তার নিমিত্তে কোন ভাতা পান না, যা বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসিত বাংলাদেশী শ্রমিকদের আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তোলে। যদিও মালয়েশিয়ায় সরকারী হাসপাতালগুলোতে অভিবাসিত শ্রমিকদের চিকিৎসা নেবার বিষয়ে কোন আইনগত বাধা নেই, কিন্তু কার্যত অধিকাংশ সময়েই এসব শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব চাকরি-বিষয়ক জটিলতা ও ভিসা সমস্যার কারণে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী হয় না। তদুপরি, বেশির ভাগ সময়েই আমাদের শ্রমিকদের পাসপোর্ট তাদের চাকরি সংস্থার নিকট গচ্ছিত থাকে, অথচ আইন অনুযায়ী কোন ডাক্তারই, পাসপোর্ট ব্যতীত এদের চিকিৎসা প্রদান করতে পারে না। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই, উপায়ান্তর না দেখে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অধিকাংশই নিজেরাই নিজেদের self-medicated treatment নিয়ে থাকে। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আইনানুসারে, মালয়েশিয়ায় সরকারী হাসপাতালগুলোতে, নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে অভিবাসিত শ্রমিকদের প্রবেশাধিকারে কোন বাধা না থাকলেও কার্যত, কোন বাংলাদেশী সাধারণত এই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারে না। এর কারণ হিসাবে, প্রথমত. বিদেশী শ্রমিকদের পক্ষে এসব সরকারী হাসপাতালে প্রবেশ করা অতটা সহজ নয়; দ্বিতীয়ত, বিদেশী হিসেবে তাদেরকে স্থানীয়দের চাইতে অনেক বেশি অর্থ প্রদান করে ঐসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। আমার জানা মতে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই সাধারণত এসব ইস্যুতে স্থানীয় ও অভিবাসিত ব্যক্তির মধ্যে তেমন কোন বিভেদ রাখা হয় না। কিন্তু মালয়েশিয়ায় এই বিভাজনটি কিছুতেই প্রশংসিত হবার মতো কোন বিধি নয়। কিছুদিন আগে সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে Global Experts Meeting on Migration শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, “It is nwo also crucial that we all treat every migrant as a human being, not just as an element of economic activity of the production system. They must equally enjoy all rights,—the rights as citi“ens, as the locals do. উপরন্তু, অভিবাসিত বাংলাদেশী শ্রমিকেরা নিজস্ব উদ্যোগে কোন ডাক্তারী পরামর্শ বা হাসপাতালে ভর্তি হতে যান তখনই তাদেরকে চাকরি-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, যা তাদের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর ও হতাশাব্যঞ্জক। যদিও মালয়েশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নয়, কেননা পূর্বে বাংলাদেশী ও মালয়েশীয় দালাল চক্রের যোগসাজণে সেই দেশে অনেক অবৈধ শ্রমিকও কাজে নিয়োজিত ছিল। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তাই, এসব শ্রমিকরা সরকারী হাসপাতালের সেবা গ্রহণ না করে প্রাইভেট ক্লিনিকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে আগ্রহী হয়। কিন্তু প্রাইভেট ক্লিনিক অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সেখানে কোন ধরনের বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসা সাধারণত দেয়া হয় না বিধায়, অভিবাসিত শ্রমিকরা সেটিতেও তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যদিও মালয়েশিয়াতে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে আধুনিক সেবা ও লেটেস্ট প্রযুক্তিসম্পন্ন চিকিৎসা চালু আছে, তথাপি আমাদের শ্রমিকরা এক ধরনের সামাজিক, মনস্ততাত্ত্বিক দূরত্বের কারণে এবং সর্বোপরি তাদের আর্থিক অনানুকূল্যে বাংলাদেশীরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। অন্যদিকে, ভাষাগত পার্থক্যের কারণে, অনেক বাংলাদেশী শ্রমিকরা ডাক্তার ও নার্সদের কাছে তাদের অসুস্থতাবিষয়ক কারণ ও লক্ষণ সম্পর্কে কোন সঠিক ইটিওলজিক্যাল ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হন না, যা মূলত সেখানকার ডাক্তারদের রোগ নির্ণয়ে বেশি অসুবিধার সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে, অনেকেই আমাদের এমনও ধারণা দিয়েছেন যে- মালয়েশিয়ার হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে তাদেরকে শ্রমিক হিসেবে অনেকটা হেয় করে দেখা হয় যা স্বভাবতই তাদের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নবোধের জন্ম দেয়। এসব কারণে, রোগী হিসেবে অধিকাংশ শ্রমিকরাই চিকিৎসা নেয়া থেকে বিরত থাকে এবং বিকল্প হিসেবে নিজেদের মেডিসিনই ব্যবহার করে সাময়িকভাবে সুস্থ থাকতে চায়। অন্যদিকে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য জীবনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোন জীবন বীমার ব্যবস্থা নেই; উপরন্তু, সেই দেশের নিয়োগকারী সংস্থাগুলো এদের কোন চিকিৎসা ভাতা ও মেডিকেল সাপোর্ট প্রদান করে না। ফলে, জরুরী প্রয়োজনে, বাংলাদেশী শ্রমিকদের অধিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করে তাদের চিকিৎসা করাতে হয়; অনেকে আবার এই ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসাই নেয় না। পরিশেষে, আমি এখানে যে বিষয়টি উপস্থাপন করতে চাই তা হলো, শ্রমিক হিসেবে আমাদের শ্রমজীবী ভাইয়েরা মালয়েশিয়ায় নির্মাণ ও উৎপাদন সেক্টরকে যেমন সচল করে রেখেছে তেমনি, তাদের আয়ে আমরা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাখতে সক্ষম হচ্ছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এসব শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি আমরা কখনই গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতে আগ্রহী নই; বলতে গেলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই তারা সুবিবেচনা পাচ্ছে না। সুতরাং, আমি মনে করি যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিক প্রেরণ ও গ্রহণ সংক্রান্ত সরকারী চুক্তি বা MOU স্বাক্ষরিত হবার সময় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিষয়ক ইস্যুটি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন সময়ে, শ্রম-অভিবাসন নিয়ে আমার গবেষণা প্রবন্ধে, আমি এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার জন্য সুপারিশ উপস্থাপন করেছি। অতি সম্প্রতি কানাডা থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে ‘Health Seeking Behaviour of the Bangladeshi Migrant Workers in Malaysia’ নামক প্রবন্ধে আমি এসব সমস্যা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক পলিসি-প্ল্যানারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছি। সেই সঙ্গে, কানাডায় প্রকাশিত আমার নিজস্ব সুপারিশ-সংক্রান্ত লেখাটির একটি অনুলিপি আমি স্বয়ং কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার সেক্রেটারির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে এর কপি তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়েছি। এই প্রসঙ্গে আমার প্রস্তাব হলো, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য যে সব দেশে আমাদের শ্রমিকরা অপেক্ষাকৃত অধিকতর সংখ্যায় অবস্থান করছে, সরকারী প্রচেষ্টায় আমাদের বিদেশী মিশনগুলোর মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা পরিচর্যা প্রদান করা যেতে পারে। কুয়ালালামপুর, বাহরাইন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেহেতু অপেক্ষাকৃত অধিক বেশি সংখ্যক শ্রমিক কাজ করেন, সুতরাং সেসব দেশের আমাদের বিসিএস স্বাস্থ্য-ক্যাডারের দুই-তিন জন ডাক্তারকে মিশনগুলোতে সংশ্লিষ্ট রাখলে, আমাদের শ্রমিকরা অন্তত সাধারণ ও প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো সেখান থেকে গ্রহণ করতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার তাগিদে আমাদের বর্তমান জনবান্ধব সরকার এই বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে। অন্যদিকে, বিদেশী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার জন্য, অনতিবিলম্বে তাদের স্বাস্থ্য-বীমার প্রচলন করা বাঞ্ছনীয়। সম্প্রতি, থাইল্যান্ড তাদের দেশে কর্মরত বিদেশী শ্রমিকদের জন্য ধীরে ধীরে এই ধরনের বীমা-স্কিম চালু করতে শুরু করেছে। নেপাল সরকারের প্রচেষ্টায় সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশে কর্মরত নেপালী শ্রমিকরা এই সুবিধাটি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং মালয়েশিয়া এবং অন্য দেশগুলোতেও বাংলাদেশীসহ সকল বিদেশী শ্রমিকের জন্য জীবন-বীমার এই সুবিধাটি অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে, চাকরিদাতা সংস্থাগুলোই এই স্কিমের অধীনে দেয় প্রিমিয়াম প্রদান করতে হবে; এটি আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং অভিবাসিত-শ্রমজীবীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত এই সুবিধাগুলো বিশ্ব মানবাধিকারের একটি প্রধান শর্তও বটে। লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×