ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আনসার-আল ইসলাম আত্মঘাতীদের নিয়ে হত্যা মিশনে!

নারী জঙ্গী নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে

প্রকাশিত: ১০:১৫, ১৩ জুলাই ২০১৯

  নারী জঙ্গী নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার  চেষ্টা চলছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিদেশীয় জঙ্গী নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করার চেষ্টায় বাংলাদেশী জঙ্গী সংগঠনগুলো। পুরুষ জঙ্গীদের পাশাপাশি চলছে নারী জঙ্গীদেরও ত্রিদেশীয় নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম ত্রিদেশীয় জঙ্গী নেটওয়ার্ক তৈরিতে ছয় বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। নারী জঙ্গীদের সমন্বয়ে গঠিত আত্মঘাতী স্কোয়াড দিয়ে জেএমবি দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে চায়। আর আনসার আল ইসলাম আত্মঘাতী নারী জঙ্গীদের দিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সুনিশ্চিতভাবে হত্যা মিশন নিয়ে নেমেছে। এমন জঙ্গী কর্মকান্ডের নেপথ্যে আর্থিকসহ সার্বিকভাবে সহায়তা করছে স্বাধীনতা বিরোধীরা। ২০১৬ সাল থেকে হালনাগাদ ৩৬ নারী জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে ৩৩ জনই এক সময় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অন্তত ২৪ নারী জঙ্গী আত্মঘাতী মানসিকতা পোষণ করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশে পুরুষ জঙ্গীদের তৎপরতা থাকার বিষয়টি আগাগোড়াই জানা ছিল। কিন্তু নারী জঙ্গীদের তৎপরতা পুরুষ জঙ্গীদের চেয়েও কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি তা জানা যায় ২০১৪ সালে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বিস্ফোরণে জেএমবি জঙ্গী শাকিল আহাম্মদ ওরফে শাকিল গাজী ও সোবাহান ম-ল ওরফে সোবাহান শেখ নিহত হয়। ওই বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয় শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও সোবাহান শেখের স্ত্রী আলিমা বিবি। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে রীতিমত পিলে চমকানোর মতো তথ্য দেয়। পরবর্তীতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে সেই তথ্য জানা যায়। দুই নারী জঙ্গী জানায়, শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে জঙ্গীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় জেএমবি জঙ্গীরা ভারতে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। সেই আস্তানায় তৈরি শত শত শক্তিশালী গ্রেনেড স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে থাকা জঙ্গীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সরবরাহ করা গ্রেনেড দিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি চলছে। জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ বলছে, এমন তথ্যের সত্যতা মিলে পাকিস্তান থেকে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরার পর তাদের হাতে জেএমবির কারাবন্দী আমির জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের ছোট মেয়ের জামাই সাখাওয়াতুল কবির গ্রেফতার হওয়ার পর। পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে জঙ্গী কর্মকান্ড চালানোর সময় ২০১৪ সালের ১৮ জানুয়ারি সাখাওয়াতুল কবির তাদের হাতে গ্রেফতার হয়। সাখাওয়াতুল কবিরের বরাত দিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের সূত্রটি জানায়, মহাখালী সরকারী তিতুমীর কলেজে পড়ার সময় ইজাজ ওরফে কারগিলের মাধ্যমে জেএমবি আমির মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ইজাজ তিতুমীর কলেজের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র ছিল। ইজাজ মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের বড় মেয়েকে বিয়ে করে। ইজাজের মাধ্যমে সাখাওয়াতুল কবির জেএমবি আমির সাইদুর রহমানের ছোট মেয়েকে বিয়ে করে। পরে ইজাজ ও সাখাওয়াতুল কবির দু’জনেই জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য পাকিস্তানে চলে যায়। সাখাওয়াতুল কবির দেশে ফিরে জঙ্গী কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকে। আর ইজাজ পাকিস্তানেই থেকে যায়। সূত্রটি বলছে, ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পেশোয়ারের সেনাবাহিনী পরিচালিত আর্মি পাবলিক স্কুলে ৬ জঙ্গী সশস্ত্র বোমা হামলা ও গুলি চালায়। এক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সামনে ক্লাসের ভেতরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করে। এ দৃশ্য দেখতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে জঙ্গীরা। শিক্ষক মারা যাওয়ার পর ক্লাসে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী ১৪২ শিক্ষার্থী আর ৮ শিক্ষককে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে জঙ্গীরা। এমন ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানে জঙ্গী ঘাঁটিতে সাঁড়াশি অভিযান চলতে থাকে। ধারাবাহিক অভিযানে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের জেএমবির আমির সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই ইজাজ ওরফে কারগিলসহ ৪ বাংলাদেশী জঙ্গী মারা যায়। ইজাজের স্ত্রী এখনও পাকিস্তানেই। সে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নিহত অপর তিন বাংলাদেশী জঙ্গী হচ্ছে, জেএমবির আমির সাইদুর রহমানের আরেক মেয়ের জামাই পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আসার পর গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী সাখাওয়াতুল কবিরের ভাগ্নিজামাই অভি, পাকিস্তানে অবস্থিত বাংলাদেশী নারী জঙ্গী ফাতেমার স্বামী সায়েম ও সায়েমের বোনজামাই শামীম। সাখাওয়াতুল কবিরের ভাগ্নি, নিহত সায়েমের স্ত্রী ফাতেমা ও সায়েমের বোন এখনও পাকিস্তানেই রয়েছে। চার জন মারা যাওয়ার পর তারা আর দেশে ফেরেনি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান করে তারা অপারেশন ও প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছে। তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছে। নিহত ইজাজ ওরফে কারগিলের প্রত্যক্ষ মদদ আর আর্থিক সহায়তা ও বুদ্ধি-পরামর্শে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সৃষ্টি হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর এ ঘটনায় জড়িত থাকা চার জঙ্গী আব্দুস সালাম, হজরত আলী, মুজিবুর রেহমান ও সাবিল ওরফে ইয়াহিয়ার ফাঁসি কার্যকর করা হয় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কোহাটে অবস্থিত একটি কারাগারে। হামলার দায় স্বীকার করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। সংগঠনটির দাবি, উত্তর ওয়াজিরস্তানে তালেবানের ঘাঁটি জার্ব-ই-আজবে সেনা অভিযানের প্রতিশোধ হিসেবে হামলাটি চালানো হয়েছিল। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, পাকিস্তানে থাকা নারী জঙ্গীদের সঙ্গে ভারতে গ্রেফতার হওয়া দুই নারী জঙ্গী এবং বাংলাদেশে হালনাগাদ গ্রেফতার হওয়া ৩৬ নারী জঙ্গীর মধ্যে প্রথমসারির অন্তত ১০ জনের যোগাযোগ ছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই ২০১৬ সাল থেকেই বাংলাদেশে নারী জঙ্গীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলে আসছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকার মগবাজারে ও গাজীপুরে সাঁড়াশি অভিযান চালালে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় আত্মঘাতী নব্য জেএমবির নারী জঙ্গী স্কোয়াডের সদস্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশি (২৩), জামায়াতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রী ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমী ওরফে মৌ (২২), খাদিজা পারভীন ওরফে মেঘলা (২৩) ও আকলিমা রহমান ওরফে মনি (২৩)। গ্রেফতারকৃতরা সাফিয়া ওরফে সানজিদা ওরফে ঝিনুক, মাইমুনা ওরফে মাহমুদা ওরফে লায়লা, তাসনুবা ওরফে তাহিরা, সায়লা ওরফে শাহিদা, সালেহা ওরফে পুতুল, দিনাত জাহান ওরফে নওমী ওরফে বানী, তানজিলা ওরফে মুন্নী, আলিয়া ওরফে তিন্নি ওরফে তিতলী, মনিরা জাহান ওরফে মিলি ও ছাবিহা ওরফে মিতু নামের দশ নারী জঙ্গীর তথ্য দেয়। ডাঃ ঐশী ২০১৩ সালে জঙ্গীবাদে জড়ায়। সে মাসিক ১২ হাজার টাকা করে চাঁদা দিত। নারী জঙ্গীরা অনেককেই জঙ্গী প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও পাঠায় বলে তথ্য দেয়। সেই তথ্য মোতাবেক ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটের একটি হোটেল থেকে নব্য জেএমবির আত্মঘাতী প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য পাকিস্তান যাওয়ার প্রস্তুতিকালে দুই জোড়া নবদম্পতি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন, মারজিয়া আক্তার ওরফে সুমি (১৯), স্বামী মোঃ শরিফুল ইসলাম ওরফে সুলতান মাহমুদ তাপস ওরফে মাহমুদ (১৮)। মোঃ আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিনুল (৩৪) ও তার স্ত্রী নাহিদ সুলতানা (৩০)। গত বছরের ৪ এপ্রিল পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে আত্মঘাতী নারী জঙ্গী হুমায়রা গ্রেফতার হয়। ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী হয়ে নিহত হওয়া নব্য জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য সাইফুল ইসলামকে আত্মঘাতী হামলা চালাতে প্ররোচনাসহ যাবতীয় খবর বহন করেছিল গ্রেফতারকৃত নারী জঙ্গী হুমায়রা। ওইদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের অনুষ্ঠানে আত্মঘাতী হামলা করে আওয়ামী লীগের অন্তত শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। হুমায়রা ওরফে নাবিলার স্বামী তানভীর ইয়াসির করিমও নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িত। তিনি ২০১৭ সালের ১৯ নবেম্বর গ্রেফতার হন। হুমায়রা নব্য জেএমবির সিস্টার্স উইং বা নারী শাখার দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন। হুমায়রা রাজধানীর একটি বিলাসবহুল শপিং মলের মালিকের মেয়ে। ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেন। পরে মালয়েশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন। তার স্বামী তানভীরও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তানভীরের সঙ্গে পরিচয়। স্বামীর হাত ধরে তিনিও জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। গত বছরের ১৫ অক্টোবর নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার ছোট গদাইরচর গাঙপাড় এলাকার নিলুফা ভিলা ও একই জেলার সদর উপজেলার শেখেরচরের দীঘিরপাড়ের বিল্লালের বাড়িটির জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। শেখেরচরের আস্তানায় নিহত হয় আত্মঘাতী জঙ্গী দম্পতি আকলিমা আক্তার মনি ও তার স্বামী আবু আব্দুল্লাহ বাঙালী। আকলিমা ইতোপূর্বে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। আর নিলুফা ভিলার আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয় খাদিজা আক্তার মেঘলা ওরফে মেঘনা ও মৌ নামের দুই নারী জঙ্গী। এরাও র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হামলা চালানোর সঙ্গে পরিস্থিতি মোতাবেক নারী বা পুরুষ আত্মঘাতী জঙ্গীদের অংশ নেয়ার দলীয় নির্দেশ রয়েছে। এজন্য নারী জঙ্গীদের আরও প্রশিক্ষিত করতে বিদেশ পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশ থেকে যুবক ও যুবতীদের পাকিস্তান, সিরিয়া ও ইরাক পাঠানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। বিদেশে থাকা নব্য জেএমবির সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশী জঙ্গীদের যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
×