ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুভ হত্যার চার দিনের মাথায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সবাই গ্রেফতার

প্রকাশিত: ১০:১৩, ১৩ জুলাই ২০১৯

শুভ হত্যার চার দিনের মাথায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সবাই গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কিশোর গ্যাং স্টারদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে নবম শ্রেণীর ছাত্র শুভ আহমেদ। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ঠান্ডা মাথায় তাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের মাত্র চারদিনের মাথায় শুভর সব খুনীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রধান খুনী মৃদুল হাসান পাপ্পু। এ সময় হত্যার কাজে ব্যবহৃত ধারাল সুইচ গিয়ার চাকু উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে- টঙ্গী পাগার এলাকার কামাল পাঠানের বাড়ির ভাড়াটে মহিউদ্দিনের ছেলে মৃদুল হাসান পাপ্পু (১৭), একই এলাকার হাবিবুর রহমানের ছেলে সাব্বির আহমেদ (১৬), নূরুল ইসলাম খোকনের ছেলে রাব্বু হোসেন রিয়াদ (১৬) ও আলতাফ উদ্দিনের ছেলে নূর মোহাম্মদ রনি (১৬)। র‌্যাব-১ কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গত ৭ জুলাই গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পূর্ব থানাধীন বিসিক ফকির মার্কেট পাগার মদিনাপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জেরে স্থানীয় পাগার ফিউচার ম্যাপ স্কুলের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র শুভ আহমেদকে বুকে, পিঠে ও মাথায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করা হয়। নিহত শুভ আহমেদ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ঘটনার পরদিন নিহতের বাবা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। র‌্যাব জানিয়েছে, টঙ্গী ও পার্শ্ববর্তী উত্তরা এলাকায় দীর্ঘদিন যাবত বেশকিছু কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয়। সব গ্যাং গ্রুপ তাদের দেয়া বিভিন্ন নামে পরিচিত। সাধারণত উঠতি বয়সের কিশোররা এসব গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত। অভিভাবকের অবহেলা ও পশ্চিমা কালচারের অনুকরণে এসব গ্যাং গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এসব গ্যাং গ্রুপের মধ্যে ছোট খাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। হত্যার একদিন আগে শুভর সঙ্গে স্থানীয় নবগঠিত একটি গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের ঝগড়া ও হাতাহাতি হয়। র‌্যাব আরও জানতে পারে একটি তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে এ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়। জানা গেছে, শুভ আহমেদের বাবা-মা উভয়ই স্থানীয় গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ঘটনার দিন আনুমানিক রাত ৯টার দিকে ভিকটিম শুভ তার মায়ের কাছ থেকে চুল কাটানোর জন্য টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। গভীর রাতেও ছেলে বাড়ি ফিরে না আসায় স্বজনরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। পরে টঙ্গী পাগার মদিনা পাড়াস্থ জনৈক স্বপনের বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে মরদেহ দেখে স্থানীয়রা টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশে খবর দেন। পরে থানায় গিয়ে স্বজনরা শুভর মরদেহ শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় এলাকায় চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যেভাবে খুন হলো শুভ ॥ স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর জানান, টঙ্গীতে বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে সহপাঠীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় নবম শ্রেণীর ছাত্র শুভ আহমেদ (১৪)। হত্যাকান্ডের আগের দিন নবম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা সফর শেষে ফেরার পথে পাপ্পু ও তার বান্ধবী একই সিটে বসলে মুঠোফোনে তাদের ছবি তোলে শুভ। এই ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে হাতাহাতি ও ঝগড়ার জের ধরে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এ হত্যাকান্ডে জড়িতরা ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য যারা বিভিন্ন স্কুলে নামমাত্র পড়াশোনা করে বলে র‌্যাব-১ এর প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি সুইচ গিয়ারসহ (চাকু) ৪ কিশোরকে গ্রেফতার করে শুক্রবার প্রেসব্রিফিং করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃতরা হলো- মামলার প্রধান আসামি মৃদুল হাসান পাপ্পু খান (১৭), সাব্বির আহমেদ (১৬), রাব্বু হোসেন রিয়াদ (১৬) ও নূর মোহাম্মদ রনি (১৬)। এরা সবাই টঙ্গীর পাগাড় ফিউচার ম্যাপ স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। নিহত স্কুলছাত্র শুভ আহম্মেদ টঙ্গীর ফকির মার্কেট এলাকার রাজু মিয়ার ছেলে এবং ফিউচার ম্যাপ স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। ব্রিফিংয়ে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে কর্নেল মোঃ সারোয়ার-বিন-কাশেম অভিভাবকদেরকে সন্তানদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে না দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, অভিভাবকদের অবহেলায় পশ্চিমা কালচারের অনুকরণে কিশোরদের গ্যাং গ্রুপ গড়ে উঠছে। এসব গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলে নামমাত্র পড়াশোনা করে, তারা দিনের বেশিরভাগ সময় দল বেধে হইহল্লা করে বেড়ায়। তাদের বেশভুষা, চালচলন ও আচার-আচরণে সর্বদা একটি অশালীনভাব দেখা যায়। এসব গ্যাং গ্রুপের মধ্যে মাঝে মধ্যেই ছোট খাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। গ্রেফতারকৃত মৃদুল হাসান পাপ্পু র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তার পিতা ওমান প্রবাসী এবং মা গৃহিণী। সে তিন ভাই-বোনে মধ্যে দ্বিতীয়। সে তাদের এলাকার নবগঠিত একটি গ্যাং গ্রুপের সদস্য। প্রায় ছয় মাস আগে ভিকটিম শুভ একই স্কুলের নবম শ্রেণীতে ভর্তি হলে তার সঙ্গে পাপ্পুর পরিচয় হয়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতাকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যা করা হয় বলে সে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে। ঘটনার পূর্বের দিন তারা শিক্ষা সফরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় জাদুঘরে যায়। শিক্ষা সফর শেষে ফেরার পথে পাপ্পু ও তার বান্ধবী একই সিটে বসলে শুভ মুঠোফোনে তাদের ছবি তোলে এবং অন্য সবাইকে দেখিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। আকস্মিক ছবি তোলাতে পাপ্পু ভিকটিমের উপর ক্ষুদ্ধ হয় এবং তাদের মধ্যে ঝগড়া ও হাতাহাতি হয়। এরই জের ধরে পাপ্পু, সাব্বির, রাব্বু ও রনি তাদের গ্রুপের সদস্যদেরকে নিয়ে আগের দিনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক রাত ১০টার পর কৌশলে শুভকে নির্জন স্থানে ডেকে নেয়। শুভকে মারধর করার সময় সাব্বির ও রাব্বু সুইস গিয়ার চাকু দিয়ে বুকে ও পিঠে আঘাত করে এবং রনি সাব্বিরের নিকট হতে চাকু নিয়ে শুভর মাথায় আঘাত করে। এসময় শুভ দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলে পাপ্পু তাকে পেছন থেকে ধাওয়া করে পিঠে আঘাত করলে সে মাটিতে পড়ে যায়। গ্রেফতারকৃত সাব্বির আহমেদ র‌্যাবকে জানায়, তার পিতা পেশায় একজন রড, বালি, সিমেন্টের কন্ট্রাক্টর এবং মাতা গৃহিণী। সে চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। সে তাদের নবগঠিত গ্যাং গ্রুপের একজন অন্যতম সদস্য। সে মূলত তাদের গ্রুপের সদস্যের অপমানের প্রতিশোধ নিতেই এই হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। হত্যাকা-ের দিন স্কুলে দুপুর বেলা টিফিনের সময় তারা এই পরিকল্পনা করেছিল বলে জানায়। গ্রেফতারকৃত রাব্বু হোসেন রিয়াদ র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে স্থানীয় ফিউচার ম্যাপ স্কুলে ৯ম শ্রেণীতে পড়ে। তার পিতা পেশায় একজন কাপড় ব্যবসায়ী এবং মাতা গৃহিণী। সে তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। গ্যাং গ্রুপের প্রতি আসক্তির কারণে সেও নবগঠিত এই গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ভিকটিমের সঙ্গে ইতোপূর্বে তার টাকা লেনদেনের বিষয়ে বিরোধ হয়েছিল। এছাড়াও একটি মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে ঝগড়া চলছিল বলে রাব্বু র‌্যাবকে জানায়। গ্রেফতারকৃত নূর মোহাম্মদ রনি জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে ফিউচার ম্যাপ স্কুলের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। তার পিতা একজন লিবিয়া প্রবাসী এবং মাতা গৃহিণী। সে দুই ভাই-বোনে মধ্যে বড়। সে গ্যাং কালচারের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে আকৃষ্ট হওয়ায় নবগঠিত এই গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে জড়িত হয়। সে তাদের গ্রুপের পাপ্পুর কথামতো এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশে এই হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করেছিল বলে জানায়। উল্লেখ্য, গত রবিবার রাতে টঙ্গীর পাগাড় ফকির মার্কেট এলাকায় স্থানীয় ফিউচার ম্যাপ স্কুলের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র শুভকে স্কুলের কাছে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যাকান্ডের পর থেকে ঘাতকদের গ্রেফতারের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অবশেষে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উল্লেখিত ওই ৪ কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়।
×