ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণের প্রাক্কালে রাজত্ব শুরু বর্ষার

মেঘমল্লার সারা দিনমান বাজে ঝরনার গান বাজে ঝরনার গান...

প্রকাশিত: ১০:১০, ১৩ জুলাই ২০১৯

মেঘমল্লার সারা দিনমান  বাজে ঝরনার গান  বাজে ঝরনার গান...

মোরসালিন মিজান ॥ ‘মেঘমল্লার সারা দিনমান/বাজে ঝরনার গান... বাজে ঝরনার গান।’ ঝরনার গান বাজল সারা দিন। লম্বা সময় ধরে সুর তুলল বৃষ্টি। বৃষ্টি তো নয়, যেন মিয়া তানসেনের মেঘমল্লার। মহান সঙ্গীতসাধক নিজের সৃষ্টি করা এই রাগ সম্রাট আকবরের সভায় বসে বাজাতেন। শুক্রবারের বৃষ্টি যেন প্রিয় সেই রাগের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেল রাজধানীবাসীকে। অনেকে জানালা দিয়ে বাইরের পানে তাকিয়ে ছিলেন। কান পেতে শুনছিলেন বৃষ্টিকে। যাদের ভেতরটা আরও তরুণ, তারা সিঁড়ি বেয়ে দিব্যি উঠে গিয়েছিলেন বাসার ছাদে। বর্ষার নয়া পানিতে ভিজে শরীর শীতল করেছেন। তরুণীরা কিশোরীরা হাত ধরাধরি করে নেচেছে। দেখে মনে হয়েছে, বর্ষার সুর তারা ঠিক শুনতে পাচ্ছে এখন। এখন বলার কারণ- গত প্রায় এক মাস আগে শুরু হয়েছে বর্ষা। আষাঢ়ের প্রথম দিন বৃষ্টিও হয়েছিল। কিন্তু সহসাই দেখা গেল অন্য রূপ। রুক্ষ শুষ্ক ধরণী। অসহ্য গরম। এ অবস্থায় বৃষ্টির জন্য প্রতিক্ষা করে ছিলেন রাজধানীবাসী এবং অতঃপর শ্রাবণ শুরুর প্রাক্কালে অঝোর ধারায় ঝরল বৃষ্টি। গত কয়েকদিন ধরেই টানা বর্ষণ। চির চেনা ছন্দে ফিরছে বর্ষা। রাজত্ব শুরু করছে। আবহাওয়া অফিস জানায়, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঢাকায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৬ মিলিমিটার। এর মধ্যে দুপুরের দিকে মাত্র সোয়া দুই ঘণ্টায় ঢাকায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৯ মিলিমিটার। কখনও ভারিবর্ষণ। কখনও মুষলধারে বৃষ্টি। টিপটিপ বৃষ্টি ছিল লম্বা সময় ধরে। এদিনের বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। গায়ে পড়তেই ভীষণ ঠা-া একটা অনুভূতি হয়েছে। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ এদিন বাসায় ছিলেন। বর্ষার রূপটা বেশ প্রত্যক্ষ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা...। এসেছে যে, বর্তমানে তা অনুভব করা যাচ্ছে। প্রকৃতিতে নতুন প্রাণ এনে দিয়েছে বর্ষা। মানুষের মনেও জাগিয়ে দিয়েছে প্রেমের বোধ। কবিগুরুর ভাষায়: মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে/আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে...। অন্যত্র তিনি বলেন: তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। অভিন্ন হৃদয়াবেগের কথা জানিয়ে নজরুল লিখেছেন: রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা।/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা।/ঘুমন্ত ধরা মাঝে/ জল-নূপুর বাজে,/বিবাগী মন মোর হলো পথহারা...। ভাটি বাংলার লোক কবি উকিল মুন্সি তো আরও উতলা। গানে গানে তিনি বলছেন: যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/ অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে...। হ্যাঁ, আরও অনেক কথা কবিতা গান নতুন করে সামনে এনেছে বর্ষা। বর্ষাকে বিরহের ঋতুও বলা যায়। এ সময় পুরনো বিয়োগ ব্যথা বুকে বাজে। বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির ভাষায়: এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর...। কবি অন্যত্র লেখেন- অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই...। একইরকম শূন্যতার কথা জানিয়ে লোককবি দুর্বিন শাহ লেখেন- প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া...। সব মিলিয়ে অদ্ভুত আবেদন বর্ষার। বাঙালীর জীবনে এই ঋতুর প্রভাব বলে শেষ করা যাবে না। শ্রাবণে আবেদনটুকু আরও গাঢ় হবে। মাতিয়ে রাখবে বর্ষা রানী- সকলের তাই প্রত্যাশা।
×