ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নেকড়ে ও বুদ্ধিমতী মুরগি

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ১৩ জুলাই ২০১৯

নেকড়ে ও বুদ্ধিমতী মুরগি

এক বনে ছিল এক নেকড়ে। তার যন্ত্রণায় বনের সব পশুপাখি অস্থির থাকত সবসময়। পশুপাখিরা তাদের ছোট ছানাদের দূরে কোথাও যেতে দিত না নেকড়েটার ভয়ে। একটু সুযোগ পেলেই নেকড়ে গপ করে গিলে ফেলে ছানাগুলোকে। সেই বনে বাঘ ছিল না। তাই বনের রাজাও ছিল না কোন। সবাই সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে মিলেমিশে চলত। শুধু ওই নেকড়েটাই ছিল বনের পশুপাখিদের একমাত্র আতঙ্ক। একদিন বিকেলে বনের একটা খরগোশ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো বনের মাঝখানটায়। তার চিৎকার শুনে পশুপাখিরা সবাই এসে জড়ো হলো। বানর জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে খরগোশ? তুমি কাঁদছ কেন? খরগোশ কিছুই বলতে পারল না। হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। হাতি তার শুঁড় খরগোশের পিঠে আলতো করে ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে খরগোশ? আমাদেরকে বল? খরগোশ এবার কাঁদতে কাঁদতেই জানাল, তার ছানাটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে পুরো বন খুঁজেছে। দুই ঘণ্টা ধরে খুঁজছে সে। পাচ্ছেই না। কাঠবিড়ালি জিজ্ঞেস করল, কখন থেকে খুঁজে পাচ্ছ না গো ছানাটাকে? কিভাবে হারিয়ে গেল? খরগোশ কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার কাছেই ছিল তো। দুপুরে ওকে পাশে নিয়েই গাছের নিচে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। কখন যেন চোখ লেগে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি ছানাটা নেই! কত খুঁজলাম, কোথাও নেই! বনের পশুরা তাকে সান্তনা দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই খেলতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। তুমি চিন্তা কোরও না। আমরা সবাই মিলে খুঁজে বের করব তাকে। বনের পশুরা সবাই মিলে সারা বনে খুঁজল। কোথাও পাওয়া গেল না খরগোশের ছানাটাকে। হৈচৈ শুনে বটগাছে ঝুলে ঘুমিয়ে থাকা বাদুড়টা জেগে উঠল। চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কি ঘটনা বল দেখি হে? এত চেঁচামেচি কিসের? পশুরা বলল ঘটনাটা। বাদুড় আঁতকে উঠে বলল, ওই পাজি নেকড়েটা কিছু করেনি তো? এই কথাটা পশুদের মাথায় আসেনি। কথাটা ভেবেই তারাও আঁতকে উঠল। সবাই মিলে বলাবলি করতে লাগল, এটা তো হতেই পারে। কিন্তু এটা তাদের মাথায় আসেনি তো! দোয়েল পাখি বলল, নেকড়েটাকে কিন্তু দুপুরের পর থেকে কোথাও দেখিনি। বনে যে এত হৈচৈ, এত শোরগোল, কোথাও কিন্তু সে নেই! হরিণ বলল, ওই নেকড়ে ব্যাটাকে আগে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর ওকে চেপে ধরলেই সব জানা যাবে। বনজুড়ে আবার খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল। খুঁজতে খুঁজতে নেকড়েটাকে পাওয়া গেল বন থেকে কিছুটা দূরে একটা গাছের নিচে। সে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছিল। তার আয়েশ করে ঘুমানো দেখেই বানরের বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই পুরো ব্যাপারটাতে নেকড়ের হাত আছে নিশ্চয়ই। বানর গিয়ে সব পশুকে ডেকে নিয়ে এল। সবাই মিলে নেকড়েকে ঘিরে ধরল। তাকে ডেকে ঘুম থেকে তোলা হলো। সবাই তাকে জিজ্ঞেস করল খরগোশের ছানার কথা। সে তো প্রথমে স্বীকারই করল না কিছু! তারপর সবাই যখন তাকে মারধর করতে গেল, তখন সে বিপদে পড়ে স্বীকার করল যে খরগোশের ছানাকে সে-ই চুরি করে এনেছে। সে বলল, ছানাটাকে চুরি করে এনে একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে সে, রাতে খাবে বলে। সবাই তাও একটু নিশ্চিন্ত হলো। খরগোশ ছানার কোন ক্ষতি হয়নি তাহলে! সবাই মিলে নেকড়ের দেখানো গর্তের কাছে গেল। বেশ গভীর একটা গর্ত। ওখানে খরগোশ ছানাকে ফেলে দিয়েছে নেকড়ে। ছানাটা ওখান থেকে উঠে আসতে পারছে না। হাতি তার শুঁড় দিয়ে ছানাটাকে টেনে তুলল। পশুরা ঠিক করল, নেকড়ের এমন অত্যাচার আর সহ্য করা হবে না। সবাই মিলে বিচার বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিল, নেকড়েকে বন থেকে বের করে দেয়া হবে। আর হলোও তাই। সবাই মিলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নেকড়েকে বন থেকে বের করে দিল। নেকড়েটা তখন কোথায় যায়? সে চলে গেল পাশের গ্রামে। গ্রামের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রইল। সন্ধ্যা নামতেই নেকড়ের চোখে পড়ল, কয়েকটা মুরগি কক কক করতে করতে ঘরে ফিরছে। তাদের দেখেই নেকড়ের জিভে পানি চলে এল। ভাবল, এদের দিয়েই রাতের খাবারটা সারা যাবে! গ্রামে এত সুস্বাদু খাবার থাকতে ওই বনে সে কেন ছিল ভেবেই পেল না। সেদিন রাতে নেকড়েটা চুপিসারে হাজির হলো গৃহস্থের বাড়ির মুরগির খোঁয়াড়ে। ওই গ্রামে চোরের উপদ্রব নেই। তাই খোঁয়াড় তালা দেয়া থাকত না। নেকড়ে সহজেই খোঁয়াড়ের দরজা খুলে ফেলল। যেই সে একটা মুরগিকে ধরতে যাবে, মুরগিদের ঘুম ভেঙে গেল। কক কক করে ডেকে উঠল সবাই। নেকড়ে রাগী গলায় বলল, এত ডাকাডাকি করবি না! একদম চুপ! আমি শুধু তোদের মধ্যে একজনকে খাব। ডাকাডাকি করে সবাইকে জাগিয়ে দিলে সব কয়টাকে একসঙ্গে খাব। ওই খোঁয়াড়ে ছিল এক বুদ্ধিমতী মুরগি। সে এগিয়ে এসে বলল, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমাদের সবাইকে একে একে খেয়ে ফেলার পর তো আর গ্রামে মুরগি থাকবে না। তখন তুমি খাবে কী? তারচেয়ে বরং তুমি এক কাজ কর। আমাদের মতো তুমিও এই খোঁয়াড়ে ঢুকে থাক। মানুষ পশুপাখি পালতে পছন্দ করে। পশুপাখিরা তাদের কাছে থাকলে তারা খুশি হয়। প্রতিদিন ভাল ভাল খাবার দেয়। এই যে আমাদেরকেই দেখ না, ভাল ভাল খাবার খেয়ে কেমন চকচকে পালক! কী সুন্দর নাদুসনুদুস শরীর! তুমি যদি মানুষের কাছে থাকো, তবে তুমিও এমন আরামে থাকবে। কোন কাজই করতে হবে না তোমাকে। নেকড়ে একটু ভাবল। মানুষ সম্পর্কে তার তেমন জানা ছিল না। সারাজীবন বনেই কেটেছে তার। ভেবেচিন্তে সে দেখল, মুরগিটা ঠিকই বলেছে! এই বুদ্ধিটাই ভাল বুদ্ধি। নেকড়ে তখন বলল, বেশ তো। তাই করব আমি। কিন্তু মানুষ আমাকে সত্যিই মেনে নেবে তো? কোন ক্ষতি করবে না তো? মুরগিটা তখন বলল, তুমি দেখতে পাওনি, গ্রামের মানুষগুলোর বাড়িতে কত ছাগল, ভেড়া, গরু, কুকুর, বিড়াল? এদের সবাইকে মানুষ পোষে! কারও ক্ষতি করতে দেখেছ? তুমি থাকলে তোমাকেও পুষবে। ক্ষতি করবে কেন? নেকড়ে তখন মুরগির কথা বিশ্বাস করে নিল। সে খোঁয়াড়ে ঢুকে পড়ল। সে ঢুকতেই মুরগিরা সবাই বেরিয়ে এলো। বুদ্ধিমতী মুরগিটা বলল, খোঁয়াড়টা তো তেমন বড় না, আমরা থাকলে তোমার ঘুমাতে অসুবিধা হবে। তুমি এখানে ঘুমাও, আজ রাতটা আমরা উঠানেই থাকি। নেকড়ে খোঁয়াড়ের ভেতর খড়ের ওপর আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল। এমন আরামের বিছানায় কখনই ঘুমায়নি সে! বেশ ভাল বুদ্ধি দিয়েছে তো মুরগিটা! পরদিন সকালে গৃহস্থ ঘুম থেকে উঠেই দেখে খোঁয়াড়ে একটা নেকড়ে ঘুমাচ্ছে। সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল, মুরগিগুলোকে খেতেই নেকড়েটা এসেছিল! কিন্তু মুরগিগুলো কীভাবে পালিয়েছে এটা সে বুঝতে পারল না। গৃহস্থ চিৎকার করে লোকজন জড়ো করল। সবাই মিলে লাঠিসোটা দিয়ে আচ্ছা করে পেটাল নেকড়েটাকে। তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হলো। মুরগিরা তো খুব খুশি। বুদ্ধিমতী মুরগিটা কক কক করতে করতে বলল, লোভ করলে এভাবেই শাস্তি পেতে হয়! এই খবর বনের পশুরাও জানতে পারল। তারাও নিশ্চিন্ত হলো। নেকড়েটা আর কখনও কারও ক্ষতি করতে আসবে না। তারাও বলাবলি করল, অন্যের ক্ষতি করলে একদিন না একদিন শাস্তি পেতেই হয়! এরপর বনের আর গ্রামের পশুপাখিরা সুখে বসবাস করতে লাগল। ওই দুষ্টু নেকড়ে আর কখনই কারও ক্ষতি করতে পারেনি। অলঙ্করণ : প্রসুন হালদার
×