ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারি বর্ষণ, পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ১১:০১, ১২ জুলাই ২০১৯

 ভারি বর্ষণ, পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় লক্ষাধিক  মানুষ পানিবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে এবং নদীর পানি বাড়ার কারণে বন্যায় দেশের বিভিন্ন স্থানের নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পানি কারণে তিস্তায় পানির বেড়ে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উত্তরের বিভিন্ন জেলার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অনেকে। বেড়ে গেছে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতাও। দেশের ওপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে গত কয়েকদিন ধরেই সারাদেশের ভারি বর্ষণ শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, একই কারণে আজও রংপুর ময়মনসিংহ, সিলেট চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। রাজধানী ঢাকায় এখন পর্যন্ত ভারি বর্ষণ না হলেও গত কয়েকদিন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শুরু হয় বৃষ্টিপাত। সন্ধ্যা পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। বৃষ্টিতে সাধারণ মানুষকে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। রাজধানীতে দেখা দেয় প্রচন্ড যানজট। এদিকে বৃহস্পতিবারের ভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রামে পটিয়া পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানি। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এই এলাকার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রায় ৪শ’ পরিবার চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। লালমনিরহাট নীলফামারীতে তিস্তা নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। নদী পাড়ের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বাড়ার ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের কারণে নেত্রকোনায় ২ শতাধিক গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দেশে সব নদ-নদীর সমতলে পানি বাড়ছে। তারা জানিয়েছে, দেশের প্রধান নদীসহ ৬৯টি নদীর পানি বাড়ছে। এর মধ্যে ৯টি নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ভারি বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে দেশে সব নদীর পানি বেড়ে বিভিন্ন এলাকায় বন্যা মাঝারি মানের দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, এই বন্যা আরও কয়েকদিন স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে উল্লেখ করেন এই মুহূর্তে বড় ধরনের বন্যার কোন পূর্বাভাস নেই। নীলফামারী ॥ গর্জে ওঠা তিস্তা নদী রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে চলেছে। নদীর উথাল পাতাল ঢেউ আর শোঁ-শোঁ শব্দ নদীর পাড় কাঁপিয়ে তুলেছে। গোজলডোবা তিস্তা ব্যারাজের জলকপাট খুলে দেয়ায় উজানের ঢল বৃদ্ধি পাওয়া ভারত তাদের অংশে জারি করেছে হলুদ সতর্কতা। এতে করে উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বৃহস্পতিবার জেলার ডিমলা উপজেলায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ওই পয়েন্টে নদীর পানির বিপদসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। এতে জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার নদী তীরবর্তী ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। উজানের ঢলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চর ও চর বেষ্টিত গ্রামের বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরে উঁচুস্থানে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। লালমনিরহাট ॥ তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজান ও রত্নাই নদীসহ ছোট বড় সকল নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তা নদী বিপদসীমার ৮ সেঃ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীর দু’কূল উপচে পড়েছে। গত দু’দিন ধরে দিনরাত্রি ভারি বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ী ঢলে নদ-নদীর পানি বেড়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে লালমনিরহাটে নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের প্রায় ২৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে পানির তোড়ে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে কুড়িগ্রামে সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে করে নদ-নদী তীরবর্তী নিম্ন‍াঞ্চলের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ২০টি গ্রামের ১০ হাজার মানুষ। গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে দুর্ভোগে পড়েছে এসব এলাকার মানুষজন। কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর হাট সড়কের শুলকুর বাজার এলাকায় নির্মাণাধীণ ব্রিজের পাশের বাঁশের সাঁকো তলিয়ে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী হাট যাত্রাপুরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ওই ব্রিজ এলাকায় লোকজন নৌকায় পারাপার করছে। নদ-নদী তীরবর্তী নিম্ন‍াঞ্চলগুলোতে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন শাক-সবজি ক্ষেত। নদী পাড়ের বাসিন্দারা জানায়, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। গাইবান্ধা ॥ গত কয়েকদিনের একটানা ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে গাইবান্ধার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, করতোয়া ও ঘাঘটসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এতে সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা এবং সদর উপজেলার চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী নিচু এলাকাসহ চরাঞ্চলগুলোতে পানি উঠতে শুরু করেছে। ফলে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত ও অস্থায়ী নৌঘাটগুলো তলিয়ে গেছে। পটিয়া, চট্টগ্রাম ॥ ভারি বর্ষণ, পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানিতে পটিয়া পানিতে ভাসছে। উপজেলার ১৭ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার নিম্ন‍াঞ্চল পানিতে ডুবে রয়েছে। এলাকার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্রাইমারি স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাঁটু পরিমাণ পানি জমে রয়েছে। ফলে বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পানির স্র্রোতে বেশকিছু মাটির বসতঘর ভেঙ্গে পড়েছে। অতিবৃষ্টি কারণে শ্রমজীবী মানুষ বাড়ি ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। তাছাড়া কৃষকের সবজিসহ নানা ধরনের ফসল ক্ষেত পানিতে ডুবে রয়েছে। বেড়িবাঁধের ৩টি স্পটে ভেঙ্গে বসতঘরসহ বিলীন হয়ে গেছে। খাগড়াছড়ি ॥ খাগড়াছড়ি জেলায় পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি ও পাহাড় ধসের ঘটনা অপরিবর্তিত রয়েছে। মাইনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে দীঘিনালা উপজেলায় ২৫টি গ্রামের সহস্র্রাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সেখানে ১২টি আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে ৩শ’ পরিবার। তলিয়ে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। নষ্ট হয়েছে জমির ফসল। মেরুং এলাকায় সড়ক ও সেতু পানি নিচে তলিয়ে যাওয়ায় দীঘিনালার সঙ্গে রাঙ্গামাটির লংগদু সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছন্ন রয়েছে। নেত্রকোনা ॥ তিনদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের পানিতে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের নিম্ন‍াঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গারো পাহাড়ের কূল ঘেষে অবস্থিত সীমান্তবর্তী এ দুই উপজেলার অন্তত দুই শতাধিক গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবারের ভিটামাটি পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। বিরিশিরি ইউনিয়নের ১শ’ ৫০টি এবং কাকৈরগড়া ইউনিয়নের ৪৬টি পরিবার স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। প্লাবিত এলাকার অনেক সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে কংস, সোমেশ্বরী ও উব্দাখালি নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাঙ্গামাটি ॥ ৬ দিনের প্রবল টানা বর্ষণে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি বলকল ও লংগদু উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বহু ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। জনজীবন একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাহাড় ধস অব্যাহত রয়েছে। বাঘাইছড়ি উপজেলা মাঠ ৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বহু লোক গৃহহারা হয়েছে।
×