ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কক্সবাজারের নীল জলরাশি

প্রকাশিত: ১০:১৯, ১২ জুলাই ২০১৯

কক্সবাজারের নীল জলরাশি

শ্যামল বাংলার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্ভার আবহমানকাল থেকে তার সন্তানদের শান্ত-স্নিগ্ধ অনুভবে জীবন কাটাতে উদ্বেলিত করে। পাহাড়, বন আর সমুদ্র পরিবেষ্টিত ছোট্ট এই ভূখন্ডটি ছায়াঘেরা পরিবেশের এক অনবদ্য রূপ সম্ভার। ভিন্ দেশী পর্যটক স্বদেশী কবি-সাহ্যিতিক সেই প্রাচীনকাল থেকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার নয়নাভিরাম মাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়েছেন। নদ-নদী বিধৌত বাংলার নরম উর্বর পলিমাটি এ দেশের মানুষের জীবনে অবারিত শস্যভান্ডারের দ্বার খুলে দেয় তাও যেন নিসর্গের অনন্য উপহার। বৈষয়িক আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলার অপরূপ মাধুর্য উপভোগ করতে দেশী-বিদেশী বহু ভ্রমণকারী দর্শনীয় জায়গুলো ঘুরে বেড়াতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বঙ্গোপসাগরের অপার জলরাশির নিকটবর্তী স্থানে এমনভাবে নিজের বৈভব নিয়ে দর্শনার্থীর মনোরঞ্জন করে কক্সবাজারের মতো বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। সারা বাংলার আলোকে একেবারে নির্দিষ্টভাবে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও বিধাতার এক অপরূপ মনোজ্ঞ সৃষ্টি বৈচিত্র্য। আর এই বৈচিত্র্যিক চট্টগ্রামের আর এক ঐশ্বর্যময় সম্পদ কক্সবাজার। ভ্রমণকারীদের জন্য চমৎকার দর্শনীয় স্থান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আনন্দ নিকেতনের অপূর্ব মিলনকুঞ্জ। এখনো সারা বিশ্ব এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু পর্যটক অবসর আর ভাল সময় কাটানোর জন্য এমন সৌন্দর্যপুরীতে অবগাহন করে। পাহাড়ী এলাকা চট্টগ্রামের পাহাড় সম্পদ ও আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থেকে অসংখ্য ভ্রমণকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাচ্ছে। বনাঞ্চলের সুরম্য লীলা নিকেতন সুশোভিত চট্টগ্রাম পর্যটন শিল্পে যে মাত্রায় ভূমিকা রেখে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কক্সবাজারের সমুদ্র তীরে অজ¯্র ঢেউয়ের নান্দনিক উচ্ছ্বাস ৪ জুন মঙ্গলবার নভোএয়ারের ফ্লাইটে দুপুর ১২টায় কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছলাম সমুদ্র তনয়ার সঙ্গে তিন দিন কাটাব বলে। সঙ্গে কন্যা নমি। চট্টগ্রামের মেয়ে আমি। অতি অল্প বয়স থকে নদী, সমুদ্র. পর্বত আর বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বড় হওয়া। সমুদ্র দর্শনও মাঝে মধ্যে হয়েই যেত। তবে রাজধানী থেকে কক্সবাজারের রূপমাধুর্য অবগাহন করতে যাওয়ার আনন্দ আর উচ্ছ্বাস একেবারেই আলাদা। নেমেই মনে হয় অজানা, অচেনা নতুন পরিবেশে মাত্র পা রাখলাম। আসলে সমুদ্র মানেই নতুন অভিজ্ঞতা-উদ্দীপনা আর প্রথমবারের মতো দেখার এক চমকপ্রদ ভাবের অন্যমাত্রার আবেগ। সাগরের অথৈই জনস্রোত নিত্য নতুন উন্মাদনায় পর্যটকদের যেভাবে আপ্লুত করে তার তুলনা অন্য কিছু হতে পারে না। প্রাকৃতিক সম্ভারে সমৃদ্ধ এই নদী স্রোত বঙ্গভূমির সমুদ্র স্ন‍ান যে কত মনোহর এবং অভিভূত হওয়ার ব্যাপার নিজে উপভোগ না রকলে বোঝা অত সহজ হয় না। ভ্রমণকারীর আনন্দে আত্মহারা হওয়ার এমন সুবর্ণ সময়ে সমুদ্রও কেমন সুখ সাগরে অবগাহন করে সে অনুভব ও উপস্থিত সবাইকে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়। পর্যটন শিল্পের মাধুর্য স্রোত এই সমুদ্রের উপভোগ্য জায়গাটি এখনও ভ্রমণপিয়াসিদের জন্য অতখানির আরামদায়ক কিংবা সুখকর হয়ে ওঠেনি সমুদ্র পাড়ের বৈরী আবহাওয়ার সব সময়ই ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কায় জনজীবন সন্ত্রস্ত থাকে। বিক্ষুব্ধ পরিবেশকে মোকাবিলা করে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা তাদের প্রতিদিনের জীবন প্রবাহকে টেনে নিয়ে যায়। জুন মাসের ৪ তারিখ। জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি সময়। আষাঢ় মাস তখন অবধি তার আগমনী বার্তাকে জানান দেয়নি। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। কিন্তু কক্সবাজারে নেমেই দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি। আর বৃষ্টিতে সমুদ্রপাড়ের চার পাশে হাঁটুজল পানি জমে যেতে মোটেও সময় লাগল না। বেহাল রাস্তাঘাটের এমন দুরবস্থা যা পরিবহন চলাচলের একেবারে অযোগ্য। আর সমুদ্রের ধারেকাছে ঢেউ খেলানো বালুর বিস্তীর্ণ স্তূপ পায়ের ছাপ আর গাড়ির চাকায় দলিত-মথিত হয়ে সমুদ্রের বৈভবের যে অঙ্গহানি করে তা মোটেও ভ্রমণপিয়াসিদের আনন্দ দিতে পারে না। সমুদ্রের কাছে হোটেল সাইমনের মতো পাঁচ তারা অত্যাধুনিক, বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট থাকা সত্যিই অপরিহার্য। তার চেয়ে বেশি জরুরী হোটেলে প্রবেশ করতে গেলে যে খানাখন্দ পরিপূর্ণ রাস্তাঘাট পার হয়ে আসতে হয় তার সুব্যবস্থা এবং পরিবহন চলাচলের উপযোগী করে তোলা। তা না হলে ভ্রমণের যে আনন্দ আর উচ্ছ্বাস তা মাটি হতেও বেশি সময় লাগে না। উন্নত বিশ্বের তুলনায় পর্যটন শিল্পে আমাদের মানগত অবস্থান এখনও সেভাবে এগিয়ে আসেনি। পাহাড়ী অঞ্চল দর্শনেও একই অবস্থা। উপর্যুপরি পাহাড়ধস আর ধ্বংস করার যে অপসংস্কৃতি প্রকৃতির ওপর মরণ আঘাত হানে তাও এই অঞ্চলকে তার স্বকীয়তা থেকে অন্য বিসদৃশ অবস্থানে নিয়ে যায়। যা পর্যটকদের আনন্দ যাত্রা নানামাত্রিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। আমাদের অবশ্যই সমুদ্র, পাহাড়, বনের নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থানগুলোকে পর্যটকদের উপযোগী করে তুলতে সব ধরনের কর্মপরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সুশোভিত, মনোহর বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প যদি বিশ্ব মানের অবস্থানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় তা হলে আমাদের অফুরন্ত নৈসর্গিক বৈভব তার মর্যাদা হারাতে বেশি সময় নেবে না। আকর্ষণীয় দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারকে বিশ্বের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে যেখানে অসংখ্য ভ্রমণকারী প্রায়ই সব সময়ই এই নয়নাভিরাম বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার আর সাগরের অথৈ তোলপাড়কে উপভোগ করতে চলে আসে আমাদের এই সমস্যাজর্জরিত ক্ষুদ্র দেশটিতে। বৈরী আবহাওয়া, সঙ্কটাপন্ন বিপর্যস্ত জনপদকে পর্যটন শিল্পের অনুকূলে নিতে হলে আরও আধুনিক প্রকল্প হাতে নিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর এমন দর্শনীয় স্থানটিকে ভ্রমণকারীদের উপযোগী করে তুলতে হবে। পর্যটন মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। প্রতিদিনের কর্মকোলাহল জীবনে ক্লান্তি, অবসাদ, একঘেয়েমি আসা অমূলক নয়। নিত্য জীবন প্রবাহের যান্ত্রিকতা, টানাপোড়েন, অস্থিরতা, অস্বস্তি সব মিলিয়ে এমন এক গতানুগতিক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা যেখান থেকে বের হয়ে নতুন কোন কিছু উপভোগ করা, আনন্দযোগের ভিন্নমাত্রা খুঁজে নেয়া সেও যেন জীবনের এক আবশ্যকীয় পর্যায়। ঘুরে বেড়ানোর নির্মল পরিবেশ যেভাবে ভ্রমণবিলাসীদের অন্যরকম অনুভবে বিমোহিত করে তেমন আনন্দযোগ অতুলনীয়। সেভাবে পর্যটনের দর্শনীয় স্থানগুলো যদি ভ্রমণ আয়োজনের অনুষঙ্গ হয় তা হলে ঘুরে বেড়ানোর মাত্রাটাই কানায় কানায় ভরে ওঠে। কক্সবাজারের মতো সমুদ্র তীরে গড়ে ওঠা শহর দর্শনার্থীদের মিলনমেলায় যে অভাবনীয় আবেগ অনুভূতি তা সাগর পাড়ে না গেলে বোঝা মুশকিল। তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন শোনার মোহনীয় আবেশ কোন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করায় তা দু’পাশের অথৈ জলরাশি কিংবা বালুর চরের নমনীয় পা ফেলার মধ্যেই অন্য জগতের দ্বারে প্রবেশ করার মতোই। অত্যাধুনিক আর বিলাসবহুল পাঁচ তারা হোটেল সাইমনের মূল্যমান বেশি হলেও ভ্রমণকারীদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার বলয়ে এর কোন তুলনাই হয় না। সাইমনের নিজস্ব পরিবহন বিমানবন্দর থেকে নিয়ে ও দিয়ে আসতে যে ভূমিকা পালন করে তাও সংশ্লিষ্টদের জন্য এক বিরাট সহযোগিতা। ছোট শহর, অপ্রতুল যানবাহন, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা তার চেয়েও বেশি উন্নতমানের পরিবহন সরবরাহের ঘাটতি সব মিলিয়ে সাইমনের এমন আশাতীত সেবার মান সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। নতুন সময়ের এই সাইমনে সুইমিং পুলসহ আধুনিক সমস্ত ব্যবহারযোগ্য আয়োজন ভ্রমণকারীদের জন্য এক অভাবনীয় আকর্ষণ। সবচেয়ে মুগ্ধতার বিষয় বিচের সঙ্গে একেবারে নিকটবর্তী এই মনোরম রেস্টুরেন্ট। দাম একটু বেশি হলেও সবকিছু বিবেচনা করলে পুষিয়ে নিতেও কষ্ট হয় না। সাইমন থেকে ২/৩ মিনিটের মধ্যে সমুদ্রের ধারে কাছে চলে যাওয়া যায়। প্রচন্ড বৃষ্টিতে সাইমনে বসেও সমুদ্রের শোভা দর্শন করা কোন ব্যাপারই নয়। ভ্রমণটা সত্যিই উপভোগ্য করতে সমুদ্রের ধারে কাছে কোন আবাসিক হোটেলে থাকার জায়গা নিলে সব থেকে ভাল হয়। কারণ বৃষ্টি স্নাত বাংলায় অবিরাম বর্ষণের কোন নিয়ম কিংবা ঋতুও নেই। সারা বছর বৃষ্টি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভারি বৃষ্টিতে ব্যক্তিগত পরিবহনও তেমন কোন কাজে আসে না। ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে আমরা বৃষ্টিকেই বরণ করে নিলাম। সমুদ্র সৈকত দেখার আনন্দ যদিও কমে নেই তবে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ও আনন্দের মাত্রাকে ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছিল। ঈদের দিনে আমি ও নমি নতুন কাপড় পরেই ভিজে চুপসে গেলাম। দেখলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঝিনুকের তৈরি গহনার ঝুড়ি নিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে বিক্রির জন্য। এমন বর্ষণসিক্ত পরিবেশ তো তাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের অবধারিত ঘটনা। এই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে সমুদ্র পাড়ের সাধারণ মানুষরা টিকে থাকে। এসব সংগ্রামী চিত্র নিজের চোখে না দেখলে নদীবিধৌত আর বর্ষণসিক্ত বাংলার সামগ্রিক চিত্র অনুধাবন করা যায় না। নদীমাতৃক বাংলার উর্বর পলিমাটির সোঁদা গন্ধ বৈষয়িক আর নৈসর্গিক সম্ভারের তীর্থ স্থান আমাদের প্রিয় স্বদেশ যে কত মনোহর আর আকর্ষণীয় তা বুঝতে গেলে মাতৃভূমিকে নিজের মতো করে দেখে বেড়ানো ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। সুন্দর এই অনন্য বাংলাদেশ তার নিজস্ব মহিমায় যে মাত্রায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে সেখানে তার কোলের সন্তানরাও থাকে এক গৌরবান্বিত অহঙ্কারের নিবিড় সান্নিধ্য আর ছায়ায়। তবে ঋতুবৈচিত্র্যের এই সমৃদ্ধ ভূখন্ডটি শুধু ষড়ঋতুর বিভিন্নতায় নয় অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের আপন বৈভবের তারতম্যতায় দৃশ্যমান ও দর্শনীয় সম্পদগুলো হয়ে যায় ভিন্নমাত্রার আবহের অনন্য রূপশৌর্য। পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও বনাঞ্চল পরিবেষ্টিত সমুজের সমারোহে ঋতুচক্রের প্রভাবও মনোমুগ্ধকর এবং অনন্য অনুভব।
×