ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কেমন আছে লাল সবুজের দেশ?

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১২ জুলাই ২০১৯

 কেমন আছে লাল সবুজের দেশ?

আইনের শাসনের যথার্থ প্রয়োগ রামিসা রাফিকা ইডেন মহিলা কলেজ দেশের বর্তমান অবস্থা কোন সভ্য সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না বলে মনে করেন ইডেন মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রামিসা রাফিকা। তার মতে, ‘সাম্প্রতিককালে যেই পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে বর্তমানে এটি একটি সামাজিক অবক্ষয়ের একটি ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরেছে। আমাদের দেশে আইনের শাসন থাকলেও এর যথার্থ প্রয়োগ শুধু নিম্নবিত্ত কিংবা খেটে খাওয়া মানুষের উপরই প্রয়োগ করা হচ্ছে ফলে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার ফলে অপরাধীরা খুব সহজেই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে আসতে পারছে। আবার দেখা যায়, অপরাধী চক্রের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের একটি অলিখিত আঁতাত থাকে। তাছাড়াও নতুন ইস্যু তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ইস্যু ভুলে যাচ্ছি। একজন মানুষ যখন আরেকজন মানুষকে হত্যা করে কিংবা হত্যা করার জন্য প্রশ্রয় দেয়, তখন সমাজ আর সমাজ থাকে না। কোন সভ্য সমাজে এ অবস্থা চলতে পারে না।’ * অপরাধের তাৎক্ষণিক প্রতিকার শামিমা ছিদ্দিকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শামিমা ছিদ্দিকা দেশের সার্বিক বিষয়গুলোর আশানুরূপ পরিবর্তনের শূন্যতা অনুভব করেন। তার মতে, ‘যত মানুষ দাঁড়িয়ে দিনে দুপুরে জনসম্মুখে হওয়া অপরাধগুলো নির্বিকারভাবে দেখে তাদের কিছুটা অংশও যদি প্রতিবাদের আওয়াজ তুলত হয়ত বর্তমান বাংলাদেশ এর চিত্রটা অন্যরকম হতো। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও আশানুরূপ পরিবর্তন কেন জানি হয়নি। পরিপূর্ণ মানবতাবোধসম্পন্ন জাতি হয়ে উঠতে অন্তর্গত পরিবর্তনের যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশ্বায়নের ধারাবাহিকতায় এবং প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে আমাদের যতটা উপকৃত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার না শিখিয়ে প্রযুক্তি হাতে তুলে দেয়ার দরুন ক্ষতির দিকের পাল্লাটাই বরং ভারি হয়েছে দিনে দিনে। অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচারের আওতায় না আনার সংস্কৃতি অপরাধ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অপরাধ বেড়ে চলার এই অমানবিক অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে তরুণপ্রজন্মকে যান্ত্রিক পৃথিবীর বাইরের দুনিয়াটাতে বিচরণ বাড়াত হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবতা বোধ, বিবেক বোধ জাগ্রত করতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি সরকার, রাষ্ট্র কে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট আন্তরিক হতে হবে।’ * অবক্ষয় রোধ ও সঠিক শিক্ষা ইফরাত আরা নাজনীন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি কথা হয় ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের ইকোনমিকস এ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইফরাত আরা নাজনীনের সঙ্গে। যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় আর সঠিক শিক্ষার অভাবে দিনে দিনে দেশের সার্বিক অবস্থা অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে মনে করছেন তিন। বর্তমানে দেশের যুবসমাজ নিজস্ব ব্যক্তি স্বার্থে, রাজনীতি স্বার্থে, বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তারা এখন দিনদুপুরে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, মারামারি, খুনোখুনি এবং ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে। এসব মানুষ রাজনীতির ছত্রছায়া থেকে এসব অপর্কমের সাহস পাচ্ছে। এসব কর্মকান্ডের কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের দুর্বল আইন ব্যবস্থা। সর্বত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্থিরতা, ভয়ভীতি, শঙ্কা ও অনাস্থা। বৃদ্ধি পাচ্ছে শোষণ, নির্যাতন, অন্যায় ও অরাজকতা। মাথাছাড়া দিয়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস। বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকের ব্যবসা। অশান্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। মানুষ শান্তির অন্বেষায় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। আজ মানুষকে শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কোন সমাজ, কোন সংগঠন, কোন রাষ্ট্র, এমন কি কোন ধর্ম। সর্বত্রই অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। এই থেকে মুক্তি পাওয়া জন্য সঠিক উপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে, আইনে সঠিক ব্যবহার যেন প্রয়োগ করা। সর্বোপরি জনগণের মধ্যে প্রতিবাদমূলক মনমানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। * পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শক্ত করা তাহ্সিনা এনাম তৃষা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাহ্সিনা এনাম তৃষা। পড়ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কি ভাবছেন? প্রশ্নের উত্তরে যেমনটা জানালেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় আসে তা হলো, আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে দেশ অসামান্য সাফল্য অর্জন করলেও আমাদের মূল্যবোধ একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। প্রযুক্তির অবাধ অপব্যবহার এবং বিজাতীয় অপসংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ আজ আমাদের বিবেকহীন প্রাণীতে পরিণত করেছে। এই কোপাকুপির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো। পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা। পড়ালেখার পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে কঠিন শাস্তি দিতে হবে এবং মাদকের সহজলভ্যতা কঠোর হাতে দমন করতে হবে।’ * সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা আবশ্যক জান্নাতুল ফেরদৌস কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস সামাজিক মূল্যবোধের অভাবকে দায়ী করে সেখানে থেকে উত্তরণে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গুরুত্ব দেয়ার কথা মনে করে বলেন, ‘দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু নৈতিকতার উন্নয়ন হচ্ছে না। আমরা সমাজে থেকেও সমাজ নিয়ে ভাবছি না। এখন কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, কারও বিপদে এগিয়ে আসে না। কেউ যেন কারও নয়! সামাজিক মূল্যবোধের অভাবই দেশে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির মূল কারণ। কারও একার পক্ষে রাতারাতি এ সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব না। এর জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সকল অন্যায়, অপরাধের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’ কিন্তু বর্তমান সময়ে সুস্থ সংস্কৃতিকে রক্ষার বা সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য কোন মহল থেকেই তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে খবর নেই। এখন সমাজে আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক অবক্ষয়, কালো টাকা ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে। দেশের তথাকথিত ভাইটাল সমস্যাগুলো নিয়ে নানাজন নানাভাবে কথা বলছেন কিন্তু মারাত্মক সমস্যাদি সমাধানে কেউ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসছেন না। এভাবে চলতে থাকলে সমস্যায় জর্জরিত সমাজটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে একদিন। আর সে কারণেই সমাজের বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে এক্ষুনি। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এমন সব বিপর্যয়, নির্যাতন আর নৃশংসতা তেকে বের হতে গেলে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ একটি পরিশীলিত পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমকে মানবিকতা আর মনুষ্যত্বের কাঠিতে সংশ্লিষ্টদের তৈরি করা ও অত্যন্ত জরুরি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে মানুষভাবার অকৃত্রিম বোধও ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে। পিতা-মাতা-ভাই-বোন নিয়ে সংহত পরিবারটিকে শুদ্ধ আর সুস্থ আহবে এগিয়ে নিতে পারলে সামাজিক ও অভিশাপগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে সময় নেবে না।
×