ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাজ্জাদ কাদির

সাইদা খানম ॥ নারী আলোকচিত্রীর পথিকৃৎ

প্রকাশিত: ১০:১৬, ১২ জুলাই ২০১৯

সাইদা খানম ॥ নারী আলোকচিত্রীর পথিকৃৎ

যে সময়টিতে নারীরা ছিল এক প্রকার অবরোধ বাসিনী বা পুরোপুরি অবরুদ্ধ সেই সময়টিতে সাইদা খানম ক্যামেরা হাতে ফটোগ্রাফির মতো চ্যালেঞ্জিং পেশা গ্রহণ করেছিলেন।এর প্রধান কারণই ছিল তার উদার এবং অসাম্প্রদায়িক পারিবারিক পরিবেশ। অবিভক্ত ভারত, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলেদেশের এই অঞ্চলে তিনি কেবল প্রথমই নন; দীর্ঘদিন ছিলেন একমাত্র নারী ফটোগ্রাফার। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনায়। বাবা প্রয়াত আব্দুস ছবেদ খান ও মা প্রয়াত হাসিনা খাতুন। দুই ভাই-চার বোনের মধ্যে সাইদা খানম সবার ছোট। তাঁর বড় ভাই প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ প্রয়াত আব্দুল আহাদ। বড় বোনের স্বামী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিক প্রয়াত প্রফেসর এ এফ সালাহ্উদ্দিন আহমদ। সাইদা খানম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে প্রথমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এবং পরে ১৯৭২ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে মাস্টার্স পাস করেন। কর্মজীবনের কিছু সময় তিনি ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই তিনি নিতান্ত শখের বসে ফটোগ্রাফি শুরু করেন। প্রথম দিকে এটিকে নেশা হিসেবে নিলেও পরে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর খালা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার সহযোগিতায় আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে আমাদের এই অঞ্চলের নারী জাগরণের প্রথম মুখপত্র ‘বেগম’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। দীর্ঘদিন এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাজ করেছেন চিত্রালী পত্রিকায়। এ ছাড়া তার ছবি ছাপা হয় ‘অবজারভার’, ‘মর্নিং নিউজ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’সহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সাইদা খানম তাঁর কর্মজীবনে দেশে-বিদেশে অসংখ্য বরেণ্য মানুষের ছবি তুলেছেন এবং অনেকের সঙ্গে নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছেন। তালিকাটি মোটামুটি দীর্ঘ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, জাপানের রানী, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান, বিশ্ব শান্তির দূত নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা, প্রথম চাঁদে অবতরণকারী তিন নভোচার যথাক্রমে নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, মহানায়ক উত্তম কুমার, রবীন্দ্রসংঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দোপাধ্যায়। পারিবারিক বন্ধু হিসেবে অস্কারজয়ী উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলেছেন দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত। সত্যজিতের তিনটি ছবিতে আলোকচিত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়; সেই ছবিগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা ছবি নিয়ে কলকাতা এবং ঢাকায় প্রদর্শনী করেছেন। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়কে দীর্ঘ ৩০ বছর দেখার আলোকে ‘আমার চেখে সত্যজিৎ রায়’ শিরোনামে গ্রন্থও রচনা করেছেন। ছবি তুলেছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আবার অতি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনও তাঁর ক্যামেরায় সুনিপুণ মুন্সিয়ানায় ফুটে উঠেছে। ওই সময়ের রক্ষণশীল সমাজে তার এই ছবি তোলার পথটি যে মসৃণ ছিল তা কিন্তু নয়। যে সময়টিতে নারীদের ঘরের বাহিরে দেখাই যেত না সেই সময়ে একা একটি নারী ক্যামেরা হাতে ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন আজকের এই সময়ে এসে ভাবতেও অবাক লাগে। আরও অবাক করার মতো বিষয় যে ওই সময়ে পুরুষ আলোকচিত্রীই ছিলেন নিতান্তই নগণ্য সংখ্যক সেখানে একজন নারী! অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাঁকে।একবার বেগম পত্রিকার কভারে তাঁর তোলা একটি ছবি ছাপা হওয়ার পর এলাকাবাসী তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিল। অবশেষে তাঁর দুলাভাই প্রফেসর এ এফ সালাহ্উদ্দিন আহমদ বুঝিয়ে শুনিয়ে সেইবার এলাকবাসীকে নিবৃত্ত করেছিলেন। এ রকম নানা ঘটনার মুখোমুখি হয়েই তাঁকে হতে হয়েছে অনন্য; অসাধারণ। দৃঢ়চিত্ত এবং একাগ্রতায় তাঁকে আজকের এই জায়গায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বাংলা একাডেমি ও ইউএনবির আজীবন সদস্য। দীর্ঘদিন লেখিকা সংঘের সেক্রেটারি ছিলেন। আলোকচিত্রের পাশাপাশি তাঁর লেখা গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার ও উপন্যাস বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রথম ছোট গল্পের বই ‘ধুলোমুঠি’ প্রকাশিত হয় কয়েক দশক আগে।আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে এবং ‘উপন্যাসত্রয়ী’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। সাইদা খানম তাঁর সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। এ ছাড়া জীবনের বিভিন্ন সময়ে আরো অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। ক্যামেরার এই মহান কারিগর দেশে বিদেশে অসংখ্য আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। আলোকচিত্রী হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন এবং নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অন্য রকম উচ্চতায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সংসার করেননি। তাঁর কর্মকেই তিনি সারা জীবন সংসারের মতো আগলে রেখেছেন। এদেশের ফটোগ্রাফির ইতিহাস রচনা করতে হলে এবং বিশেষ করে নারী আলোকচিত্রীর কথা লিখতে হলে সবার আগে সাইদা খানমের নাম উচ্চারিত হতেই হবে। আজকে তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই অসংখ্য নারী ফটোগ্রাফির মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় এসেছেন। কেউ স্টিল ফটোগ্রাফি নিয়ে আবার কেউ ভিডিও গ্রাফিতেও কাজ করছেন। অনেক নারী এক্ষেত্রে বেশ সুনামও অর্জন করেছেন। এ সবই সম্ভব হয়েছে তাঁর মতো একজন অনুপ্রেরণা সামনে ছিল বলে। একটি অঙ্গনে নারীর অগ্রগতির পেছনে এই মানুষটির অবদান অসামান্য। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তাঁর কর্মের মাঝে এক জ্বল জ্বলে তারকা হয়ে থাকবেন একজন সাইদা খানম। আমরা তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
×