(পূর্ব প্রকাশের পর)
‘উফ্! সেটা কি আর বলার মতো? মন মাতানো গন্ধের নেশায় ভেসে যাচ্ছি বলতে পারো। দারুণের চেয়েও বেশি কিছু। তোমার মনটার মতোন সুন্দর। লাভ য়ু সোনা। এ্যাতো প্রিয় ফুল আমার, একেবারে নাকের ডগায়! আন্বিলিভএব্ল! যেন ওরা নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে আমাদের রিসিভ করছে! বিশ্বাস কর, বুকটা ভরে যাচ্ছে আমার পাগল করা সুবাসে!’
‘তোমার ভালোলাগার জন্যেই তো যত চেষ্টা আমার সোনা। বাসর রাতে তোমারও যেমন, তেমনি আমার কপালেও জোটেনি এমন ফুল। সেই দুঃখটাই এখন একটু পুষিয়ে নেয়া আর কি।...এনিওয়ে, হোটেল বয় রাতের খাবার দিয়ে গেছে। চটপট টেবিলে সেগুলো সাজিয়ে নাও। রাত হয়ে যাচ্ছে। একটু ঘুমোতে হবে। কাল সকালে প্লেন। মনে আছে তো?’
‘মনে আছে। বাট ঘুমোতে হবে ক্যানো? এ রকম কী কথা ছিল?’
‘না ছিল না। সরি, ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম। আমরা বসে বসে গল্প করবো, এই তো?’
‘ঠিক তাই। নো শোয়াশুয়ি, নো ঘুমোঘুমি।’
‘ওকে।’
০৪.
রাত এগারোটার কিছু বেশি। হালকা নীল আলো জ্বলছে। সাথে রজনীগন্ধার গন্ধময় উপস্থিতি। শিরিন একটু আগে শাওয়ারে অনেকটা সময় ভিজে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাথায় সেই দুধ সাদা টাওয়েল জড়ানো। পরনেও সাদা কামিজ, সাদা সালোয়ার। দারুণ এক কম্বিশেন! সুন্দর মুখটার সাথে সারা শরীরে এক অদ্ভুত স্বর্গীয় পবিত্রতা! আমি চোখ সরাতে পারছি না। শিরিন মিষ্টি হেসে বলে,
‘কী দেখছ অমন করে? মাথার টাওয়েলটা?’
‘না সোনা, শুধু টাওয়েল ক্যানো, পুরো তোমাকেই দেখছি। এ্যাতো সুন্দর তুমি!’
‘এ আর নতুন কী? মনে মনে রোজই তো দ্যাখো।’
‘না এভাবে তো কখনো দেখিনি। যেন ভেসে বেড়ানো এক টুকরো সাদা মেঘ। পথ ভুলে এই অভাগার ঘরে ঢুকে পড়েছে। মনে হচ্ছে-সমস্ত পবিত্রতা নিয়ে এইমাত্র স্বর্গ থেকে নেমে এসেছ তুমি। অবাক লাগবে না বল?’
‘না। এ্যাতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। যাক গে শোন, আমি কিন্তু এখন ওইসব ভাত টাত খেতে পারবো না। রুটি পরোটাও না। শুধু এক গ্লাস গরম দুধ চাই। পাওয়া যাবে?’
‘এ আর এমন কী? এক্ষুনি এসে যাবে।’
আমি ভাতই খেয়ে নিলাম। শিরিন দুধটুকু খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে পড়লো। আমিও ওর পাশে বসে পড়লাম। শিরিনের নিয়ে আসা ছোট্ট রেকর্ড প্লেয়ারে নিচু লয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে চলেছে। অনাবিল মুগ্ধতায় ডুবে যেতে থাকি আমরা। ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথাও চলছে। কতক্ষণ এভাবে চলেছে জানি না। রাত বাড়ছে। বাড়ছে নিস্তব্ধতাও সোফার পেছনের দিকে আমার একটা হাত শিরিনের কাঁধ স্পর্শ করেছে। ওর চোখদুটো ক্লান্তিতে বুঁজে আসছে। তবু জোর করে খুলে রাখার চেষ্টা। সামনে ডাবল খাট। ক্রীম কালারের ধবধবে চাদরে পরিপাটি করে রাখা বেডটিতে যাওয়ার নামটি নেই শিরিনের। ওদিকে তাকাচ্ছেও না। কিন্তু অবাধ্য ঘুমের কাছে পরাজিত হতে যাচ্ছে শিরিন। মিষ্টি পারফিউমের শরীরটা আর ধরে রাখতে পারছে না। আমার হাতের ভেতরে চলে এসেছে ওর মাথাটি। টাওয়েলটি আলতো করে ফেলে দিলাম। কথা নেই ওর।
‘এই শিরিন, তুমি কি ঘুমোচ্ছো?’
‘হুঁ...
‘তুমি না বলেছিলে গল্প করে কাটাবে রাতটা? কিন্তু কই?’
‘এখন না হয় থাক্ সোনা। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে..একটু পরে...’। ঘুম জড়ানো কণ্ঠ শিরিনের।
ঘুমের অতল সমুদ্রে তলিয়ে গেল শিরিন। মাথাটা আরো ভালো করে রাখে সে আমার কাঁধে। তাতেও ঠিক সুবিধে হচ্ছিল না ঘুমোতে। তখন কোলের ওপর টেনে নিলাম ওকে। শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়া শিরিনকে দেখছি আমি পলকহীন চোখে। ঘুমন্ত শিরিন আরো যেন অপরূপ হয়ে উঠেছে প্রশান্তির পরম ছোঁয়ায়। কী যে নির্ভার, কী যে বিশ্বাস ওর আমার ওপর...এমন একটি মিষ্টি মেয়েকে কি বিধাতা আমাকে চিরদিনের জন্য দিতে পারতেন না? কেন দিলেন না? এ্যাতো কাছে থেকেও কত যোজন দূরত্বে আমরা...মসৃণ গালে টুক্ করে একটা চুমু দিয়ে ফেললাম। এরপর আরেকটা। খুব রোমাঞ্চিত আবেগে। শিরিন মনে হয় টের পেল। চোখদুটো বন্ধ রেখেই বললো,
‘এইদুষ্টু..কী করছো এসব? বলেছি না..কোন দুষ্টুমি না...’বলতে বলতে উঠতে গিয়ে আর পারে না। আবারো মাথা ঢলে পড়ে কোলে। একটু কাত হয়ে। গালে প্রতিরোধের একটা হাত রাখতে ভোলে না। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম বলতে পারবো না। ঘুমের হাতছানিতে একসময় আমিও ঢলে পড়েছি ওর নরম হাতের ওপর।
০৫.
পরদিন খুব সকালে উঠে পড়ি আমরা। কে কিভাবে শুয়ে বসে রাতটা পার করলাম সেটা নিয়ে কথা বলার সময় ছিল না। এখন আটটা। শিরিন পুরো রাত ঘুমিয়ে একেবারে তরতাজা। চুমু টুমুর ব্যাপার একটা ঘটেছে কিন্তু সেটা সত্যি সত্যি, না স্বপ্নে -ঠাহর করতে পারছিল না। শুধু সপ্রশ্ন দৃষ্টি রাখলো আমার চোখে কয়েকবার। তক্ষুণি একটা দুষ্টুমি চেপে বসে আমার মাথায়। খাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললাম,
‘এ রকম নিরামিষ ভ্রমণ কতক্ষণ চলবে,বল তো? শুকনো চুমু টুমুও কি জুটবে না?’ এবার অন্ধকারে একটা ঢিল ছোঁড়ার সুযোগ নেয় শিরিন।
‘ক্যানো, কাল রাতে আমার ঘুম মুখে চুক্ চুক্ করলো কে?’
‘আরে দূর, ওটা কি চুমু নাকি? ঘুমন্ত শিশুকে দেখতে ভালো লাগছিল, তাই একটু আদর করেছি। এ আর তেমন কী?’
‘তো চুমুটা তাহলে কী রকম,জনাব?’
‘কী রকম? এই যে এ রকম...’
বলেই ওকে কোন সুযোগ না দিয়ে টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। খুব জোর খাটিয়েও নিজেকে আর বের করতে পারলো না।
‘প্লিজ রাকিব, ছেড়ে দাও। এটা তোমাকে মানায় না। ছেড়ে দাও প্লিজ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে তো...’
‘শুধু একটা...তাহলেই ছেড়ে দেব।’
‘ঠিক আছে। ছাড়ো আগে।’
ছেড়ে দিলাম। নিজেকে খানিকটা আলাদা করে আলতো করে আমার মুখটা দুহাতের তালুতে ধরে শিরিন।
‘এই ছেলে, তুমি এ্যাতো দুষ্টু হয়েছ কবে থেকে? এ্যাতো ভালবাসো যাকে, সে তো এমনিতেই আদরে ভরিয়ে দেবে তোমাকে। জোর করতে হবে ক্যানো? আমাকে একটু তৈরি হওয়ার সুযোগ দেবে না? উইদআউট পারমিশনে জড়িয়ে ধরেছ, সো ওইটুকু আনন্দ নিয়েই এখন তোমাকে হ্যাপি থাকতে হবে। এখন আর কিছুই পাবে না।’
‘তাই!’
‘হুঁ, তাই। শিরিনের আদর পেতে হলে একটু অপেক্ষা তো করতেই হবে। বুঝেছেন জনাব?’
আমি মন খারাপ করে তৈরি হতে থাকি। সময় বেশি নেই। সাড়ে সাতটার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে হবে।
প্লেনে পাখির মতো উড়ছি আমরা এখন। আধা ঘণ্টার মধ্যে কক্সবাজারে ল্যান্ড করার কথা। শিরিনের এটাই প্রথম প্লেন জার্নি। দারুণ এনজয় করছে ও।
‘দ্যাখো দ্যাখো, কী দারুণ সব মেঘগুলো! পাখির মতো ডানা মেলে দিয়েছে আকাশ জুড়ে!’
জানালার দিকে তাকিয়ে সাদা মেঘের ভেলা দেখে এমনি করে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে শিরিন, আবার একটু একটু ভয়ও পাচ্ছে। আমার দুই কাঁধ জুড়ে একটা হাত রেখেছে সেই প্রথম থেকেই। প্লেনটা একটু হেলে গেলেই কাঁধ চেপে ধরছে মুঠো হাতে। লালকালো ডোরাকাটা কামিজে দারুণ লাগছে ওকে এই উজ্জ্বল সকালে। একে তো আঁটসাঁট দুটো চেয়ার, তার ওপর শিরিন ভয়ে এমনভাবে আমার ওপর ঠেস দিয়ে বসেছে যে একটু নড়তেও পারছি না। তাতে কি? ওর শরীরের এই রোমাঞ্চকর স্পর্শটা তো না চাইতেই পাওয়া। সেটা হয়তো ও জানেও না। ভাললাগায় ভরিয়ে রেখেছে ওর শরীরের নিজস্ব মিষ্টি গন্ধটাও।
প্লেন থেকে নেমে আমরা সোজা গিয়ে উঠেছি সী বীচের কাছাকাছি হোটেল গাংচিল এ। অনেক দূর থেকেই ভেসে আসছিল সমুদ্রের গর্জন। সেই গর্জনেই আত্মহারা শিরিন। ভেসে আসা উঁচু ঢেউগুলো জানালা দিয়ে চোখে পড়তেই শিরিন আর শিরিন থাকে না। গাংচিল পাখি হয়ে যায় সে নিজেই। এখুনি সে হারিয়ে যেতে চায় সে ওই ঢেউগুলোর সাথে।
‘সমুদ্র এ্যা-তো সুন্দর রাকিব! যা এ্যাতোকাল ছিল শুধু চোখের পাতায়, তা এখন একেবারে ঘরের দুয়ারে! উফ্! আনন্দে বুকটা ভরে যাচ্ছে আমার! কী ভালই না করেছ তুমি আমাকে এখানে এনে!’ বলেই একটা সারপ্রাইজ দিল আমাকে শিরিন। গাল ভরে লম্বা একটা চুমু দিয়ে বললো,
‘এই হলো তোমার পুরস্কার! খুশি?’ আমিও ওকে বুকের মধ্যে আনন্দে টেনে নিয়ে বললাম,
‘সত্যিই তুমি এক আনন্দ পাখি শিরিন। এভাবে সারাজীবন একসাথে থাকতে পারলে আমার আর কিছুই লাগতো না জান্।’ শিরিন আমার মুখটা ধরে বলে,
‘আমারও কি লাগতো সোনা? লাগত না। কখন যাবো আমরা সমুদ্রের কাছটায়?।’
‘এই তো এগারোটার দিকে। তখন জোয়ারের সময়। দারুণ লাগবে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউগুলোর সাথে খেলা করতে। এখন একটু হালকা নাস্তা আর গরম কফি হয়ে যাক, কি বল?’
‘হুঁ, হতে পারে।’
০৬.
সমুদ্রের বালিময় বিশাল সী বীচে দাঁড়িয়ে আমরা। দূর থেকে ভেসে আসা ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে তীরে, ঠিক শিরিনের পায়ের কাছে। কালো ট্রাউজারের ওপর কালো ঢিলেঢালা গেঞ্জি। খোপাটা উঁচু করে বাঁধা। খালি পা। অপরূপ সমুদ্র, না অপরূপা শিরিন? হয়তো দুটোই। কিন্তু দুহাত বুকে রাখা শিরিনের দুচোখে তখনো অপার বিস্ময়!
‘এ্যাতো ভয়ংকর সুন্দর এই সমুদ্র! এ্যাতো সুন্দর!’
‘শুধু কী তাই! এই যে কূলহীন কিনারহীন অপূর্ব বিশালতা, এর কাছে আমরা মানুষেরা কত ছোট, কত তুচ্ছ, তাই না?’
‘হ্যাঁ সোনা। আমি যে চোখ ফেরাতেই পারছি না। এমন সুন্দরকে আরো আগে দেখিনি ক্যানো? কোন্ অন্ধকারে পড়ে ছিলাম আমরা?’
‘কিন্তু ম্যাডাম এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কি চলবে? ঢেউগুলো যে বারবার পা ছুঁয়ে ডেকে যাচ্ছে তোমাকে। নামবে না?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই। চল, দুজনে হাত ধরে নামি। আমার হাত কিন্তু ছাড়বে না।’
‘তা ছাড়বো না। কিন্তু বেশিদূরে যেতেও কিন্তু পারবো না। ডেঞ্জার পয়েন্ট ক্রস করা নিষেধ। কোমড় পর্যন্ত নামা যাবে। আর এখানে তোমার জানা সাঁতার কোন কাজে আসবে না। ঢেউয়ের সাথে যত খুশি খেলতে পারবে। ওকে?’
আমরা নেমে পড়তেই বড় একটা ঢেউ আমাদের মাথার ওপর দিয়ে শাঁ করে চলে গ্যালো। দুজনেই লবণ জলে ভিজে একাকার। সামাল দিতে না পেরে দু’হাতে চেপে ধরে আমাকে শিরিন। ঢেউ এর এমন আচমকা ধাক্কায় একটু ঘাবড়ে গেলেও অভিভূত শিরিন আমাকে শক্ত করে ধরে রাখে। বলে,
‘ইশ্, দুষ্টু ঢেউটা একটু রেডি হতেও দিল না! ঠিক তোমার মতো।’
‘ঢেউগুলো ওইরকমই। রেডি হতে দেয়ার ব্যাপারটা ওরা জানেই না। এজন্যেই তো ও সমুদ্র। ভীষণ বেপরোয়া। ওই যে আসছে আরেকটা...!’
এবার আর ভয় পায় না শিরিন। আমাকে ছেড়ে দিয়ে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে ঢেউয়ের সাথে খেলা করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে দ্রুত। ঢেউটা মাথার উপর দিয়ে চলে গেলে উচ্ছল আনন্দে আবারো জড়িয়ে ধরে আমাকে শিরিন। কখনো গলা পর্যন্ত বসে, কখনো একটু এগিয়ে দুজন দুজনের কোমড় ধরে রেখে ঢেউয়ের দুষ্টুমিগুলো এনজয় করতে থাকি আমরা। ও যে একটা মেয়ে, সেটাও হয়তো ভুলে যায় অপার আনন্দে। জলে ভেজা বুকে চুপসে যাওয়া গেঞ্জি। কতবার যে সেখানে আমার অনিচ্ছুক ছোঁয়া লেগেছে, টের পেলেও গায়ে মাখেনি ও হয়তোবা। পাগলের মতো মেতে ওঠা শিরিনের চোখে সমুদ্র ছাড়া এখন আর কিচ্ছু নেই। ওর না পাওয়ার কত যে কষ্ট, কত যে দীর্ঘশ্বাস, কত যে নীরব কান্না-সব যেন ভেসে যাচ্ছে ওই দুরন্ত ঢেউয়ের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায়... এভাবে দুপুর গড়িয়ে যায়। কত যে ছবি তুলেছে হায়ার করা ফটোগ্রাফার, তার হিসাব নেই। সেসবে খেয়ালও নেই শিরিনের। একবার শিরিন আরেকবার সমুদ্রের দিকে তাকাই আমি। দুটি অপূর্ব সুন্দরের ভেতরে চলতে থাকে আমার নিঃশব্দ অবগাহন...ভুলিয়ে দেয় আমারও অনেক শূন্যতা, বেদন। একসময় শিরিনকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ওর লোনাজলে ভরা চোখে চোখ রেখে বলি,
‘এবার যে ফিরতে হবে সোনা। জোয়ারের সময় শেষ হতে চলেছে। চল যাই হোটেলে। লোনা পানি সরাতে গোসল করতে হবে আবারো। খিদেও পেয়েছে...
‘আরেকটু থাকি না লক্ষ্মী..আরেকটু...’
‘আজ এটুকুই থাক জান্। দু’দুটো ঘণ্টা চলে গেছে এর মধ্যে-টের পেয়েছ? বিকেলে আবারো আসবো দেখতে। তবে নামতে নয়, সানসেট দেখতে। তখন আরো এক ভাললাগা তোমার মন ছুঁয়ে যাবে...’
আর আপত্তি করে না শিরিন। হেটেলে পৌঁছেই বাথরুমে ঢুকে পড়ে ও। তাড়াহুড়ো করে রুম বুকিং নেয়া। ভালো করে দেখতেও পারিনি। এখন পর্যটনের মৌসুম। ভ্রমণপিপাসু মানুষের ভিড়ে ভাল হোটেল পাওয়া প্রায় দুর্লভ ছিল। লোকাল এক বন্ধুর চেষ্টায় সেই সমস্যাটা হয়নি। তিনতলায় বেশ বড়সড় পরিচ্ছন্ন রুমটা। একটি ডাবল খাট, ওয়্যারড্রব, সোফা, টি টেবিল। জানালাটা সমুদ্রের দিকে। খাটের মাথাটা জানালা বরাবর। তার মানে এখানে শুয়ে শুয়েও সমুদ্র দর্শনের সুযোগ রাখা হয়েছে। ছোট্ট ব্যালকনির সামনে বড়সড় একটা পাহাড়ও চোখে পড়ে। সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো পাহাড়টি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রহস্যময় পাহাড়ও অন্যরকম এক আনন্দের, তবে সমুদ্রই টানে বেশি। আমার সাথে শিরিনেরও এখানটায় মিল।
গোসল লাঞ্চ সেরে ঘণ্টা দুয়েকের রেস্ট। রুমটা পছন্দ হয় শিরিনের। খাটে চমৎকার কালারের চাদরটা ভাল করে দেখতে গিয়ে নরম বালিশে মাথাটাও রাখে শিরিন। বেশ ঝরঝরে ফুরফুরে সে এখন। ফুলদানিতে কিছু পাহাড়ি ফুল সাজিয়ে রাখা। উপুড় হয়ে জানালার পর্দাটা একটু সরাতেই সমুদ্র চোখে পড়ে ওর। খুশিতে আবারো উচ্ছল হয়ে ওঠে।
‘এই দেখেছ, এখান থেকেও সেই পাগল করা সমুদ্রটা...’
‘তাই নাকি! দেখি দেখি...’ বলতে বলতে আমিও খাটে উঠে ওর গা ঘেঁষে উপুর হয়ে দেখতে লাগলাম সমুদ্রটাকে।
শিরিন এ্যাতোক্ষণে টের পায় আমি খাটে, ওর পাশেই। একবার আড় চোখে আমাকে দেখেই সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকে। যেন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব করে ঝিম মেরে শুয়ে থেকে একবার ওর মুখ, একবার সমুদ্রকে দেখি। শিরিন সামনের দিকে চোখ রেখে বলে,
‘ভালোবাসাটা সমুদ্রের ওই ঢেউগুলোর মতোই, তাই না রাকিব? যেমন অবাধ্য, তেমনি দুরন্ত।’
‘হুঁ, আমারও তো সে রকমই মনে হচ্ছে।’
‘সে রকমই মনে হচ্ছে, না? এই দুষ্টু, পাশে শুয়ে পড়েছ বলে খুব সায় দেয়া হচ্ছে? একেবারে গা ঘেঁষে থাকা? এটা কী? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।’ এই বলে বালিশটা দিয়ে কিছুক্ষণ পিটিয়ে হাঁফাতে থাকে শিরিন। আমি তবু উপুড় হয়েই থাকি। একটু থেমে বলে ও, ‘আচ্ছা, তুমি এ রকম ক্যানো বল তো? এমন গায়ে পড়া হ্যাংলা স্বভাব তো তোমার ছিল না!’
‘কী করব, বল? এমন একলা করে তোমাকে কখনো পাইনি তো। সেজন্যে...আর এমন এক সাবান মেখেছ গায়ে যে গন্ধটা চুম্বকের মতো টানছে তোমার দিকে। আমার কী দোষ? প্লিজ শিরিন বকো না। আরেকটু শুয়ে থাকি, প্লিজ...’
‘ঠিক আছে বকবো না বাট মাঝখানে হাতখানেক গ্যাপ রাখতে হবে, ওকে?’
‘ওকে, ম্যাডাম। থ্যাঙ্ক য়ু ম্যাডাম। তুমি সত্যিই খুব ভাল মেয়ে।’
‘থাক। ওসব পাম্পট্টিতে আমি ফুলি না। তোমার সেই ‘সানসেট’ দেখাটা কখন, সেটা বল।’
‘এই তো আর ঘণ্টাখানেক পরেই।’
০৭.
বিকেলে আবারো সমুদ্রের বীচে আমরা। হালকা আকাশি রঙের শাড়ি পরেছে শিরিন। সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ। এই প্রথম ওকে এমন করে শাড়ি পরতে দেখলাম। চমৎকার! সমুদ্রের গাঢ় নীলের সাথে একাকার হয়ে যাওয়া অন্য এক শিরিন। শ্যাম্পু করা খোলাচুলের সাথে খেলায় মেতেছে ঝিরিঝিরি বাসন্তী বাতাস। ওদিকে কুসুম লাল সূর্যের আসন্ন বিদায়ের আয়োজনে পশ্চিমের দিগন্ত জুড়ে লালচে আবির। এমন মন ছোঁয়া পরিবেশে একাত্ম হয়ে শিরিনও পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বিদায়ী সূর্যের দিকে। মানুষের ভিড় এড়িয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ক্রমশ নিচে নামতে থাকা হলদে সূর্যটার ছবি নিতে থাকে একের পর এক। সাগর পাড়ে এই প্রথম এমন মোহনীয় সূর্যাস্ত দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে শিরিন। স্বগোক্তিতে বলতে থাকে-
‘বিশাল প্রকৃতি কি সুন্দরভাবেই না সাজানো, তাই না! সকালের অস্থির সমুদ্র এখন কতই না শান্ত...। সারাদিন আলো দেয়া সূর্যটার বিদায়ে সমুদ্র, আকাশ, বাতাস সবকিছুই যেন বিষণ্ণতায় ভরে উঠেছে। নীরবে সবাই যেন বলে যাচ্ছে- ‘যেতে নাহি দেব, যেতে নাহি দেব..’
‘তবু যেতে দিতে হয়, হায়, তবু চলে যায়...’ যোগ করি আমিও শিরিনের বেদনার্ত কণ্ঠের সাথে। ফিরে তাকায় সে আমার দিকে গভীর আবেগে। কাঁধটা দুহাতে ধরে আলতো করে মাথা রেখে সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে,
‘একটু আগে দেখা টকটকে লাল সূর্যটা কি দারুণভাবেই না ডুবে গ্যালো..। যেতে চায় নি। মন খারাপ করে সবাইকে দেখতে দেখতে চলে গ্যালো...একদিন আমরাও ওভাবে হারিয়ে যাবো, তাই না রাকিব?’
আমি কিছু বলি না। চেয়ে থাকি ওর বিষণ্ণ মুখটার দিকে।...
সন্ধ্যের পরে বেলাভূমিতে হাতে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি, আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে কথা বলা চলে কিছুক্ষণ। অপূর্ব এক রোমান্টিকতায় বিভোর আমরা তখন। ফাঁকে ফাঁকে পছন্দের কিছু ঝিনুকও কুড়িয়ে নেয় শিরিন। ঝিনুকের তৈরি মালা, কানের দুলসহ নানান ধরনের শো পিসের পসরা সাজানো দোকান থেকে কিছু পছন্দের জিনিসও কেনে শিরিন। এরপর রিকশায় কিছুটা সময় শহর ঘুরে দেখা। ভাল একটা রেস্টুরেন্টে বসে হালকা খাবারও খেয়ে নিই আমরা। রাত ঘন হয়ে আসে। অচেনা শহরে আর দেরি নয়। ফিরে আসি আমরা সেই সুন্দর রুমে, কিছু সময়ের জন্যে কিনে নেয়া দারুণ সেই পৃথিবীতে।
রুমে আবারো সেই রজনীগন্ধার বিস্ময়। বুক ভরে শ্বাস নেয় শিরিন। আমার দিকে বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তুমি এ্যাতো ভালো কেন রাকিব? আমার ঘুমিয়ে থাকা মনটাকে বারবার এভাবে জাগিয়ে দাও ক্যানো, বলতো?’
‘তুমিও যে সুগন্ধি রজনীগন্ধাই, সেটা মনে করিয়ে দিতে। কিন্তু একটা কথা। আজ কিন্তু আমি সোফায় বসে থাকতে পারবো না। খাটে ঘুমোবো।’
‘ঘুমোবে, না দুষ্টুমি করবে?’
‘ক্যানো, দুষ্টুমি করা কি বারণ? বারণ যেটা, সেটা তো মেনেই নিয়েছি। মানি নি বল?’
শিরিন সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলে,
‘কাল আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘হ্যাঁ, কাল তো আমাদের শেষদিন। তবে দুপুর পর্যন্ত আবারো সাগর সৈকতে।’
‘তাই! কী দারুণ...তবে কাল আমি সমুদ্রে নামবো না। লম্বা চেয়ারে বসে থেকে সমুদ্রকে প্রাণ ভরে দেখবো আর দেখবো। হয়তো এ জীবনে এভাবে আর দেখা হবে না...’বলতে বলতে উদাস চোখে জানালার পর্দাটা সরায় শিরিন। সমুদ্রকে দেখার চেষ্টা। ওপারে ঘন অন্ধকার। দৃষ্টির আড়ালে তখন সমুদ্র। কিন্তু ঢেউ এর মৃদু গর্জন ভেসে আসতে তো বাধা নেই। আসছে সে বাতাসে ভর করে। কান পেতে শুনতে থাকে শিরিন সেই সম্মোহনী ডাক...’। অনেকটা সময় ধরে।
০৮.
রাতের খাবার খাওয়ার পর বেড এ যাওয়ার পালা। শিরিনই আগেভাগে বেড এর এক পাশে শুয়ে পড়ে। হয়তোবা সারাদিনের ক্লান্তিতে। মনটা একটু ভার ভার মনে হলো।
‘মনটা কি খারাপ সোনা? আমি কি সোফায় বসে থাকব?’
মাথাটা একটু আমার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
‘না রাকিব। ভাবছি-ভালোবাসার শক্তিটা কত বড়, কত অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। তারপরেও এ দেশে আমরা কতটা অসহায়। সমাজ বল, সংসার বল-কাউকেই অতিক্রম করতে পারি না আমরা। অসম্মানের ভয়ে। কিছুটা মায়ায় পড়ে। তাই না?’
‘হ্যাঁ। সেজন্যেই তো এভাবে হাওয়ায় ভেসে আসা। নাহলে তো সত্যি সত্যিই চলে আসতাম। মন খারাপ করে আর কী করবে বল?’
‘হ্যাঁ সেটাই।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শিরিন। একটু পরে আমার কথাটার জবাবে বলে,
‘আজ আর কষ্ট দেব না তোমাকে, রাকিব। তোমার জন্য জায়গা রেখেছি। চুপটি করে লক্ষ্মী ছেলের মতো পাশে এসে শোবে। মাঝখানে কিন্তু এক হাতের গ্যাপ.ওকে?’ বলেই মিষ্টি করে একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় শিরিন।
হালকা মেরুন কালারের শালোয়ার কামিজ পরেছে শিরিন। আমার ভাললাগা প্রিয় রঙ। ডিম লাইটের হালকা আলোয় চুপচাপ শুয়ে পড়ি ওর পাশে। দুজনই চুপচাপ। শিরিন কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নিঃশ্বাসের শব্দটা শুনতে পাচ্ছি তবে সেটা ঘুমের নয়। রাত বাড়তে থাকে। ক্লান্তিতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে আমার।
‘শিরিন’
‘উঁ..’
‘ঘুমিয়ে পড়েছ সোনা?’
‘না। কান্না শুনছি।’ আমার দিকে মুখ ফেরায় শিরিন।
‘কার কান্না?’
‘ওই যে..সমুদ্রের। বুক ভাঙা কান্না। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। শুনতে পাচ্ছো না?..’
‘কান্না কেন হবে? ঢেউ এরই গুড় গুড় শব্দ ওটা...’
‘কান পেতে শোন না তো, তাই বোঝ না। ওটা কান্নাই। যে যত গভীর, তার ততটাই কান্না।’
‘ওকে। কান্না। আমার মনে হয় কান্নাটা তোমার বুকেও এসে লাগছে। একটু হাত রেখে দেখি?’
‘না, দেখার কী আছে? মাথার মধ্যে খালি দুষ্টুমি বুদ্ধি ঘুরঘুর করে, না?’ মুখটা আবারো আমার দিকে।
‘ঠিক আছে। থাক। তুমি শুয়ে শুয়ে কান্না শোন। আমি ঘুমাই।’ মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম আমি। শিরিন জোর করে মুখটা ওর দিকে টেনে নিয়ে বলে,
‘এই ছেলে, অমনি রাগ হয়ে গ্যালো?’
‘না রাগ হবে ক্যানো? আমি তো রক্ত মাংসের মানুষ না। রোবট। আমার কাজ শুধু ভালবাসা আর সুন্দরী সঙ্গিনীকে চেয়ে চেয়ে দেখা। এছাড়া আর কী? স্পর্শ যে ভালবাসারই একটা পার্ট, সেটা বুঝবে কে? ওটাকে তো মনেও আনা যাবে না।’
‘এই দুষ্টু, আমি কি তাই বলেছি? মনে আনা যাবে না ক্যানো? যাবে। হাতেও আনা যাবে। শুধু লিমিট ক্রস করা যাবে না।’
‘ক্রস করতে দিয়েছ কখনো? বারোটা বছর ধরে তো সুবোধ বালকটিই বানিয়ে রেখেছ আমাকে। ওটা আর শিখলাম কোথায়?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে সোনা। আর রাগ নয়। রাখো হাত। তবে ঠিক মাঝখানে। নো লেফট, নো রাইট। ওকে?’
আলতো করে হাতটা রাখলাম ওর বুকে। হৃৎপিন্ডের দ্রুত স্পন্দন চলছে সেখানে। মনে হচ্ছিল-দূর থেকে ভেসে আসা জলঢেউয়েরই কলধ্বনি। সেটিই হয়তো বা কান্না। চোখের দিকে তাকালাম ওর। ছলছল চোখ।’
‘কাঁদছো সোনা?’
‘হ্যাঁ। এমন পাগল করা আনন্দে কান্না না এসে পারে বল? ঢেউয়ের মতোন আছড়ে পড়ছে বুকে। তার ঝাপটা এসে লাগছে চোখেও। অস্থির করে দিচ্ছে আমাকে। ঘুমোতেও দিচ্ছে না দুষ্টু ঢেউগুলো।’ গলাটা কান্নায় ভিজে যায় শিরিনের।
‘সমুদ্রের স্বভাবই যে ও রকম। বাঁধনহারা। কিন্তু আমার বুকটাও যে একটা সমুদ্র, সেখানেও যে ভালোবাসার জল তরঙ্গ, সেই কতকাল ধরে বেজে চলেছে, তাকিয়ে দেখেছ কখনো? এখানেও যে উথাল পাথাল ঢেউ, বাঁধন ভাঙার দুরন্তপনা, আছে চাপা কান্না- বোঝ সেটা?’
‘ক্যানো বুঝবো না? বুঝি সোনা। খুব বুঝি। কিন্তু সমুদ্র বলেই তো ভয়। কত যে ইচ্ছে করে ওই বুকে যদি একটু ঘুমোতে পারতাম, সারা জনমের একটি মাত্র ঘুম...কিন্তু ভয় করে যে খুব...খুব ভয়...যদি তলিয়ে যাই, ভেসে যাই, একেবারে ধরা ছোঁয়ার বাইরে অতলে কোথাও...চাইলেও যদি আর কখনো ফিরতে না পারি..’
‘না সোনা, এ সমুদ্রটি যে শুধু তোমারই, তোমার নিভৃত আশ্রয়। তলিয়ে যাবে ক্যানো? আর তলিয়ে গেলেই বা কী? ঢেউ এর মতো করে ঠিক তীরে এনে ফিরিয়ে দেবে সে তোমাকে। বিশ্বাস হয় না?’
‘হুঁ হয়, খুব হয়। আমি তো সমুদ্রেই বিশ্বাসটা রেখেছি এতকাল ধরে। অন্ধের মতো। নিশ্চয়ই ভুল করিনি, বল।’
‘না। কোন ভুল নেই। ভয় নেই। এস। এই যে খুলে দিলাম বুকের সবকটি অভয় দুয়ার।’
প্রথমে বিমুগ্ধ বিস্ময়! কিছুটা ভয়, কিছুটা দ্বিধা। হয়তোবা নিজের সাথে কিছুটা বোঝাপড়া। কিছুক্ষণ খোলা বুকের দিকে তাকিয়ে থাকা। তারপর দ্বিধাহীন বিহ্বলতায় হামাগুড়ি দেয়া ছোট্ট শিশুর মতো গুটিসুটি মেরে বুকে এসে মুখ রাখে শিরিন। কিছুক্ষণ ঘন ঘন নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ছড়ানো। বুকের পশমে আলতো করে বিলি কাটা।... সময় বয়ে চলে..। এক সময় নিশ্চিন্তে, পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে পড়ে খেলতে থাকা অবোধ শিশুটি। পিঠে হাত রেখে চেপে ধরে রাখি ওকে। এ যেন এক পবিত্র বিশ্বাসকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখা। আমার সমুদ্র শরীরে তখন অবাধ্য জোয়ারের উথাল পাতাল। ওকে তলিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপ্রতিরোধ্য লড়াই সেখানে। কিন্তু সে লড়াই এ হেরে যাবার উপায় নেই। কক্খনো না।...
০৯.
শেষ রাতের দিকে আমিও আর না ঘুমিয়ে পারিনি। পরম প্রশান্তির ঘুম। ভোরে উঠে ড্রেস চেঞ্জ করে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে ডাকে শিরিন,
‘এই যে দুষ্টু ছেলে, আর কত ঘুমোবে? ওঠো ওঠো। চল ব্যালকনিতে বসে কফি খেতে খেতে গল্প করি...’।
আমি চোখ না খুলেই বলি,
‘আরেকটু ঘুমাইনা লক্ষ্মীটি। আরেকটু...’
‘না, আর ঘুম না। আমি একা একা বসে থাকতে পারব না। ওঠো প্লিজ।’
আমি তবু চোখ খুলি না। কথাও বলি না। কোন কিছুর অপেক্ষায় তখন কি আমি? কিসের? হঠাৎ একটা রাক্ষুসী চুমু এসে পড়ে গালে। হালকা কামড়ও সাথে। সাথে খিলখিল হাসিও। লাফিয়ে উঠে বলি,
‘ইশ্, এভাবে কেউ চুমু দেয়?’
‘না দিলে কি উঠতে? আদরের জন্যেই তো চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলে। বুঝিনি ভেবেছ? তাই দিলামও সেই রকম একটা। যাতে মনে থাকে শিরিনটা কেমন রাক্ষুসী...’
‘ওকে। ব্যাপারটা তাহলে ওয়ানসাইডেড হবে ক্যানো? আমার দিক থেকেও হয়ে যাক একটা...’
‘নো স্যার। রাতে আমার ঘুম মুখে ওই কাজটা আপনি অনেকবার করেছেন। টের পাইনি ভেবেছেন? পেয়েছি। সো নো মোর টু ডে।’
সকাল এগারোটার দিকে আবারো সেই সমুদ্রে আমরা। মানুষের কোলাহল থেকে একটু দূরে। কিছুটা নির্জনতায়। মসৃণ বালুতীরে দূর থেকে ভেসে আসা ঢেউগুলো ফোঁস ফোঁস শব্দ করে একের পর এক আছড়ে পড়ছে। জোয়ারের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে বীচের শুকনো মসৃণতা একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে। সমুদ্রের নীলের সাথে ম্যাচ করা কামিজ, সালোয়ার ওড়নায় ঢাকা শিরিন ভীষণ চুপচাপ এখন। চোখদুটো সামনের অশান্ত জলের দিকে, স্থির, নির্বিকার। বীচে পেতে রাখা লম্বা দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসেছি আমরা। শিরিন খালি পা দুটো মেলে দিয়েছে ভিজে বালির উপর। সমুদ্রের স্পর্শ নেয়া সেখানেও। খোলাচুলের সাথে খেলায় মেতেছে সাগরের মৃদু হাওয়া। মাঝেমধ্যে হাতদিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে মুখে এসে পড়া এলোমেলো চুলগুলো। অনেকক্ষণ কথা নেই। অথচ এই নীরবতাও যেন শব্দময়। অন্যরকম এক ভাললাগা। নিঃশব্দে একটা হাত রাখি শিরিনের হাতে। নীরব প্রশ্রয়ে একটুখানি কেঁপে ওঠে সে। কিন্তু মুখটা থাকে সাগরের দিকেই। যেন একটি মুহূর্তও চোখ সরানোর নয় সমুদ্র থেকে। এমনি এক মুগ্ধতায় ডুবে থাকা অনেকটা সময়। কথা হতে থাকে হাতে হাতে। সে কথাগুলো হাতের ভেতর দিয়ে বয়ে চলে যায় বুকের গভীরে। গভীর থেকে একেবারে অতলে...। হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে একটু হেঁটে যায় শিরিন শুকনো বালির দিকে। সেখানে বসে লিখতে থাকে-‘আই লাভ য়ু সুইট সী, লাভ য়ু ডিয়ার রাকিব’। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াই। ধীরে ধীরে বলি,
‘কিন্তু এই লেখাটি যে এভাবে থাকবে না সোনা, মুছে দেবে ধেয়ে আসা ওই দুরন্ত ঢেউগুলোই...’
‘দিক। আমার মন থেকে তো মুছতে পারবে না তোমাকে, সমুদ্রকে। পারবে, বল?’ আমি কোন উত্তর না দিয়ে ফোনের রেকর্ড প্লেয়ারে হেমন্তের সেই গানটি ছেড়ে দিই...
‘এই বালুকাবেলায় আমি এসেছিনু, একটি সে নাম আমি লিখেছিনু, আজ সাগরের ঢেউ এসে... সবই যেন মুছিয়া দিলাম...’
পরম আবেগে ভেসে যাচ্ছিল শিরিন সেই সুরে। জল এসে যায় ওর চোখে। আমাকে চেপে ধরে অস্ফুট স্বরে শুধু বলে,
‘না কিছুই মুছে যাবে না। কিছুই মুছে দিতে দেব না আমি...’
এরপর যথারীতি হোটেলে ফেরা। লাঞ্চ। রেস্ট। বিকেল চারটের বাস এ চট্টগ্রাম। সেখান থেকে রাতের ট্রেনে ঢাকায় ফেরা। শেষ হয়ে যাবে বাহাত্তরটি ঘণ্টা। তবে তার আগে জানালায় অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো সমুদ্রকে দেখে নেয় শিরিন। সমুদ্রের সবটুকু লোনা জল যেন ওর দুটি চোখে এসে জমেছে এখন। সেই ভেজা চোখেই আমাকে জড়িয়ে ধরে সমস্ত উত্তাপ, সমস্ত কষ্টজল ঢেলে দেয় সে আমার কাঁধে। কাঁধ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে তা নেমে যায় কোন্ যে গহীন আঁধারে... কে জানে...