প্রিয় রোকোনালী
মাকিদ হায়দার
কোনদিন ভাবি নাই মাতুলের সাথে ঝিকরগাছায় দেখা হবে।
যশোর থেকে আমি আর কবি ফরিদ দুলাল যখন হেঁটে হেঁটে
ঝিকরগাছায় দিয়েছি পা, তখন দুপুর।
দেখি, কেশবপুর সাগরদাঁড়ি থেকে আসছেন আধা চেনাজানা কবি খসরু পারভেজ, অদূরে ঝিনাইদহের সুমন শিকদার
গাজী আজিজ সাতক্ষীরার।
সকলেই এসে দাঁড়ালেন
গল্পকার হোসেন উদ্দিন হোসেনের আম্র কাননের নিচে সকলেই বসলেন
আমরা শুনেছি, আপনার প্রিয় মাতুল রোকোনালী, আসছে ঝিকরগাছায়
আমাদের সাধ আহলাদ দীর্ঘদিনের, আমরা উনাকে দেখেই ফিরে যাবো
আমাদের নিজ গৃহে।
আমি তখুনই ভাবলেম, এখনো লোকজন আমার মাতুলকে মনেপ্রাণে
এতো ভালোবাসে- ভাবতেই চোখ দুটি ভিজে এলো অঝোর ধারায়। চেনা, নাকি আধা চেনা মুখদের বললাম, আমার মাতুলকে দেখলেই দিতে হবে প্রথমে সালাম, পরে দুই পায়ে কদমবুচি, প্রয়োজনে চুমু।
আমাকে নামিয়ে দিয়ে দুইজন বললেন
আমরা দুজন এসেছি, তোমার মাতুলের
চোখে মুখে থুথু দিতে, যশোর খুলনা থেকে।
বাকি দুইজন দেখালেন ছেঁড়া জুতো
তখন আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম, দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় রোকোনালী
স্বপ্ন নাকি সত্য- কিছু একটি বুঝে ওঠার আগেই তিনি বললেন, এখুনি
নিয়ে চল ঢাকা- ওই চার মুক্তিযোদ্ধাদের বস্তাবন্দি করে, .....
পাঠিয়ে দেবো আজিমপুরে।
আধা চেনা, চারজন আমাকে ধরার আগেই পালিয়ে এলাম যশোর শহরের
বারান্দীপাড়ায় ইদ্রিস আলীর গৃহে। আলী মাতুলের ছোট ভাই। তিনি জানালেন তোমার মাতুল যান নাই ঝিকরগাছায়। ঘুমিয়ে আছেন। তিনি জাগলেই জানিয়ে দিও মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর।
মাতুলের ঘুম কবে কখন ভাঙবে- আমি সেই আশায়
বিগত একুশ, বাইশ দিন, তেইশ রজনী- তার মাথার শিয়রে
বসে শুধু দুষ্ট ভাবনা আমার চারপাশে, সকাল, বিকাল।
প্রিয় মাতুল বাঁচবে কিনা, দিনরাত আমার চিন্তা চেতনায়
বাড়িঘর বানিয়ে বসে থাকে আমারই চেয়ারে।
যখন মাতুলের অতীত বিষয়-আশয় নিয়ে ভাবে
তখনই দেখি মাতুলের হাতে,
হিন্দু, মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত।
গত মধ্যরাতে মাতুলের নিদ্রা ভঙ্গ হবার সঙ্গে সঙ্গে জানালেন
আমার একান্ত ইচ্ছা- আজ রাতেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনতে হবে
জনা দুয়েক চিকিৎসক, এলো তারা পরেরদিন দুপুরে-
দুইজন আমার দুই কানে বললেন ফেরার আশা নাই,
তখনি লক্ষ্য করলাম, এক শল্য চিকিৎসক-
শয্যাশায়ী মাতুলের কানে শত ব্যস্ত হয়ে বললেন;
বার দুই যদি
পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলাতে পারেন-
অচিরেই আসবেন ফিরে।
শল্যের বাক্য শেষ হতে না হতেই মাতুল আমার বিছানা ছেড়ে
উঠে, গাইলেন তাঁর প্রিয় গান, “পাকসার এ জমিন সাদবাদ”
আর একজন চিকিৎসক যিনি যাবার আগে বললেন,
বেইমান লোকটির মৃত্যু আসন্ন, পিজি হাসপাতালে
তখনি আমার মনে হলো-
লোকটির মুখের উপর থুথু ছুড়ে মারি- যেমন যশোর
খুলনা থেকে এসেছিল হারামীরা আমার মাতুলের
চোখেমুখে থুথু দিতে।
মুক্তিযোদ্ধা কুকুরেরা।
*
নির্দয় ছুরিকে ভালোবেসেছি
সমর চক্রবর্তী
আমি এক নির্দয় ছুরিকে ভালোবেসেছি। খুন হবো জেনেও
সহাস্যে চুম্বন করেছি আগুনের মরুভূমি। সব কিছু মেনেও
আমি কেবল তার টেবিলের আপেল হয়ে পড়ে থাকি !
প্রতিদিন নৈশভোজে নির্দয় ছুরি, শত খন্ড করে আমাকে!
একটু একটু করে দাঁতের সাহায্যে ঠোঁট থেকে
তুলে নেয় মুখে, আমি সবিস্ময়ে দেখি, অবয়বহীন
একটি আকাশ অসংখ্য তারার শরীর নিয়ে জ্বলছে
অন্ধকারের উজ্জ্বল হৃদয়ে; ছুরিটি আমি গোপনে বুকে গেঁথে রাখি!
*
হালখাতা
আদিত্য নজরুল
চলো পুনরায় শুরু করি এ জীবন।
পূর্বের প্রস্তুতি পর্বে
কিছুটা ভুল ছিলো, গোলমেলে হয়েছে কিছুটা
চলো ভাঁজে ভাঁজে
শস্য ও প্রেমের আবাদ করে
অভিমান ভেঙে, পুনরায়
শরীরের বাঁকে তুলি ঢেউয়ের তুমুল কম্পন।
পালতোলা নাওয়ের মতো
পরস্পরে বুকেতে জড়িয়ে দুলে উঠি এসো
চলো এবার পথে না নেমে
গন্তব্যের মানচিত্র আঁকি পায়ের তলায়।
আমাদের কিছু ভুল
গোলাপ ও বকুল ঝরার মতো ঝরে গেছে।
মনে করো ভুলগুলো
পোস্টম্যানের পৌঁছে দেওয়া চিঠি
এ চিঠি পড়ে চলো পুনরায় শুরু করি নতুন জীবন।
*
মিষ্টি বালিকা
চঞ্চল শাহরিয়ার
আমি ডুবে মরি। কোন অসুবিধে নেই।
তুমি ভালো থাকো। থাকো ভরা বর্ষার নদীর
মতো টলমল। সারাক্ষণ হাসিখুশি।
সারাক্ষণ নূপুরের সুরে ভরা থাক তোমার দুপুর।
আমি রাত জেগে ক্লান্ত হই। অসুবিধে নেই।
তুমি থাকো কোলাহলময়। কোল্ড ড্রিংক্স
খেতে খেতে গল্প করো। ফেসবুক দেখো।
বৃষ্টিতে দারুণ ভিজে হও খুব মায়াময়।
তুমি ভালো থাকলেই আমার আনন্দ
অহর্নিশি খুঁজে পাই আমি ঝলমলে
জোছনা রাতের পদাবলী।
*
আর মিথ্যা বলতে পারবো না
মুহমুদুজ্জামান জামী
আমি আর মিথ্যা বলতে পারবো না।
মিথ্যা বলতে বলতে
মুখে কালো দাগ পড়ে যাচ্ছে,
এমনকি অভ্যন্তরীণ অবস্থা
অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে।
মিথ্যা বলতে ভালো লাগে;
তার মোহন কারিশমায়
কত কাজ উদ্ধার হয়ে যায়!
চারদিকে মিথ্যা-ই নায়ক যেন,
সত্য বড় অসহায় আজ!
অথচ দেখ, মিথ্যা নায়ক হলে কী হবে
তার দৌরাত্ম্যে চারপাশের মানুষ খুব
অসহায় হয়ে পড়েছে!
আর মিথ্যা বলতে চাই না,
মিথ্যার কালো হাত ভেঙে দিতে চাই, ভেঙে দিতে চায়!
*
জলের নৈবেদ্য
আবেদীন জনী
হে বৃষ্টি, তোমার পতন স্পন্দনে মুখরিত হয় পিপাসিত মাটির শরীর
ফিরে পায় সজীব শ্বাস-প্রশ্বাস, পাললিক জীবনের স্বাদ
জলের অক্ষরে লিখে যাচ্ছ তুমি সবুজ শস্যের গান
নিজেকে মাটির কাছে স্বেচ্ছা সমর্পণে তুমিও কি অনুভব করো গূঢ় প্রশান্তি অপার?
তুমিও কি প্রেম বোঝো? পতনের শব্দে ছন্দে খোঁজো প্রেমের পূর্ণতা, জীবনের অর্থ?
অতসব জানা নেই। তবে এই সফেদ সত্য জানি-
মাটি আর মানুষকে দিয়ে যাচ্ছ চিরকাল জলের নৈবেদ্য।
শীর্ষ সংবাদ: