ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রহস্যের মোড়কে নান্দনিকতা

প্রকাশিত: ১০:০২, ১২ জুলাই ২০১৯

রহস্যের মোড়কে নান্দনিকতা

শিল্পকর্ম মানেই রহস্যের মোড়কে নান্দনিকতার ঝলকানি। একটি শিল্পকর্মকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন কোথাও যেন একটা খামতি থেকেই যায়। ফলে শিল্পের প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা আদৌ সম্ভব হয় না। শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে তা পর্যবেক্ষণ করলে মানুষের হৃদয়ে যে চেতনা ও সৌন্দর্যের উন্মেষ ঘটে কিংবা ভাবের তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তা হৃদয়ঙ্গম তথা উপলব্ধির বিষয়, অনুবাদযোগ্য হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কারণেই বলেছিলেন, ভাবের অনুবাদ অবান্তর। শিল্পের সমকালীনতা, ঐতিহাসিক কিংবা ঐতিহ্যিক গুরুত্ব হয়ত অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু একেকটি শিল্পকর্ম শেষ পর্যন্ত দর্শকের কাছে ‘নন্দনের অনুভব’ রূপেই প্রতিষ্ঠা পায়। প্রতিনিয়ত বিশ্বায়নের কঠিন প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষকবলিত বর্তমান, প্রবল অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, একাকিত্ব এবং নানা অস্বস্তিতে ভোগা কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে হৃদয়ানুভূতির সাক্ষাত আদৌ মেলে কিনা জানি না, তবে এটা তো সত্যি যে, শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যে কোন সুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে বড় ইচ্ছে জাগে, বাহ্্ কী দারুণ! চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে মূর্ত ও বিমূর্ত রীতি নিয়ে একটি বিতর্ক দীর্ঘদিন থেকেই চলমান। অহেতুক এসব বিতর্কে অনুপ্রবেশ না করেও বলা যায়, বিশ্বব্যাপী জ্ঞানভিত্তিক ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে শিল্প-সংস্কৃতি-চিত্রকলা-চারুকলা ইত্যাদিকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। দেশে-দেশে, মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি ও মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলাসহ পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নেও শিল্পকলার ব্যাপক অবদান রয়েছে। পাশাপাশি শিল্পকলা একটি দেশ ও জাতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৌরব ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি নন্দনতাত্ত্বিক চেতনার উন্মেষ ও সুকুমারবৃত্তি গড়ে তোলায় প্রভূত সহায়ক এই শিল্পকলা। ২৩তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া শিল্পকর্মগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থা এবং সমকালীন নানা চেতনা ঘিরে প্রবহমান; যা বাঙালীর বৃহত্তর চেতনারই অংশ বলে মনে করা যেতে পারে। আবার এটাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, চারু ও শিল্পকলা দেশ-কাল-সময় ও সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে এর নান্দনিক সৌন্দর্য ও আবেদন চিরন্তন, সীমাহীন, সর্বোপরি সর্বজনীন। বাংলাদেশের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য সুপ্রাচীন এবং গৌরবোজ্জ্বল। বাংলাদেশের পাহাড়পুর, ময়নামতি, মহাস্থানগড়ের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন কিংবা বরেন্দ্র মিউজিয়ামসহ ঢাকা মিউজিয়াম প্রত্যক্ষ করলেই সহজে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব যে, কী অসাধারণ ও গৌরবজনক আমাদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের ইতিহাস। বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্কর আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক সুখ্যাতি পেয়েছেন। পাশাপাশি ভূষিত হয়েছেন নানাবিধ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননায়। সত্য বলতে কি, এরই পরম্পরা রক্ষা করে এগিয়ে চলেছে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত দেশের চারু শিল্পের বৃহত্তম উৎসব এই ‘জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী’; এশিয়া অঞ্চলের মধ্যেও এ উৎসব দ্বিতীয় বৃহত্তম। শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই চর্চা বা অনুশীলন প্রয়োজন। আর এই অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শিল্পীরা কতটুকু এগিয়ে আছেন, তা চলমান প্রদর্শনীর ছবিগুলো পর্যালোচনা করলে বোধগম্য হতে পারে। আমাদের দেশের নবীন ও প্রবীণ শিল্পীরা বাঙালীর নৃ-ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবং তাদের সৃজন ক্ষমতা প্রয়োগ করে শিল্পকে কত বিচিত্রমুখী করে তুলেছেন তারই একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হতে পারে শিল্পী কামরুজ্জামানের ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং-১’ ও ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং-২’ শিরোনামের শিল্পকর্ম। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে গোটা বিশ্ব কীভাবে বিপর্যস্তু হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো কীভাবে মরুকরণেই দিকে এগিয়ে চলেছে তারই উৎকৃষ্ট অবয়ব দেয়ার চেষ্টা করেছেন শিল্পী। বিমূর্ত এবং পরাবাস্তব রূপক ও প্রতীকের মাধ্যমে তিনি গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের চিত্রভাষ্যে গভীর ব্যঞ্জনা দিয়েছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশকিছু শিল্পকর্মগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছে, বাস্তব জীবন ও বাস্তবানুগ শিল্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত মাত্রা যুক্ত করলে সৃজিত শিল্প নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হতে পারে। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, শিল্প ও বাস্তবতার মধ্যে গভীর যোগসূত্র থাকে। আর একজন শিল্পী বাস্তবতার নিরিখেই শিল্প সৃষ্টি করেন আর নিজের সৃজনসক্ষমতা দিয়ে অন্যদের থেকে নিজেকে পৃথক করে তোলেন। শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেলের জলরংয়ে আঁকা ‘ছদ্ম-আবরণ-১’ ও ‘ছদ্ম-আবরণ-২’ চিত্রকর্ম দুটি বর্তমান নৃশংস সমাজবাস্তবতার সাক্ষ্য বহন করছে। পরাবাস্তব এ শিল্পকর্ম দুটি একাধারে নান্দনিকতা এবং যন্ত্রণার রসায়ন বলেই প্রতীয়মান হয়। শিল্পী জয়তু চাকমার ‘মিরর অব সোসাইটি-১০’ ও ‘মিরর অব সোসাইটি-১১’ শিরোনামের অ্যাক্রেলিক শিল্পকর্ম দুটি যেন তারই নৃ-গোষ্ঠীর বাস্তবতা নির্দেশ করছে। পাশাপাশি প্রান্তিক ওই নৃ-জনগোষ্ঠীর মুক্তির আকুতিও যেন জানান দেয় শিল্পকর্ম দুটি। বলাই বাহুল্য, আবেগ আর বুদ্ধির সমান্তরাল যাত্রা এক বিন্দুতে মিশলেই জন্ম নেয় গভীর শিল্প। আবার এটাও ঠিক যে, বিমূর্ত চিত্রকলার কোন অবিমিশ্র রূপরীতি নেই। বিভিন্ন ধরনের বিমূর্ত শিল্প নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের ওপর সাময়িক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, হতে পারে তা রং, উপরিতল, রূপরেখা অথবা কিছু আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি। তবে সবক্ষেত্রেই শিল্পীর আবেগ-নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। শিল্প সম্পর্কে আমার ধারণা ও অভিজ্ঞতা তেমন পোক্ত না হলেও এটা বলা অত্যুক্তি হয় না যে, এবারের প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোর বেশিরভাগই বিমূর্ত। তবে পারফর্মিং আর্ট এবং মেটালিক কিছু শিল্পকর্মও চোখে পড়ার মতো। বেশিরভাগ শিল্পকর্ম পরাবাস্তবতা পরিগ্রহ করে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে বলা যেতে পারে। অপরদিকে সৃজনশীলতার যে প্রক্রিয়া বাস্তবের প্রতিনিধিত্ব করে তার বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকা অমূলক নয়। স্বাভাবিকভাবে একটি শিল্পকর্ম চোখের দৃষ্টিতে একভাবে ধরা পড়ে। আবার শিল্পকর্মের রং-রেখা, কৌণিক দূরত্ব কিংবা আলোক প্রক্ষেপণে শিল্পকর্মটির যে দৃশ্যকল্প তৈরি হয় তা নিউরো-ট্রান্সমিটারের সাহায্যে মস্তিষ্কে পৌঁছে এবং সেখানে মেন্টাল ইমেজ তৈরি করে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হয়। ফলে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আমি সেদিকে না গিয়ে বরং এটুকু বলতে পারি যে, ভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তুনিচয় বিকৃত রূপরীতির ভেতর দিয়ে বিমূর্ততায় আবির্ভূত হয়। প্রকৃতির দৃশ্যগ্রাহ্য রূপের বিকৃতি উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে শিল্পী নিঃসন্দেহে দৃশ্যগ্রাহ্য জগতের নিজস্ব একটি মূল্যায়ন তুলে ধরেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যসমূহ বাস্তব থেকে দূরবর্তী হলেও মনের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রধান বিষয়। জটিল পরিকল্পনাহীনতা, বুনট, রং, রেখা, এলোমেলো গড়ন, উপরিতল, ক্ষেত্রের মাঝে যে সাদৃশ্যহীনতা তা বিমূর্ত চিত্রশিল্পীদের একচ্ছত্র স্বাধীনতার বিষয়টি নির্দেশ করে। এটা আধুনিক চিত্রকলার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এবারের প্রদর্শনী আধুনিক চিত্রকলার অনুপম সন্নিবেশ বলা যেতেই পারে। এবার একটু পেছন থেকে দেখা যেতে পারে। আমরা যদি সত্তর দশকের শিল্পী এসএম সুলতানের চিত্রকর্মের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই তার অধিকাংশ চিত্রকর্মে পেশীসমৃদ্ধ মানুষের উপস্থিতি। বলাই বাহুল্য, এই ‘পেশীবহুল’ মানুষ এসএম সুলতানের নিজস্ব কল্পনা, যা তাকে তার সময়ের অন্য শিল্পীদের থেকে স্বতন্ত্র করেছে। বর্তমান প্রদর্শনীতে এ রকম কিছু ভিন্ন ঘরানার শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে শিল্পী সহিদ কাজীর ‘সোনালি আঁশ’ শিল্পকর্মটি উল্লেখ করার মতো। এটি শিল্পী তৈরি করেছেন মিশ্র মাধ্যমে। বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ এই ‘সোনালি আঁশ।’ এটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই শিল্পটি বর্তমানে অলাভজনক হয়ে উঠেছে মূলত সোনালি আঁশের পরিবর্তে প্লাস্টিক পণ্য বাজার দখল করে নেয়ায়। যে কারণে, এ শিল্পে কর্মরতদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত নেই। শিল্পী সহিদ কাজী এ্যাক্রিলিক, কাঠ, পরিশোধিত পাট, রং ইত্যাদির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এ শিল্পের বিদ্যমান বাস্তবতা। সাগর চক্রবর্তীর ‘শ্রমের মর্যাদা’ শীর্ষক স্থাপনা-শিল্পকর্মটি চিন্তার নতুনতর সংযোজন বলে মনে হয়েছে। প্রতিবিম্ব বা প্রতিফলনের মাধ্যমে পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্টদের যন্ত্রণা বিবৃত হয়েছে এই শিল্পকর্মে। চিত্রকর্ম ছাড়াও প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, মৃৎশিল্প ইত্যাদি শিল্পকর্মগুলোও দর্শকের মননে নতুনতর চিন্তা ও সৌন্দর্যের উন্মেষ ঘটায়। এছাড়া ভাস্কর শহিদুজ্জামানের ‘৭১-এর পিরামিড, হাবিবা আখতারের ব্রোঞ্জের তৈরি ‘সীমাবদ্ধতার যন্ত্রণা’, শিল্পী তাজরিয়ান তাবাসসুমের ‘রুদ্ধশ্বাস’ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। পরিশেষে সব কিছু মিলিয়ে এবারের ২৩তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ বললেও অত্যুক্তি হয় না। উল্লেখ্য, জাতীয় চিত্রশালার ৫টি গ্যালারিতে এবারের দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে ১৫৯টি চিত্রকলা, ৪৫টি ভাস্কর্য, ৫০টি ছাপচিত্র, ১৭টি কারুশিল্প, ৮টি মৃৎশিল্প, ৩৭টি স্থাপনা ও ভিডিও আর্ট, ৭টি কৃৎকলা (পারফরম্যান্স আর্ট) স্থান পেয়েছে। চলতি মাসের ১ জুলাই শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হবে আগামী ২১ জুলাই।
×